somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ একশো এক রাতের গল্প ~ শাহীন আখতার আপার নতুন উপন্যাস

০৮ ই মে, ২০২২ রাত ৮:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ একশো এক রাতের গল্প ~ শাহীন আখতার আপার নতুন উপন্যাস
.
১।
গতকাল রাতে পড়ে শেষ করলাম শাহীন আখতার আপার নতুন উপন্যাস - "একশো এক রাতের গল্প" -'র 'প্রথম আলো ঈদসংখ্যা' ভার্শন। মূল উপন্যাসের এক তৃতীয়াংশ আছে এতে। অ্যারাবিয়ান নাইটস / আরব্য রজনীর দ্যোতনাবাহী নামের এ উপন্যাস শাহীন আখতার আপার লেখাপত্রের অনুরাগীদের ৪ বছরের অপেক্ষার পর পাওয়া উপহার। আমিও তার অনুরাগী পাঠকদের একজন। আমার পঠনে এ লেখাটির যে ঝোঁকগুলো ধরা পড়েছে, তার কিছু কিছু এ পাঠ প্রতিক্রিয়ায় শেয়ার করে নিচ্ছি।
.
প্রথম আলোয় প্রকাশিত উপন্যাসটি, 'মে ফ্লাওয়ার' রেস্তোরায় এক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী ইসলামিস্ট গ্রুপের আক্রমন, এবং আত্মঘাতি হামলার প্রেক্ষাপটে রচিত। রেস্টুরেন্টে আত্মঘাতি হামলা হয়ে যায়, সামরিক বাহিনীর আক্রমনে সন্ত্রাসীরাও মারা পড়ে। তারপর, চারটি ন্যারেটিভে, চারজন ভিন্ন ভিন্ন মানুষের বয়ানে উঠে আসে এ দুর্যোগের প্রাককথন। কে, কখন, কীভাবে ঘটিয়ে ফেলল এতোকিছু, আস্তে আস্তে পাঠকের কাছে খোলাসা হতে থাকে তা। এ চার কথকের প্রথমজন 'সাফা মরিয়ম জামাল' - মে ফ্লাওয়ার রেস্তোরাঁয় আত্মঘাতি হামলায় জড়িত এবং নিহত জঙ্গিদের দলনেতা 'শাহরিয়ার অপু জামাল' -এর আপন বোন। দ্বিতীয়জন, 'দিলরুবা মেহবুবা' - শাহরিয়ারের প্রাক্তন গার্লফ্রেন্ড। তৃতীয় কথক, শাহরিয়ারের মা 'সাবেরা বেগম'। সর্বশেষ, এবং আমার পঠনে সবচে ইন্টারেস্টিং যিনি, 'শফি মুহম্মদ' - যার পদার্থবিজ্ঞানের প্রাইভেট পড়ুয়া ছাত্র 'জাভেদ মুর্তজা' রেস্তোরায় সংঘটিত আত্মঘাতি সন্ত্রাসি হামলার কুশিলবদের আর একজন।
.
উপন্যাসটিতে একজন ইসলামিস্ট এক্সট্রিমিস্টের সাইকোলজি, তার গড়ে ওঠার - বেড়ে ওঠার পথ, তাদের আত্মহননের (বা, তাদের মতে শাহাদতের) পথ বেছে নেয়ার পর যে প্রভাব তাদের পরিবারের সদস্যদের উপর পড়ে, যে ভয়াবহ কষ্ট জর্জর জীবনের মধ্য দিয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের যাওয়া লাগে, তা তাদের পরিবারের লোকজনদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণনা করা হয়েছে। এই উপন্যাসে অঙ্কিত প্রতিটি চরিত্রই আহত, সবাই ই রক্তাক্ত। কারো তাজা খুন রেস্টুরেন্টের টেবিলে রাখা হোয়াইট সস পাস্তার ওপর লাল টোম্যাটো সসের মতো ভাসমান, কারো খুন অদৃশ্য স্রোতে প্রবাহিত হয়ে চলেছে তাদের হঠাৎ স্থবির জীবনের ওপর দিয়ে।
.
২।
পুরো উপন্যাস যেহেতু প্রথম আলোর এ ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয় নি, কাজেই উপন্যাসের উপর সামগ্রিক মন্তব্য করার বদলে সন্ত্রাসবাদী শাহরিয়ার অপু জামাল সহ যে চারটি মানুষের বয়ানে উপন্যাসের গল্প এগোয়, তাদের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে কিছু আলাপ শুরুতে করে নেয়া যাক।
.
