সুরা সাবা আয়াত-১৩ অর্থ : তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ৷
----- উপরের আয়াতটি থেকে বোঝা যায় ইসলামে পুজাবিহীন ভাষ্কর্য নিষিদ্ধ নহে কিন্তু নীচের হাদিস গুলো দিয়ে দাবি করা হচ্ছে ভিন্ন কিছু, সেটা কতখানি গ্রহণ যোগ্য সেটা নিয়েই আজকের আলোচনা।
-----------
আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল ওয়াহহাব (র)…সাঈদ ইবনে আবুল হাসান (র) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবনে আব্বাস (রা) এর নিকট উপস্থিত ছিলাম, এমন সময়ে তাঁর কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আবু আব্বাস! আমি এমন ব্যক্তি যে, আমার জীবিকা হস্তশিল্পে। আমি এসব ছবি তৈরি করি। ইবনে আব্বাস (রা) তাঁকে বলেন, (এ বিষয়) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি যা বলতে শুনেছি, তাই তোমাকে শোনাব। তাঁকে আমি বলতে শুনেছি,
‘‘যে ব্যক্তি কোন ছবি তৈরি করে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে শাস্তি দিবেন, যতক্ষণ না সে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে। আর তাতে সে কখনো প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে না।”
(এ কথা শুনে) লোকটি ভীষণভাবে ভয় পেয়ে গেল এবং তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এতে ইবনে আব্বাস (রা) বললেন, আক্ষেপ তোমার জন্য, তুমি যদি এ কাজ না-ই ছাড়তে পার, তবে এ গাছপালা এবং যে সকল জিনিসে প্রাণ নেই, তা তৈরি করতে পার।
আবু আবদুল্লাহ (ইমাম বুখারী) (র) বলেন, সাঈদ (রা) বলেছেন আমি নযর ইবনে আনাস (রা) থেকে শুনেছি তিনি বলেছেন, ইবনে আব্বাস (রা) হাদীস বর্ণনা করার সময় আমি তার কাছে ছিলাম। ইমাম বুখারী (র) আরও বলেন, সাঈদ ইবনে আবু আরুবাহ (র) একমাত্র এ হাদিসটি নযর ইবনে আনাস (র) থেকে শুনেছেন। [সহীহ বুখারী, চতুর্থ খণ্ড, হাদিস নং ২০৮৪ – ইফা]
======================================
উপরের হাদিসটি দিয়ে সুরা সাবা ১৩ নং আয়াতে যে ভাষ্কর্যের কথা বলা হয়েছে, সেই ভাষ্কর্যের বৈশিষ্ঠ কি হবে সে বিষয়ে হুজুরদের দাবি হোল প্রাণবিহীন বস্তুর ভাষ্কর্যের কথা নকি বলা হয়েছে। এই হাদিসের শেষ অংশে গাছের ছবি বা প্রতিলিপি বানাতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে , অথচ গাছের প্রাণ আছে। সে কারনে এই হাদিসটি কতখানি গ্রহণ যোগ্য সেটা বিবেচনার বিষয়। তাই হুজুরদের দাবি,, সুরা সাবার ১৩ নং আয়াতে যে ভাষ্কর্যের কথা বলা হয়েছে, সেটা শুধু মাত্র প্রাণহীন বস্তুর ভাষ্কর্য, সেটা কি গ্রহণ যোগ্য ?
তারমানি হোল যেহেতু হাদিসটি প্রশ্ন সাপেক্ষ, তাই প্রাণ সম্পন্ন প্রাণীর ভাষ্কর্য ছবিকে, হারাম দাবি করাটা কি ঠিক?
