somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

করোনার দিনে জার্নাল

১৭ ই মার্চ, ২০২০ সকাল ১১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সরকারী ঘোষণা আসার পর , গতকাল ১৪ দিনের জন্যে আমার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ দিলো। কারণ, করোনা ভাইরাস। সরকারী ঘোষণা আসার আগ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় নোটিস দিয়েছিল - সকল ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করা হল, শুধু মাত্র ক্লাস এবং পরীক্ষা ছাড়া।

করোনার উৎপত্তির সময় থেকেই আমি নানা কারণে হাসছি। এই ভাইরাস সংক্রান্ত নানা রকম অদ্ভুত অফিশিয়াল ঘোষণা সেই হাসি উদ্রেক করার একটা কারণ তো বটেই। এছাড়া , ধরেন - এই ভাইরাসের নামের আগে আবার ডক্টরেরা 'নবেল' শব্দটা সংযুক্ত করে দিয়েছেন। ভাবটা যেন এই - প্রতিষেধক যেহেতু এখনো আবিষ্কার করতে পারি নি, তার আগে আক্রান্তদের এই বলে সান্ত্বনা দেয়া যাক যে - যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তা বড়ই 'নবেল'!

না হেসে করারই বা কি আছে, যখন মনে পড়ে যে আমি পৃথিবীর সবচে ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশের বাসিন্দা, যেখানে প্রায় অর্ধেক মানুষের সেনিটাইজেশনের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা নেই, এবং বাকি অর্ধেক নিয়মকানুন জানলেও ঠিক মত মানতে চায় না? মহামারি বলতে যা কিছু আমাদের মস্তিষ্কে প্রকট হয়, তার দশ শতাংশও যদি আমাদের দেশে জেঁকে বসে, আমাদের অর্ধেকের বেশি মানুষ বিছানায় পড়ে যাবে। বাস্তবতার নিরিখে প্রবল ভীতিতে আচ্ছন্ন হওয়া ছাড়া তো উপায় নেই। তাই আপাতত হালকা চালের রসিকতাই সই।

অ্যামেরিকান এক মহিলা অনলাইন সেলিব্রেটির ভিডিও দেখলাম গতকাল , রসিকতা করেই বানানো। তার ভিডিওর বার্তা হল এই যে - সরকারের তরফ থেকে বলেছে বাড়ি ঘরে থাকতে আর নিজেদের ইমিউন সিস্টেমকে আরও উন্নত করে এমন খাবার খেতে, বা কাজ করতে। কাজেই সব অ্যামেরিকানের উচিৎ এখন বাসায় থাকা, এবং প্রচুর পরিমানে যৌনকর্ম করা, যেহেতু তা মানুষের ইমিউন সিস্টেমের উপকার করে (একান্তই উক্ত ভ্লগারের থিওরি, আমি এর সত্য মিথ্যা জানি না)। পার্শ্ববর্তি দেশ ক্যানাডার প্রেসিডেন্ট নিজে কোয়ারেন্তিনে যাওয়া এবং তার স্ত্রীর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর, সর্বোপরি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া এবং মানুষের মৃত্যু ঘটবার পর, এখন হয়তো তাদের এই কমিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে।

কোয়ারেন্তিনে মানুষজনকে রাখা নিয়েও বিস্তর রসিকতা চালু হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। বিদেশ ফেরত যাদেরই বাংলাদেশে আসার পর কোয়ারেন্তাইনে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল, তারা খুব সম্ভব দুর্বোধ্য ইতালিয়ান, চীনা অথবা ইংরেজি ভাষায় গালিগালাজ বা শ্লোগান দিতে দিতে সেখান থেকে বের হয়ে এসে বাড়ি চলে যান। কেননা যে বাঙ্গালী ইংরেজিতে গালি দিতে জানে, তারে দাবায়া রাখা কোনক্রমেই সম্ভব না। আমাদের কোন এক মন্ত্রী নাকি তাদের ফাইভ স্টার হোটেলে রাখবার সুবিধা দিতে না পারায় সরকারের ব্যারথতা নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেন , এবং আদর করে এই বিদেশ ফেরতা জনতাকে নবাবজাদা বলে আখ্যা দেন। আমাদের এই সুলতানেরা এখন দেশে ফিরে ঘরের আঙ্গিনায় বসে এলাকাবাসিকে বিদেশের গল্প শোনাচ্ছেন, নিজেরা পিকনিকে যাচ্ছেন, বন্ধুবান্ধবের সাথে চিজিপিজ্জা খেয়ে বেড়াচ্ছেন। আমি একাডেমিয়ার লাইনের লোক। আগে পরীক্ষার হলে যে ছেলে/মেয়ে দেখাদেখির চেষ্টা করতো, তাদের উঠিয়ে রুমের একটা একাকী কর্নারে বসিয়ে দিয়ে বলতাম - সাইবেরিয়া পাঠিয়ে দিলাম তোমায়। এখন এরকম হলে বলি - বেশি দেখাদেখি করলে একদম কোয়ারেন্তাইন করে দেবো!