শাহরিয়ার অপু জামাল, 'মে ফ্লাওয়ার' রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার অন্যতম কুশিলব। রেস্তোরাঁয় তাদের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবার পর যে সামরিক অভিযান চালানো হয়, তাতে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়ে সে। তার পার্থিব লেনদেনের পালা সাঙ্গ হলেও তার কর্মকাণ্ডের জের কঠিনভাবে বহন করতে হয় তার পরিবারের ঘনিষ্ঠতম তিন সদস্য, এবং তার প্রাক্তন গার্লফ্রেন্ড - এ চারজন মানুষকে। তার বাবা এ দুর্ঘটনার তীব্রতা সইতে না পেরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। তার মা সাবেরা বেগমও নানা অসুস্থতায় জর্জরিত মুমূর্ষু এক মানুষ, বেঁচে থাকেন অর্ধমৃত, অর্ধ উন্মত্ত হয়ে, প্রতিটি মুহূর্তে মৃত সন্তানের স্মৃতি হাতড়ে বেরিয়ে। তার বোন সাফাকে ছাঁটাই করে দেয়া হয় চাকরি থেকে। নেকাবের আড়ালে মুখ ঢেকে তার দিনের পর দিন কেটে যায় মর্গের দেয়ালের ঐপাশে। অন্যান্য নিহত জঙ্গিদের মৃতদেহ তাদের ঘনিষ্ঠজনেরা নিতে অস্বীকার করলেও বোন সাফা মেনে নিতে পারে না তার নৃশংস হন্তারক ভাইয়ের মরদেহের এ অবস্থা। যে সমস্ত নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে তার ভাই, তাদের পরিবারের তরফ থেকে ঘৃণা ব্যতিরেকে কোন সহানুভূতি পাওয়া সাফার পক্ষে সম্ভব না। পুরো সমাজও ঘৃণা - বিবমিষার চোখে তাকায় তার, তার পরিবার, জঙ্গি শাহরিয়ারের মৃতদেহের দিকে। সাফা লড়তে থাকে একাই। দিলরুবা মেহবুবা, শাহরিয়ারের এক্স গার্লফ্রেন্ড, যাকে "জোঁকের মতো ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে " শাহরিয়ার, সে পরিচয়টুকুও দিলরুবাকে তাড়া করে ফেরে যে ইউনিভার্সিটিতে সে শিক্ষকতা করে, সে ইউনিভার্সিটির কলিগ - স্টুডেন্ট সবার মাঝে।
.
সাফা, নিহত জঙ্গি শাহরিয়ারের বোনের আলাপে আবার ফেরত আসি। এই চরিত্রটি, বা তাদের মা সাবেরা বেগমের চরিত্রটিকে ঔপন্যাসিক তৈরি করেছেন মানুষের স্বাভাবিক মায়া মমতার আদলে। বা, স্যাক্সিস্ট যদি শোনায়ও খানিকটা, তবুও, ঝুঁকি নিয়ে বলা চলে যে - নারী, তথা মায়ের পুত্রের প্রতি, বোনের ভাইয়ের প্রতি সহজাত যে মমতা, যেটা দূর করা আদৌ সম্ভব হয় না কখনো, সেই মমতায় প্রবলভাবে স্নাত হয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় ব্যক্তিগত জীবনে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত সাফা, বা তার মা। আমাদের মতো এই জঙ্গি হামলার সাধারন দর্শক যারা, আমাদের জন্যে তাদের পরিবারের সদস্য এই মৃত জঙ্গির প্রতি ভালোবাসা মূক বানিয়ে দেয়। আমরা বুঝে উঠতে পারি না তাদের এই সহজাত অনুভূতির প্রতি আমরা সমর্থনজ্ঞাপন করবো, নাকি ঘৃণা করবো তাদেরও। তা আমরা যেদিকেই ঝুঁকি, বোঝা যায় - সাফা, কিংবা সাবেরার নিজেদের রক্তজের প্রতি সহজাত সে আবেগ, তা আমাদের সমর্থন, বা ঘৃণার মুখাপেক্ষী নয়। তা বয়ে যাবে নিজের গতিতে।
.