=======================================
=======================================
মুহাম্মদ (র)…আয়িশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য প্রাণীর ছবিযুক্ত একটি বালিশ তৈরি করেছিলাম। যেন তা একটি ছোট গদী। এরপর তিনি আমার ঘরে এসে দু’দরজার মাঝখানে দাঁড়ালেন এবং তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ আমার কি অপরাধ হয়েছে? তিনি বললেন, এ বালিশটি কেন? আমি বললাম, এ বালিশটি আপনি এর উপর ঠেস দিয়ে বসতে পারেন আমি সে জন্য তৈরি করেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
“(হে আয়িশা) (রা) তুমি কি জান না? যে ঘরে প্রাণীর ছবি থাকে, সেখানে (রহমতের) ফিরিশতা প্রবেশ করেন না? আর যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি আঁকে তাকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে? তাকে (আল্লাহ্) বলবেন, ‘তুমি যে প্রাণীর ছবি বানিয়েছ, এখন তাকে প্রাণ দান কর।’ [সহীহ বুখারী, পঞ্চম খণ্ড, হাদিস নং ২৯৯৭ – ইফা]
ইবনে মুকাতিল (র)…আবূ তালহা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
“যে ঘরে কুকুর থাকে আর প্রাণীর ছবি থাকে সে ঘরে (রহমতের) ফিরিশতা প্রবেশ করেন না।” [সহীহ বুখারী, পঞ্চম খণ্ড, হাদিস নং ২৯৯৮ – ইফা]
ইয়াহইয়া ইবনে সুলাইমান (র)…সালিম (রা) তাঁর পিতার নিকট হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, জিবরাঈল (আ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে (সাক্ষাতের) ওয়াদা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সময় মত আসেন নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বললেন আমরা ঐ ঘরে প্রবেশ করি না, যে ঘরে ছবি ও কুকুর থাকে। [সহীহ বুখারী, পঞ্চম খণ্ড, হাদিস নং ৩০০০ – ইফা]
আলী ইবনে আবদুল্লাহ (র)…আবু তালহা (রা) সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“যে ঘরে কুকুর এবং প্রাণীর ছবি থাকে সে ঘরে ফিরিশতাগণ প্রবেশ করেন না।” [সহীহ বুখারী, পঞ্চম খণ্ড, হাদিস নং ৩০৮৮ – ইফা]
হুমায়দী (র)…মুসলিম (র) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা (একবার) মাসরুকের সাথে ইয়াসার ইবনে নুমায়রের ঘরে ছিলাম। মাসরুক ইয়াসারের ঘরের আঙ্গিনায় কতগুলো মূর্তি দেখতে পেয়ে বললেনঃ আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে শুনেছি এবং তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন যে,
“(কিয়ামতের দিন) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে তাদের, যারা ছবি বানায়।” [সহীহ বুখারী, নবম খণ্ড, হাদিস নং ৫৫২৬ – ইফা]
আলী ইবনে আবদুল্লাহ (র)…আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তাবূক যুদ্ধের) সফর থেকে প্রত্যাগমন করলেন। আমি আমার ঘরে পাতলা কাপড়ের পর্দা টাঙ্গিয়েছিলাম। তাতে ছিল (প্রানীর) অনেকগুলো ছবি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এটা দেখলেন, তখন তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং বললেনঃ
“কিয়ামতের সে সব মানুষের সবচেয়ে কঠিন আযাব হবে, যারা আল্লাহর সৃষ্টির (প্রাণীর) অনুরূপ তৈরি করবে।”
আয়েশা (রা) বলেন, এরপর আমরা তা দিয়ে একটি বা দু’টি বসার আসন তৈরি করি। [সহীহ বুখারী, নবম খণ্ড, হাদিস নং ৫৫৩০ – ইফা]
---------- এই হাদিস গুলোতে দেখা যাচ্ছে, ছবি ভাষ্কর্য ইত্যাদিকে হারাম বলা হচ্ছে যেটা সুরা সাবা আয়াত ১৩ সাথে মিলছে না।
সুরা মায়দা আয়াত ১১০
৫--১১০
যখন আল্লাহ বলবেনঃ হে ঈসা ইবনে মরিয়ম, তোমার প্রতি ও তোমার মাতার প্রতি আমার অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন আমি তোমাকে পবিত্র আত্মার দ্বারা সাহায্য করেছি। তুমি মানুষের সাথে কথা বলতে কোলে থাকতেও এবং পরিণত বয়সেও এবং যখন আমি তোমাকে গ্রন্থ, প্রগাঢ় জ্ঞান, তওরাত ও ইঞ্জিল শিক্ষা দিয়েছি এবং যখন তুমি কাদামাটি দিয়ে পাখীর প্রতিকৃতির মত প্রতিকৃতি নির্মাণ করতে আমার আদেশে, অতঃপর তুমি তাতে ফুঁ দিতে; ফলে তা আমার আদেশে পাখী হয়ে যেত এবং তুমি আমার আদেশে জন্মান্ধ ও কুষ্টরোগীকে নিরাময় করে দিতে এবং যখন আমি বনী-ইসরাঈলকে তোমা থেকে নিবৃত্ত রেখেছিলাম, যখন তুমি তাদের কাছে প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলে, অতঃপর তাদের মধ্যে যারা কাফের ছিল, তারা বললঃ এটা প্রকাশ্য জাদু ছাড়া কিছুই নয়।
--- এই আয়াতে বলা হচ্ছে হযরত ঈসা (আ: ) মাটি দিয়ে পাখীর প্রতিকৃতি বানিয়ে ফু দিতেন , তখন আল্লাহর হুকুমে জীবন্ত পাখী হয়ে যেত । এর অর্থ হোল আল্লাহর আদেশ ছাড়া হযরত ঈসা ( আ: ) বানানো প্রতিকৃতি প্রাণ পেত না ।
তাহোলে কিয়ামতের দিনে যারা ছবি বা মুর্তি বানিয়েছিল তারা আল্লাহর আদেশ ছাড়া তাদের সৃষ্ঠির দেহে প্রাণের সন্চার করবে কি করে । হযরত ঈসা (আ: ) যদি পাখীর প্রতিকৃতি বানাতে পারে , তাহোলে অন্য মানুষ কেন বানাতে পারবে না ।
=======================================
পুতুল খেলা কি হারাম?