বলিউডের নায়িকা ইশা গুপ্তার ইন্সটাগ্রাম স্টোরিতে খুব অর্থবহ একটা পোস্ট দেখলাম গতকাল, যাতে লেখা - "আওয়ার এলডারস হ্যাড টু কাম আউট অ্যান্ড ফাইট ওয়ারস টু সেভ দেয়ার ফিউচার জেনারেশন। নাও ইটস আওয়ার ডিউটি টু সিট ইনসাঈড আওয়ার হোম, অন আওয়ার কাউচেস টু সেভ আওয়ার এলডারস"। - খুবই সুন্দর কথা। করোনার মৃত্যুঝুঁকি বয়স্কদেরই বেশী। আমরা কমবয়েসিরা বাইরে ঘুরেফিরে ভাইরাস নিয়ে বাসায় ঢুকলে জ্বরে ভুগে একসময় হয়তো আবার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারব, কিন্তু বৃদ্ধ যারা, যাদের শরীরে আগে থেকেই নানা কমপ্লেক্সিটি আছে, তাদের পক্ষে সারভাইভ করা মুশকিল হবে। গতকাল এক কষ্টের সংবাদ শুনলাম যে - ইতালির হসপিটালগুলোতে আইসিইউর সংকট চলায় তারা আশিঊর্ধ্ব বয়েসিদের আর আইসিইউতে নিচ্ছেন না। এ সুবিধা অপেক্ষাকৃত কমবয়স্কদের জন্যেই মুলতবী থাকবে, কেননা তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাব্যতা বেশী।

গারসিয়া মারকেজের লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা উপন্যাসটাও মানুষের কথায়, লেখায় আজকাল বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এবং লাভ ইন দা টাইম অফ করোনা নামে ফিরে আসছে। এ প্রাসঙ্গিকতা নিঃসন্দেহেই আমরা চাই নি।