সাফা, আর শাহরিয়ারের সম্পর্ক যেভাবে এগিয়েছে, সেদিকে তাকাই। পাসপোর্ট সাথে করে তার ভাই যখন দেশ ছাড়া হয়, সাফার মনে এ আকাঙ্ক্ষা হয় নি কখনো যে তার ভাই 'দিগবিজয়ী হয়ে ফিরে আসুক। যেখানেই থাকুক, স্রেফ বেঁচে থাকুক, এটুকুই ছিল ওর কামনা। ভাইকে খুশী করার জন্যে ভাই নিরুদ্দেশ হবার কিছুদিন আগে হিজাব পরা শুরু করেছিল সে। ভাই নিখোঁজ হবার পরেও আর সে হিজাব ছাড়ে নি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে নয়, বরং 'নিখোঁজ ভাইয়ের সত্তার অবিভাজ্য অংশ' হিসেবে এই কাপড়ের টুকরোটুকু বহন করে চলে সে।
.
রেস্টুরেন্টে হামলার খবর যখন টেলিভিশনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে, সঙ্গে ভেসে ওঠে ওর ভাইয়ের ছবি, প্রচারিত হয় সামরিক বাহিনীর সম্ভাব্য অভিযানের কথা, সাফার মন তখনও হন্তারক ভাইয়ের প্রাণরক্ষার কামনায় ন্যস্ত থাকে -
.
'জঙ্গিরা যে মৃত, তখনও খবরটা সাফার অজানা। ... কৌতূহলী চোখে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে ক্ষুদ্র একটা দলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিশাল আয়োজন বাড়াবাড়ি নয় কি? নাকি আসলেই ভয়ানক কিছু?'
.
ঘটনা তারপর গড়িয়ে চলে নিজের গতিতে। শাহরিয়ারের নিহত হবার খবর আসে। ওদের বাবাও মারা যায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। তাদের নিবাস, তাদের থাকার জন্যে অনিরাপদ হয়ে ওঠে -
.
'বাসার উল্টা দিকের বহুতল ভবনের প্রতিটা জানালা যেন একেকটা রক্তচক্ষু, ওর দিকে আগুনঝরা চোখে তাকিয়ে আছে। রাগ না, ঘৃণা এসবে। তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ায় সাফা। তুমি একাই বিখ্যাত হও নাই ভাই, আমাদের বিখ্যাত বানাইস। দেশের প্রতিটা কাগজে আমাদের নাম উঠে গেছে। ওরা দয়া করে যে ছবি ছাপায় নাই, তাই রক্ষা। কিন্তু শেষরক্ষা হল কই? ... এখন আমার আর হিজাবে কুলাবে না। তোমার সঙ্গে আমাদের হঠাৎ হওয়া বিখ্যাত পরিচয়টা লুকাতে দরকার চোখের কাছে নেট লাগানো দুই ছিদ্রবিশিষ্ট কালো লম্বা বোরকা ...'
.
ছেলে মা সাবেরা বেগমকে বলত -
.
'কেন আম্মা পর্দা করেন না, নামাজ কাজা করেন, পার্টি করেন।’
পার্টি! সাবেরা বেগম তো আকাশ থেকে পড়েন। বান্ধবীরা মিলে আড্ডা দেওয়া, ব্রিজ খেলা পার্টি? দুদিনের পোলা না, নাক টিপলে দুধ গড়ায়, তাস খেলারে কয় পার্টি!
...
.
এ বড় অন্যায় - তখন ভাবতো সাফা। মা তো নিজের জন্য কখনো কিছু করেন নি। এখন ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। বাসায় সময় কাটতে চায় না। তাই ব্রিজ খেলায় নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। কখনো বা সাফা মরিয়ম মায়ের পক্ষ নিয়ে শাসাত শাহরিয়ারকে - তোমার এতো অহংকার কেন, অপু! আল্লাহর রাস্তায় গেছ বলে দম্ভ করতে হবে? আল্লাহ তাআলা অহংকারীকে পছন্দ করেন না।'
.
প্রায় শূন্য বাসায় বসে সাফা ভাবে, 'এসব কথা মাত্র কমাস আগে এ বাড়িতেই হয়েছে। আজ কে কোথায়!'
.
পরে, সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পরে, আমরা সাফাকে আবিষ্কার করি মর্গে -
.
