গতকাল রাতে এক কলিগের সঙ্গে ফোনে আলাপ হচ্ছিল। আমরা দুজনেই ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে একই রুম শেয়ার করি। আমার কলিগ আর আমি দুজনেই প্রায় সম মনমানসিকতার। ওনার পড়াশোনা কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে। পড়াতেন নিউইয়র্কের এক ইউনিভার্সিটিতে। কি এক সমস্যায় ট্রাম্পের আমলে উনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এসে ইস্ট ওয়েস্টে চাকরি নেন। আমার কলিগ আর আমার , দুজনেরই প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশ হচ্ছে এই বইমেলা উপলক্ষ করে।
যা হোক, ফোনে ফর্মাল আলাপ শেষে আড্ডা শুরু হল। আগে রুমে বসেই আড্ডা দিতাম, এখন তো করোনায় অনলাইন ক্লাসের কারনে সামনা সামনি দেখা সাক্ষাতের সুযোগ নেই বললেই চলে। স্যার কথায় কথায় বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স ক্লাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত স্যারের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডার কথা। স্যারের মতে, যদিও ঢাবির টিচার্স লাউঞ্জ, বা টিচার্স ক্লাব দেশ সেরা গবেষক - বুদ্ধিজীবীদের আড্ডাখানা হওয়া উচিৎ, কিন্তু সেখানেও আড্ডা হয় চায়ের টং দোকানের মতো করেই। স্যার রিসেন্ট একখানা কাজ করেছেন আরনেস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাগুলিতে মডার্নিজমের কি কি অনুষঙ্গ ও উপাদান আছে, তা নিয়ে। আইন অনুষদের এক শিক্ষক নাকি হেমিংওয়ের ওপর ক্রমাগত তার লেম্যান মতামত দিয়ে দিয়ে আমার কলিগকে পুরো তিতিবিরক্ত করে ছেড়েছেন।
আমার কলিগের ভাষ্যমতে, যে যে বিষয়ে স্পেশালাইজড, সে সে বিষয়ে কথা বলবে, বাকিরা শুনবে, বোঝায় সমস্যা হলে প্রশ্ন করবে। কিন্তু নিজের আনাড়ি আন্ডারস্ট্যান্ডিং নিয়ে সবাই সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দেয়ার চেষ্টা করলে আর টং দোকানের সঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় গবেষক - বুদ্ধিজীবীদের আড্ডার তফাৎ থাকে কই? টং দোকানে লম্বা সময় ধরে আড্ডা দিতে অভ্যস্ত হওয়ায়, ঢাকা ইউনিভার্সিটি টিচার্স ক্লাবের আড্ডার সঙ্গে টং দোকানের আড্ডার তুলনা করে টিচার্স লাউঞ্জের মানহানীতে আমি খুব একটা কষ্ট পেলাম না। বরং খুশি হলাম টং দোকানের সম্মান বৃদ্ধিতে।
যাহোক, আমার এ লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় হল ২০২২ সালের প্রেক্ষিতে ব্লগে আমরা কি ধরনের লেখা, বা আলাপ চাই। এ নিয়ে কয়েকটা লেখা গত একসপ্তাহে পড়লাম। কারো মতে ব্লগ পাণ্ডিত্য দেখানোর জায়গা না, ক্যাচাল করার জায়গা না, নিজের ধ্যানধারনা নিজের মতো করে শেয়ার করার জায়গা। কারো কাছে ব্লগ ধর্ম প্রচারের জায়গা। কারো কাছে ব্লগ নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের জায়গা। কারো কাছে ব্লগ নিজের অন্যান্য আদর্শিক অবস্থান নিয়ে লেখালিখির জায়গা। কারো কাছে ব্লগ দু'দণ্ড জিরিয়ে নেয়ার ফুসরত।
ব্লগ আসলে কি?