গতকাল শেষ ক্লাসে যখন ইউনিভার্সিটির ছুটির ঘোষণা ছেলেপেলেদের মধ্যে পড়ে শুনালাম, সবাই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। পরে যখন শিক্ষামন্ত্রীর এ কথাও সংযুক্ত করে দিলাম যে - এই ছুটিকে যেন তারা বেড়ানোর উপলক্ষ্য হিসেবে মনে না করে এবং বাসায় থেকে সময়কে কাজে লাগায়, তাদের মধ্যে চাঞ্চল্য খানিকটা কমে এলো। তারপরেও দু'একজন অত্যুৎসাহী ছাত্র-ছাত্রী জিজ্ঞেস করে বসলো যে আমি এই ছুটিতে কি করবো। কোনরকমের কালক্ষেপণ ছাড়াই বলে দিলাম - বই পড়বো। অনেক অনেক অসাধারণ বই বাসায় জমে পড়ে আছে। এগুলো না পড়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়াটা জীবনের এক অর্থে অপচয়ই হবে। বই তো পড়বোই, ঘরের কাজেও হাত লাগাতে হবে। সেই সঙ্গে খুব উদ্বিগ্নভাবে লক্ষ্য করবো বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে এই করোনা পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। জীবন যখন একদন কণ্ঠনালীতে এসে ঠেকেছে, এমন সময়ও কি আমরা পারব আমাদের জঘন্য রকমের বাজে সব অভ্যাসগুলো ত্যাগ করতে? রাস্তাঘাটে, যত্রতত্র কফ থুতু ফেলা থেকে নিজেদের বিরত রাখতে? খোলা ময়দানে নাক ঝেড়ে হাতটা প্যান্টের ওপর ঘষে মুছে সামনের মানুষের সাথে করমর্দনের উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দেয়া বন্ধ করতে? হাত ধোয়া, পোশাক পাল্টানো ছাড়া বাড়িতে এসেই নিজের পরিবারের লোকজন, নিজেদের শিশুদের জড়িয়ে না ধরতে বা কোলে তুলে না নিতে? এই প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর নিশ্চিত করা খুবই জরুরী এই কারণে যে - করোনার বিরুদ্ধে আমাদের এই যে লড়াই, এ লড়াই একা জেতা সম্ভব না। সামগ্রিক প্রচেষ্টা, সবাই মিলে সচেতনভাবে কাজ না করে, শুধুমাত্র ব্যক্তিপর্যায়ের সচেতনতা আমাদের বাঁচাতে পারবে না। ফুটবল, ক্রিকেট, এমনকি কে পপকেও সরিয়ে দিয়ে করোনা এখন পৃথিবীর প্রধানতম গ্লোবাল পপ কালচার। গেম অফ থ্রোনসের সাথে মিলিয়ে বলা চলে - নাইট কিং তার আর্মি অফ ডেডদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের সামনে। দা লং ডার্ক নাইট একদমই আসন্ন। আমরা, সমাজের বিবিধ স্তরের , বা হাউজের মানুষেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে এই করোনার মোকাবিলা করতে পারি কিনা, এটাই এখন দেখার বিষয়। একা লড়াই করে জেতার আসা করলে, সেই যে ডথ্রাকি ট্রাইব প্রথমে আগ বাড়িয়ে আক্রমণ শানাতে গিয়ে একদম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো, আমাদেরও অবস্থা হবে সেরকমই। একা নয়, সম্মিলিত প্রয়াসে সফলতা। শুধুমাত্র আপনার পরিবার নয়, আপনার প্রতিবেশী, আপনার কাজের বুয়ার ফ্যামিলির সেইফটিও যেন আপনার চিন্তার বিষয় হয়।

আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গে যখন উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম, মনটা ভালো হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। গ্রিন মডেল টাউনে থাকি। জায়গাটা অসম্ভব রকমের গাছগাছালিতে পূর্ণ, এমনটা ঢাকা শহরের ভেতরে আর দেখা যায় না। মিষ্টি একটা রোদ, বসন্তের মিঠে বাতাস, বিচিত্র সব পাখির কিচির মিচির ডাক আর সামনে দিগন্তে বিস্তৃত সবুজের সমারোহ। সব মিলিয়ে কি যে অসাধারণ এক অনুভূতি! হঠাৎ মনে হল , আল্লাহ না করেন, যদি করোনা, বা এর চেয়েও শক্তিশালী কোন ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীর সব মানুষ একদিন শেষ হয়ে যায়, তবুও সূর্য উঠবে, পাখি গান গাইবে, বাতাস এসে দোলা দেবে ধানের শীষে, নদীতে ঢেউ উঠবে, দু'একটা নোঙ্গর করে রাখা নৌকার পাল ফুলে উঠবে বাতাসের তোড়ে, শুধু যাত্রা শুরু করবার মত কেউ থাকবে না। পৃথিবীর রং - রূপ - গন্ধ উপভোগ করবার কেউ থাকবে না। তবুও পৃথিবী চলবে। একাকী একটা গ্রহ মহাজাগতিক পথ ঘূর্ণায়মান অবস্থায় পরিভ্রমণ করতে থাকবে এমন একরাশ প্রাণীর মৃতদেহ বুকে নিয়ে, যারা তাদের মাতৃস্থানীয় এই গ্রহের প্রতি কখনো সহানুভূতিশীল আচরণ করে নি। কি নির্মম সুন্দর হবে সেই দিনটা!
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০২১ সকাল ১১:৪৮
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×