'হে আল্লাহ! আসমানে ওর রুহের প্রবেশের দ্বার খুলে দিন।’ জানাজার দয়া পড়তে পড়তে হাস্পাতালের মর্গের পেছনের সাদা মলিন কিনারা ধরে হাঁটে সাফা মরিয়ম জামাল। যদিও তার ভাইয়ের লাশ এখনো মর্গের ষ্টীলের দেরাজে, সাফা আপনমনে প্রার্থনা করে আর হাঁটে। ক্লান্তিতে পা ভেঙ্গে আসে, তবু হাঁটার বিরাম নেই ওর।'
.
সাফার এই অনুভূতির সঙ্গে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমরা আমাদের আবেগকে একত্রিত করতে পারি না। আমাদের দ্বিধা হয়। সাফার অবস্থানটা এমনই এক অবস্থান, ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নেও নিজেকে তার জায়গায় প্রতিস্থাপিত করে তার কষ্ট বুঝতে সাহস হয় না আমাদের। অবাক বিস্ময়ে আমরা তাকিয়ে থাকি এই মেয়েটির দিকে। তার একাকি কষ্টের দিকে -
.
'কদিন আগেই পুলিশ বলল, স্বজনের কাছে লাশ হস্তান্তর করবে। এখন বলছে স্বজনেরা এমন সন্তানের দায় নিতে চায় না। অন্যত্র তাদের বলতে শোনা যায় যারা জঙ্গিদের লাশ চাইবে, তাদেরকেও নজরদারির আওতায় আনা হবে।'
.
তবুও সাফা তার মৃত জঙ্গি ভাইয়ের মৃতদেহ চায়, কারন, সাফা ভাবে -
.
'মৃতদেহের প্রতিও রাষ্ট্রের প্রতিশোধপরায়ণ হবার কোন কারণ দেখি না। কারণ, মর্গের দেরাজে অপরাধীর প্রাণহীন দেহের খাঁচাটাই শুধু পড়ে রয়েছে। আমরা হলফ করে বলছি, আমরা তাদের বিপথগামী আত্মার সহযোগী নই। দোসর নই। কিন্তু মর্গে পড়ে থাকা দেহগুলোর সঙ্গে আমাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। যার জন্যে তাদের শনাক্ত করতে আমাদের চুল ও রক্তের নমুনা আপনাদের প্রয়োজন হয়েছে এবং আপনারা তা সংগ্রহ করেছেন। আমরা সেই প্রাণহীন দেহগুলোই শুধু চাই, যা মর্গের দেরাজ দখল করে আছে, আর নির্দোষ মায়েদের দোজখের আগুনে পোড়াচ্ছে।'
.
নিহত বাদবাকি জঙ্গিদের স্বজনদের একে একে খুঁজে বের করে সাফা। তাদের সঙ্গে আলাপ করে ওদের মৃতদেহ ফিরে পাবার সম্ভাবনা নিয়ে। মনে মনে 'লাশ চেয়ে আবেদনপত্র' লেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। ফিরতে হয় খালিহাতেই, প্রতিবার, প্রতিটি দরজা থেকে।
.
শাহরিয়ারের মৃতদেহ ছাড়া একেকটা দিন বাড়ি ফেরে সাফা, আর প্রতিবার দরজা খুলে দেয়ার পর মা সাবেরা বেগম সাফার পিছে ফিরে ফিরে চায়, যেন ওর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে তার পেটের সন্তান -
.
'বোন বাথরুম থেকে শ্যাম্পু ফুরিয়ে গেছে বলে হাঁক দিলে যে পড়িমরি করে ছুটত পাড়ার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। বাথরুমে বসে থেকে বোনের যাতে ঠাণ্ডা না লাগে, শ্যাম্পু কিনে হাঁপাতে হাঁপাতে আরেক দৌড়ে ফিরত বাসায়।
মৃত্যুতে কি সে ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে?'
.
তবুও সাফা মরিয়ম জামালের ভালোবাসার শেষ নাই রক্তজের প্রতি। অ্যান্টিগনির মতো, রাজাজ্ঞা লঙ্ঘন করেই ভাইকে কবর দিতে চায় সে।
.
৩।
নিহত জঙ্গি শাহরিয়ারের মা সাবেরা বেগমের দিকে নজর ফেরানো যাক।
ছেলে খুন করে নিজে নিহত হয়েছে, স্বামী মারা গেছে ঘটনার শোকে, আঘাতে। মেয়ে পাগলের মতো ভাইয়ের লাশ খুঁজে ফিরছে মর্গে। মা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তার কক্ষ, তার স্পর্শে ছেলের অদৃশ্য স্মৃতির চাদর -
.