ইসলামে পুজার মূর্তি হারাম সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু খেলার পুতুল ভিন্ন জিনিস। আমাদের বুঝতে হবে পূজার মূর্তি আর খেলনা পুতল এক নয়। খেলনা পুতুলকে কেউ ভক্তি করে না। খেলনা পুতুল আর পুজার মূর্তিতে পার্থক্য আছে। আবার পুজার মূর্তি দিয়ে কেউ কখনো খেলে না। খেলনা পুতুল বৈধ। তা যেমনই হোক তা বৈধ। যা হাদিস থেকে প্রমাণিত।
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
আমি রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর উপস্থিতিতে পুতুল দিয়ে খেলতাম। আমার বান্ধবিরাও আমার সাথে খেলত। যখন রাসুলুল্লাহ (সঃ) আসতেন তখন তারা লুকিয়ে যেত। কিন্তু নবী (সঃ) তাদেরকে ডাকতেন এবং খেলায় অংশগ্রহণ করতে বলতেন।
-সহিহ বুখারি, ৯ম খণ্ড, হাদিসঃ ৫৭০০ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
-Sahih al-Bukhari Vol. 8, Book of Good Manners, Hadith 151
আয়েশা(রাঃ) বলেন-
আমি আল্লাহর রাসুলের উপস্থিতিতে পুতুল নিয়ে খেলা করতাম আমার বান্ধবীরাও আমার সাথে খেলত। যখন আল্লাহর রাসুল (আলাইহিছ ছালাম) বাড়ীতে প্রবেশ করতেন, তখন ওরা পুতুলগুলো লুকিয়ে নিত। কিন্তু তিনি (সঃ) তাদেরকে আমার সাথে একত্রে খেলতে বলতেন।
(সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬১৩০ ; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৪৪০ )
আয়েশা (রাঃ) আরো বলেন-
একবার রাসুলুল্লাহ (সঃ) আয়েশা(রাঃ)-র ঘরের পর্দা উন্মোচন করে খেলনা দেখে বললেন, এগুলো কী? তিনি বললেন, এগুলো আমার পুতুল। এগুলোর মধ্যে একটি পাখাওয়ালা ঘোড়া ছিল। সেটি দেখে তাকে তিনি(সঃ) বললেন-" এই খেলনাগুলোর মাঝে এটি কি?" আমি বললাম,"ঘোড়া", রাসুলুল্লাহ (সঃ) বললেন-"ঘোড়ার উপর কি?" আমি বললাম-"২ টি ডানা",অতঃপর আমি বললাম- "আপনি শুনেননি যে, সুলাইমান আলাইহিস সালামের একটি ঘোড়া ছিল যার ২ টি ডানা ছিল?এরপর রাসুলুল্লাহ (সঃ) হাসলেন এমনকি তার চোয়ালের দাঁত মুবারকও দেখা যাচ্ছিল।"
-আবু দাউদ, ৫ম খণ্ড, হাদিস নং-৪৮৫০(ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
রাসুল (সঃ) যার অনুমতি দিয়েছেন তার বিপরীতে যুক্তি খোঁজা হচ্ছে নবীর প্রতি বেয়াদবি। রাসুলুল্লাহ (সঃ) অনুমতি দিয়েছেন। ব্যাস, এখানে আর কোন কথা থাকতে পারে না। কোন বিপরীত যুক্তি থাকতে পারে না।
-----------------
এই হাদিসটিতে দেখতে পেলেন একটি পুতুলের বর্ণনা করা হয়েছে, যেটা একটা প্রাণীর পুতুল ( ঘোড়া)
তাই এটাকি বলা যায় না পুজাহীন প্রাণীর ভাষ্কর্য ইসলামে নিষিদ্ধ নহে?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫৩