somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সূতির খালের হাওয়া ৪০ঃ ভৌগ ম্যাগাজিন ফ্রান্স - এর হিজাব বিতর্ক এবং আমার কিছু ভাবনা।

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ১১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ভৌগ ফ্রান্স - ম্যাগাজিনে হেডস্কার্ফ পরিহিত অ্যামেরিকান অভিনেত্রী জুলিয়া ফক্স

১।
করোনাকালে ডিনার করতে করতে আমার আর আমার স্ত্রীর সময় কাটানোর অন্যতম উপায় ছিল অ্যামেরিকান সিটকম / সিচুয়েশনাল কমিডিগুলো। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত দেখলাম ফ্রেন্ডস, হাউ আই মেট ইওর মাদার, ইয়াং শেলডন, এবং সর্বশেষ যেটা দেখে শেষ করলাম, দা বিগ ব্যাং থিওরি। দা অফিস আমার বৌয়ের পছন্দ না। সামনে হয়তো ব্রুকলিন ৯৯ দেখা শুরু করবো। এই কমেডি এন্টারটেইনমেন্ট সিরিজগুলো দেখতে গিয়ে বুঝেছি, এন্টারটেইনমেন্ট বিজনেস কতো গুরুত্বপূর্ণ। এমনিতে প্রায় সারাদিন ডিপশিট নিয়ে কাজকর্ম, চিন্তাভাবনা; কঠিন দার্শনিক প্রপোজাল না থাকলে কোন লেখা বা চলচিত্রকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনিনা। এই করোনার দিনগুলোতে এসে বুঝেছি, দিনের যে নির্দিষ্ট সময়টুকু পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে হাসি - আনন্দে আমি, আমরা কাটাই, সে সময়টুকুকে উজ্জ্বল করে রাখার জন্য এই এন্টারটেইনমেন্ট কনটেন্ট নির্মাতারা কি অসাধারণ এবং অমূল্য ভূমিকা রাখেন।

যা হোক, এই টিভি সিরিজগুলো কিন্তু অ্যামেরিকার সাধারণ জনজীবনের গত ৩০ বছরের মোটামুটি একটা ডকুমেন্ট। ফ্রেন্ডস যখন শেষ হয় প্রায় তখনই হাউ আই মেট ইওর মাদার শুরু হয়, হাউ আই মেট ইওর মাদার চলতে চলতেই দা বিগ ব্যাং থিওরি শুরু হয়। এই সিরিজটা শেষ হল ২০১৮তে। ইয়াং শেলডন বিগব্যাং থিওরির প্রিক্যুয়াল যেটা এখনও চলছে, এবং ৮০র দশকের অ্যামেরিকার সাউদারন অংশের জীবনযাত্রার উপর নির্মিত।

এই সিরিজগুলির একটাতেও কোন প্রধান ক্যারেক্টারে, এমনকি সাইড ক্যারেক্টার হিসেবেও কোন মুসলিম ক্যারেক্টারের উপস্থিতি নাই। হাউ আই মেট ইওর মাদার টিভি সিরিজটায় রঞ্জিত নামে এক বাঙালি ক্যাব ড্রাইভার থাকে, খুবই মাইনর একটা ক্যারেক্টার এবং সেও মুসলিম না। দা বিগ ব্যাং থিওরিতে রাজেশ রামায়ণ কুথ্রাপালি, ওরফে রাজ কুথ্রাপালি নামে এক প্রধান ক্যারেক্টার থাকলেও, নাম থেকেই বোঝা সম্ভব - সে মুসলিম না।

আমার মনে গতকালই প্রশ্নটা এলো - কেন ব্যাপারটা অমন? অ্যামেরিকায় বা ইয়োরোপে গত ৩০ বছরে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অভিবাসি মুসলিমদের সংখ্যা কি কম? তাহলে অ্যামেরিকার মেইনস্ট্রিম টিভি সিরিজগুলিতে মুসলিম ক্যারেক্টার একেবারে নাই ই কেন?
ইন্সট্যান্ট আমার মাথায় যে উত্তর এসেছে, তা হল, সম্ভবত নির্মাতা মুসলিম অভিবাসিদের পছন্দ করেন না, এবং তাদের নিজেদের টিভি সিরিজে উপস্থাপন করতে চান না মুসলিমদের নিজেদের কালচার , রিলেজিয়ন, এবং এথনিসিটি নিয়ে প্রচণ্ডরকমের রিজিড বা গোঁড়া হওয়ার কারনে।

বিগব্যাং থিওরিতে ইন্ডিয়ান এবং হিন্দু কালচারকে নিয়ে মার্সিলেসলি হিউমার করা হয়েছে। হাউ আই মেট ইওর মাদারে ভয়াবহ রেসিস্ট জোক আছে। এগুলোর সমপরিমানে একটা জোক বা স্যাটায়ারো যদি অ্যামেরিকান বা ইউরোপিয়ান মুসলিমদের নিয়ে করা হতো, সম্ভাবনা ছিল যে মুসলিম কমিউনিটি অফেন্সড ফিল করতো, এবং নির্মাতাদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়তো।

২।
গতকাল তুরস্কের টিআরটি মিডিয়ার কল্যানে আর একটা খবর চোখে পড়লো। তুরস্ক আর ফ্রান্স তো মিডিয়া ওয়ারে জড়িত এরদোয়ানের আমল থেকেই। তুরস্ক, ফ্রান্সের এরকম মাখো মাখো খবর ফলাও করে প্রচার করতে কোন কসুর করে নি।

ভৌগ ম্যাগাজিন ফ্রান্স সম্প্রতি অ্যামেরিকান অভিনেত্রী জুলিয়া ফক্সের হেডস্কার্ফ পরিহিত ছবি শেয়ার করে ক্যাপশন দিয়েছে - 'ইয়েস টু দা হেডস্কার্ফ' । এটা নিয়ে সমগ্র মুসলিম মিডিয়া ওয়ার্ল্ড সরগরম। ফ্রান্সে আইন পাশ করে যেখানে মুসলিম নারীদের হিজাব পরা ব্যান করে দিচ্ছে, সেখানে স্টাইল কা ওয়াস্তে কোন অভিনেত্রী হেডস্কার্ফ পড়লে তাকে ইয়েস বলা, কাভারে তুলে আনা - এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নিয়েই মুসলিম মিডিয়া পাড়ার ক্ষোভ এবং উদ্বেগ।

৩।
ইউরোপে বা ওয়েস্টে ইন জেনারেল, মুসলিমদের নিয়ে এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডই বলেন, বা বৈষম্যমূলক লিগ্যাল স্টেপসই বলেন - আমার এতে খুব বেশী বিস্ময় কাজ করে না। কারন, বিষয়গুলি এমনই হবার কথা।

বাংলাদেশে আজ যদি হঠাৎ মাথা কামানো টিকিধারী গেরুয়া সন্ন্যাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, মুসলমানরা ভ্যাবাচ্যাকা খায়া যাবে না? কাশীধামে যদি অধিকাংশই জোব্বা পরিহিত দাড়ি টুপিওয়ালা মুসলিম মৌলোভীর সংখ্যা বাড়ে - ঐখানের হিন্দুরা থ' বনে যাবে না? তেমনি ইউরোপ বা ওয়েস্টের মানুষজনের যে জীবন দর্শন তার সঙ্গে আমাদের মুসলিমদের দর্শন মিলে না। মেলা সম্ভব না। ব্যক্তিগত জীবনাচরণ থেকে ধর্মকর্ম তাদের অনেক দূরে। কার্পেডিয়াম থিম, বা 'সীজ দা ডে' , বা আজকের জন্যে বাঁচো - এই হচ্ছে তাদের ভোগবাদী (নিন্দার্থে শব্দটা ব্যবহার করছি না) জীবনের মূল কথা। এই জীবনকেই সিনেমা, টিভি সিরিজের মতো পপুলার কালচারে তারা নিয়মিত গ্লামারাইজড করে উপস্থাপন করে। সেখানে একজন মুসলিম, যে উইকেন্ড সেলিব্রেট করতে বারে যাবে না, পার্টি করবে না, মদ খাইতে রাজি না, ক্যুয়ার ইস্যুতে অনড় - সে ফিট করে কীভাবে? লন্ডন - প্যারিস - বার্লিন - নিউইয়র্কে তবুও তো হিজাবধারী, বা দাড়িওয়ালা মুসলিমদের সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়।

আমার তো মনে হয় (কলোনিয়ালিজম, এবং হালের গ্লোবাল ইম্পেরিয়ালিস্ট প্রোপ্যাগান্ডার মাধ্যমে প্রাপ্ত) পাশ্চাত্যের উন্নত জীবনযাত্রার প্রতি মুসলিম কমিউনিটির আকৃষ্ট হয়ে পিপীলিকার মতো ঐ সমস্ত দেশে অভিবাসন প্রত্যাশী না হওয়াই উত্তম। যদি ধর্ম ধরে রাখা খুব ইম্পরট্যান্ট হয়, তাহলে আমার কোরআনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং বলে যে দেশে কুফরের চর্চা হয়, সেদেশ থেকে হিজরত করে বরং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে চলে আসার বিধান। পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে অভিবাসন প্রত্যাশী হওয়ার কি যৌক্তিকতা তাহলে? নিজ দেশকে এমনভাবে তৈরি করুক এই মুসলমানেরা, যাতে করে তাদের দেশগুলি বিশ্বমানবতার উপকারে এক একটা মডেল হিসেবে উপস্থাপন যোগ্য হয়।

সেই কাজ করতে কি আমরা পারব?

মনে রাখতে হবে, ইসলামের বয়স আজকে দেড় দশক, দেড় শতক না, বরং দেড় হাজার বছর। এখন ওয়াজ মাহফিলে দেড় দুই কিলোমিটার ধরে মাইক লাগায়ে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মনে কষ্ট দিয়ে কেবল মুখে চিৎকার করে বললে হবে না যে ইসলাম পৃথিবীর সেরা ধর্ম। ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা মুসলমানদের গত দেড় হাজার বছরের কৃতকর্মের বিবেচনাতেই বিচার করবে। মুখে মুখে আমরা যতই বলি ইসলাম শান্তির ধর্ম, সমগ্র মানবজাতিরে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করার ধর্ম, জাতভেদের শৃঙ্খল ছিন্ন করার ধর্ম - যদি আমাদের কাজে কর্মে তার প্রতিফলন না হয়, মুখের কথায় কোন কাজ হবে না। যদি সহি ইসলাম শিক্ষা দেয়ার নামে আমরা একে অপরকে স্রেফ কতল করতে থাকি, ভিন্ন ধর্ম এবং সংস্কৃতির প্রতি কোন রকমের সহনশীলতা - সহানুভূতি প্রদর্শন করতে ব্যারথ হই, যদি আমরা হোস্ট কান্ট্রিতে গিয়ে তাদের কালচারকে ঘৃণা এবং জাজমেন্টাল চোখে দেখি, নিজেদের ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে তাদের জীবনাচরণকে কাটাছেড়া করে দূরে সরে থাকি, তাহলে আমরা তাদের চোখে পশ্চাৎপদ একটা জনগোষ্ঠী হিসেবেই চিহ্নিত হবো।

এক আল্লাহর চোখে ভালো থাকলেই হল, বাকি কে আমাকে কি মনে করে এটা ম্যাটার করে না - এই যদি আমাদের মনোভাব হয়, তাহলে তো তা উত্তম, অনুকরণীয়, এবং আদর্শস্থানীয় সাইকোলজি। কিন্তু এই সাইকোলজি নিয়ে পাশ্চাত্যের দেশে অভিবাসন প্রত্যাশী হওয়াটা, তাদের গ্রিকো - রোমান সিভিলাইজেশনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত সংবিধান এবং লেজিস্লেশনকে তাদের দেশে থেকেই অমান্য করাটাও আমার কাছে ইসলামিক আচরন মনে হয় না।

আত্মসমালোচনা - পর্যালোচনাগুলি ইসলামবিদ্বেষীদের থেকে আসার বদলে আমাদের নিজেদের ভেতর থেকেই উঠে আসা উচিৎ বিবেচনায় লেখাটা শেয়ার করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ১১:৩৪
১০টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক্ষমতার আসনে বেশী দিন থাকা শাসকদের মাঝে খালেদা জিয়া সর্বসেরা

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:০৩



আমার এক ছাত্র চাকুরীর পরীক্ষায় ৫২ নম্বর পেয়ে ৩ জনের মধ্যে প্রথম হয়েছিল। দ্বিতীয় জন পেয়েছিল ৪৯ নম্বর এবং তৃতীয় জন পেয়েছিল ৪৭ নম্বর। সে হিসাবে খালেদা জিয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেগম খালেদা জিয়াঃ এক দৃঢ়চেতা, সাহসী অধ্যায়ের সমাপ্তি

লিখেছেন সামহোয়্যারইন ব্লগ টিম, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৩৭



প্রিয় ব্লগার,
আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বেগম খালেদা জিয়া আর আমাদের মাঝে নেই, ইন্না লিল্লাহি ওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপসহীনতার নাম খালেদা জিয়া: যন্ত্রণার বিনিময়ে গণতন্ত্রের প্রাচীর

লিখেছেন জুয়েল তাজিম, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৭



ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে একাত্তরের বিভীষিকায় বন্দিত্ব, অল্প বয়সেই বিধবা হওয়া—বেগম খালেদা জিয়ার জীবনের শুরুটাই ছিল যন্ত্রণার অধ্যায়। এরপর ইতিহাস যেন তাঁকে একের পর এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

খালেদা জিয়ার মৃত্যু রাজনীতির মাঠে বিরাট শূন্যতা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৯

 
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির টালমাটাল পরিস্থিতিতে তিনি দলটির হাল ধরেন। সেনানিবাসে গড়ে উঠা দলটাকে রাজপথে বেড়ে উঠতে গৃহবধূ থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খালেদা জিয়া মরিয়া প্রমাণ করিলেন , তিনি মরেন নাই ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৩৮


বেগম খালেদা জিয়া মারা গেছেন। এই খবরে জাতি শোকাহত। কিন্তু একদল মানুষ আছে যারা উনার মৃত্যুর পরেও নিজেদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থে তার মৃত্যু নিয়ে ঘৃণ্য মিথ্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। বদনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×