'ছেলে নাই তো পুরাদস্তর নাই -ই। ওর এক - আধখানা ছবিও নেই এ বাড়িতে, বা পোশাক আশাক জাতীয় কিছু। সবই সাবেরা বেগমের হাতের নাগাল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তার আগে বাসার দেয়াল থেকে ছবি নামানোর কাজটা শাহরিয়ার অপু জামাল নিজেই করে গেছে। ... এখন একটা হালকা মলিন চারকোনা দাগ শূন্য দেয়ালে ঝুলে রয়েছে। ছবি না থাকলে কি , মন থেকে তো ছেলেকে মুছে ফেলা যাবে না! দিনে দিনে উজ্জলতর হচ্ছে যেন সে। তবে তার চোখের সামনে হাজির হচ্ছে ছেলের সেই বয়সের ছবি, যে বয়সে সে গিটার বাজাতে বাজাতে মাথা ঝাঁকিয়ে কপাল থেকে চুল সরাত। মা - বাবার কথা শুনত না। ক্লাস কামাই দিতো। লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকত। হাত পায়ের নখ কাটতো না। ঘুমাতে যেত গভীর রাতে। ক্লাস না থাকলে বিছানায় গড়াতো দুপুর পর্যন্ত। তখন সাবেরা বেগমের মনে ছেলেকে নিয়ে কতো বিরক্তি, কতো অশান্তি, কতো অভিযোগ! অথচ তখনই সে তার ছেলে ছিল। একান্তই তার। আপন। তখনও পর হয়ে যায় নি। সবচেয়ে বড় কথা, তখন ছেলের কাছে মানুষের জীবনের দাম ছিল। নিজের জীবনের দাম ছিল। কখন সে মানুষ মারতে শিখল আর নিজের মৃত্যুর পথ খুঁজে নিলো? আত্মদানকারী ফিদাই হয়ে গেলো!
মৃত্যুই বুঝি ওকে নির্বাচন করেছে। আর ঘর থেকে টেনে নিয়ে গেছে।'
.
সমাজের কারো কাছ থেকে কোন রকমের সহানুভূতি পাওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই, কেউ তার এই পুত্র হারানো, স্বামী হারানোর বেদনার সঙ্গে একাত্মতা বোধ করবে না, জানেন তিনি -
.
'সবার মুখে ছিছি। ধিক্কার। অবশ্য সেসব বেশিক্ষন শোনার, বা মনে রাখার অবস্থান ছিলেন না সাবেরা বেগম। তিনি তখন মশগুল অন্য ভাবনায় - ছেলে তো বিদায় নিয়ে যায় নি। সে তার বিশ্বাসে কনভার্ট করতে চেয়েছিল, যাতে পরিবারের সবাই বেহেশতে ফের মিলতে পারে। অথবা আবার ফিরে আসবে বলে মাকে আলবিদা জানায় নি ছেলে।'
.
তার বিহ্বল চিত্তে প্রশ্ন -
.
'শাহরিয়ারের মৃত্যু কবে হয়েছে?
যেদিন জঙ্গিখাতায় নাম লিখিয়েছে।
যেদিন বাড়ি ছেড়েছে।
যেদিন তার মৃত্যুর সংবাদ এসেছে।
ছেলের মৃত্যুর অসংখ্য সন - তারিখের মাঝখানে খাবি খান তিনি।'
.
পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের একদম শেষ ছত্রেও সাবেরা বেগমের চিন্তার অনুরণন। ছেলে দুনিয়ার সবার চোখে হিংস্র, সন্ত্রাসবাদী। দুনিয়াতে কেউ তাকে মনে রাখবে না, স্মরণ করবে না - ঘৃণা ছাড়া। এমনকি, তার লাশ পাওয়ারও আর কোন সম্ভাবনা আছে বলে তিনি মনে করেন না। জঙ্গি পুত্রের মা, তার বিহ্বল মাতৃত্বের অকথ্য বেদনায় কামনা করেন, ছেলে যেই বেহেশতের আশায় পৃথিবীতে প্রলয় ডেকে আনল, সেই বেহেশতের দেখা যেন ও পায় -

'ছেলে শহিদী দরওয়াজা পাবে, সরাসরি বেহেশতে যাবে - এখন এ ভাবনাতেই বুঁদ হয়ে আছেন সাবেরা বেগম। লাশ কবরস্থ করা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। শুধু চান যে ছেলে চিরতারুণ্য নিয়ে বেহেশতের বাগানে ঘুরে বেড়াক। বেঁচে থাকতে খুব বিক্ষুব্ধ ছিল ওর মনটা।'

.