ব্লগ উপরের প্যারাগ্রাফে যা কিছু বলা হল - এসব কিছু, এবং এসবকিছুর বাইরেও আরও অনেককিছু। এমন অনেক কিছু যা উপরের আলোচনায় আসে নি, হয়তো আমাদের ধারণাতেও নেই।
ব্লগে কি করা সম্ভব কি করা সম্ভব না, অথবা কি করা উচিৎ বা উচিৎ না - এটা নিয়ে চূড়ান্ত মতামত দেয়া মুশকিল। ভালো হচ্ছে ব্লগ এমন এমন এমন হতে হবে - এরকম ফর্দ তৈরি করে একটা আঁটসাঁট বাধনের মধ্যে কলমকে আটকে না ফেলা।
যাদের কাছে ব্লগ নিজে যা বুঝি সেটাই টং দোকানের আড্ডার মতো করে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার জায়গা, তবে তার কাছে ব্লগ সেটাই। অন্য কারো অধিকার নেই তার টেস্টকে জাজ করার। তাকে দাওয়াত দেয়া যেতে পারে যে ভাই সময় সুযোগ হলে কিছু পড়াশোনা করেন, রাজনীতি - অর্থনীতি - ধর্ম বা দর্শন ইত্যাদি যেকোনো বিষয়ে চর্বিত চর্বণ না করে কিছুটা পড়াশোনা করে, ইউটিউবে দু'একটা লেকচার শুনে বা ডকুমেন্টারি দেখে নিজের আপডেটেড আইডিয়া শেয়ার করেন। কিন্তু কেউ যদি সেটা না করতে চায়, আমার আপনার অধিকার নাই এ কারনে তাকে হেয় করার।
একই সঙ্গে কেউ যদি পড়াশোনা করে জনসাধারনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর এক বা দুই স্টেপ আগানো চিন্তাভাবনা শেয়ার করে, তাকে ব্লগে পণ্ডিতি ফলাচ্ছে বলে হেয় করাও যৌক্তিক না। যদি আপনার মনে হয়, এধরনের লেখা পড়লে আপনার কিছু উপকার হবে, সে উপকারটুকু গ্রহণ করেন। যদি উপকার হয়, আর আপনার মনে হয় যে আপনার কৃতজ্ঞতাটুকু ভাগ করে নেয়া উচিৎ, একটা মন্তব্য করেন। যদি লেখা ভালো না লাগে, এড়িয়ে যান।
সত্য তো এই যে, বেশী পড়াশোনা করা, বা কোনকিছু ভেতরে ঢুকে তলিয়ে বুঝতে চাওয়াটা এই অনলাইন যুগের চরিত্র নয় আর। যারা এই যুগবিরোধী কাজ করছে, তারা মোটামুটি বোকা, এবং একা। এই একাকীত্বের যন্ত্রণাতেই, বা নিজের মতো আন্ডারস্ট্যান্ডিংওয়ালা আড্ডাবাজের অভাবেই অনেকে রিঅ্যাক্ট করে বসে নেতিবাচকভাবে। পারলে এদেরও ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখি।
সর্বোপরি লিখতে পড়তে পারাটা শিক্ষিত হওয়ার সবচে দৃশ্যমান নিদর্শন। এই ব্লগে যেহেতু আমরা লিখে নিজেদের চিন্তাভাবনা শেয়ার করি, আমার মতে, সে হিসেবে ব্লগ একটা ইন্টেলেকচুয়াল প্লাটফর্ম। আমরা আমাদের চিন্তাভাবনাগুলি ক্রিটিকালি শেয়ার করি, তার উপর ক্রিটিকাল অব্জারভেশন - কাটাছেড়া - মন্তব্য আশা করি। এরকম হলে ব্লগিং করে এই অডিও ভিজুয়াল মিডিয়ার রমরমা যুগেও কিছু কিছু উপকার পাওয়া সম্ভব। যদি ব্লগিংকে কেবল আড্ডা মারার জায়গা হিসেবে গন্য করা হয়, তবে অবশ্যই একদিন ব্লগ বন্ধ করে দিতে হবে আড্ডাবাজের অভাবে। কারন সমমনা আড্ডাবাজ খোঁজার প্লাটফর্ম হিসেবে ফেসবুকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্লগ কোনদিন পেরে উঠবে না। ব্লগকে কেবলি আড্ডামারার প্লাটফর্ম হিসেবে যারা বিবেচনা করি, আমরা যেন এটাও বিবেচনায় রাখি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ১১:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