৪।
দিলরুবা মাহবুব, নিহত জঙ্গি শাহরিয়ারের প্রাক্তন প্রেমিকা, আমরা তাকে আবিষ্কার করি বহুমুখী ডিলেমায় আক্রান্ত অবস্থায়। প্রাক্তন প্রেমিক যে নিহত জঙ্গিদের সর্দার হওয়াটা যদি যথেষ্ট না হয়, তবে শাহরিয়ারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের পর সে 'বিভোর হয়ে স্বপ্ন দেখছে' যে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির ভদ্রলোকের, তাকে ঘিরে যখন জঙ্গিদের মূল ট্রেইনার, বয়েতদাতা - হবার রটনা শুরু হয়, তা দিলরুবার জন্যে কাজ করে একদম মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।
.
দিলরুবার চরিত্রটি এ জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ যে, দিলরুবার মাধ্যমেই আমরা জঙ্গি হয়ে ওঠার আগে শাহরিয়ারের অতীত, শাহরিয়ারের সামাজিক জীবনের ব্যাপারে জানতে পারি। যেমন, দিলরুবার নিজের এই পুরনো দগদগে ঘায়ের মতো সম্পর্ককে অ্যাসেস করতে গিয়ে চিন্তা করে -
.
"ও কি পেয়েছিল এ ছেলেটিতে? খেলাধুলা - গানবাজনা করে, আবার নামাজ কাজা করে না, সহি কুরআন পাঠেও তুখোড়? ... শাহরিয়ার ছিল অতিশয় দয়ালু আর হৃদয়বান। প্রেমে প্রতারিত হয়ে দিলরুবা যখন ধরাশায়ী, তখন জান বাচানেওয়ালা ওঝার মতো ওর আবির্ভাব। গত তিন বছরে দিলরুবার অতীত টেনে অপমান করে নি, গালি দেয় নি, বা গায়ে হাত তোলে নি।'

এরকম এক হৃদয়বান পুরুষ, দিলরুবা কোনোভাবেই হিসাব মিলাতে পারে না, কেমন করে ‘যারা বীভৎসভাবে মানুষ খুন করে বাজারে ভিডিও ছাড়ে' তাদের দলে গিয়ে ভেড়ে।
.
শুধু শাহরিয়ারই তো নয়, চমকের উপরে চমক দেয় তার নতুন স্বপ্নপুরুষও, যখন দিলরুবা আবিষ্কার করে যে- 'শাহরিয়ারদের ওস্তাদ হেয়ারজেলে চুবচুবা চুলের সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি!'
.
ফলশ্রুতিতে আবারো স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পোড়ে দিলরুবা।
.
এদিকে সদ্য নিহত জঙ্গির সঙ্গে দিলরুবার একদা প্রেমের সম্পর্কের কারনে, একদিকে ইউনিভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায় কলিগদের কানাঘুষা, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মুখরোচক আড্ডার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় সে -
.
'রুমের দরজা খুলতেই দেখে ছোট ছোট একঝাঁক হিজাব পরা মেয়ে কলকলিয়ে বারান্দা দিয়ে হেঁটে চলে যায়। ... কখনো বাতাসে কান পাতলে শুনতে পায় করিডোরে ফিসফাঁস - দিলরুবা ম্যাম চুল ঢাকে না, দ্যাখ দ্যাখ, কেমন বেপর্দা চলে! ... খ্যাতিমান জঙ্গির গার্লফ্রেন্ড, তার মাথার চুল উদাম কেন?'
.
৫।
উপন্যাসটির অন্যতম ইন্টারেস্টিং চরিত্র শফি মোহাম্মদ। ১৬ বছরের কিশোর জাভেদ মুর্তজা, ওরফে আবু জান্দাল আল বাঙালি তার প্রাইভেটের প্রাক্তন ছাত্র। বাসায় গিয়ে ওকে ফিজিক্স পড়ানোর সময় শফিকে মুখোমুখি হয় অনাকাঙ্ক্ষিত সব অভিজ্ঞতার। স্যার, বা ভাইয়া বলার বদলে তার ছাত্র তাকে ডাকে হুজুর বলে। তার এ কিশোর ছাত্র, যে কিনা একদিন ফিদাই দলের সদস্য হয়ে হাসিমুখে জান কোরবান করে দেবে, ফিজিক্সের পাঠের সঙ্গে একের পর এক অপ্রাসঙ্গিক সব প্রশ্নের জেরে জেরবার করে দেয় শফির জীবন -
.
'হুজুর, ক্রুসেডাররা মুসলিম দুনিয়া ফানা করে দিতাছে। মশামাছির মতো মানুষ মারতেছে। ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান - চোখে দেখেন না! ছাত্র পড়ানো ক্ষান্ত দিয়া ইরাকে যান। সিরিয়ায় যান। জিহাদি ভাইদের লগে সিনা মিলান গিয়ে।'
.
এই ছাত্রকে পড়ানোর সূত্রেই শফি জোগাড় করে জিহাদ, ক্রুসেড আর অ্যাসাসিনদের ইতিহাস। এর ফলশ্রুতিতে শফির ওপর শমন জারি হয় দুই দিক থেকে। পলাতক জিহাদি ছাত্র তাকে জঙ্গে যুক্ত হতে অথবা মৃত্যু বেছে নিতে শমন দেয়। উপন্যাসের পাতা থেকে আমরা জানতে পারি -
.
'শফি নাস্তিক ব্লগার নয়। আবার ধর্মযোদ্ধাও নয়। সে খুনখারাবি পছন্দ করে না। তার মতো লোক কারো টার্গেট হওয়ার কথা না। তবু সে হয়ে গেছে। ছাত্রকে বাসা না চেনালে মৃত্যু পরোয়ানার মতো মারাত্মক চিরকুট কখনোই তার খাটের চিপায় উড়ে পড়তো না। এখন তার মৃত্যুদণ্ড জারি হয়ে গেছে। তা মওকুফ হবে এক শর্তে - যত দিন না ফেতনার অবসান ঘটে এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়, ততদিন তাকে জঙ্গ - জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে।'
.
অপরদিকে, পলাতক ছাত্রের বাবা মা সন্দেহ করে, শফির সংস্পর্শেই তাদের ছেলে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। শফির বাসাভর্তি এ সংক্রান্ত বইপত্র, কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক ভর্তি এ সংক্রান্ত এন্তার লেখাপত্র। পুলিশ একবার রেইড দিলে তার বাঁচার উপায় নাই। আবার পুলিশের হাত থেকে বাঁচলেও, বাঁচার উপায় নাই তার ছাত্রের হাত থেকেও। দ্বিমুখী চাপে তার মাথা খানিকটা ক্র্যাকই হয়ে যায়। আরব্য রজনীর উজির কন্যা শেহেরজাদের মতো, নিজের গর্দান রক্ষা করার নিমিত্তে স্টুডেন্টকে সে অতীত জিহাদ - ক্রুসেড আর অ্যাসাসিনদের গল্প শোনাত ইতিহাসের পাতা থেকে। ছাত্রের নিহত হবার পর তার সে গল্পের শ্রোতা হয় তার কলেজ লাইফের পরিচিত দিলরুবা। সামনা সামনি, বা দুরালাপনিতে তাকেও ফিদাইদের ইতিহাস শোনাতে থাকে শফি। আর যখন তাদের কেউই উপস্থিত থাকে না, শফি একাকী বসে জানালা খুলে অন্ধকারের সঙ্গে ফিসফাস আলাপ চালায় এ সমস্ত ইতিহাস নিয়ে।
.
শফির মুখ থেকেই আমরা জানতে পারি উত্তর ইরানের পার্বত্য দুর্গ আলমুতে বসে একাদশ শতকে সুন্নি - সেলজুক সাম্রাজ্যে ত্রাস ছড়িয়ে বেড়ানো জগৎবিখ্যাত শিয়া অ্যাসাসিন, আত্মঘাতি - ইংগিমাসিদের আদিগুরু, হাসান ই সাব্বাহের কেচ্ছা। এই ফিদাইরা হাশিস সেবন করে আত্মঘাতি মিশনে যেতো বলে তাদের হাশাসিন বলা হত, এবং সেখান থেকেই এই অ্যাসাসিন শব্দের উৎপত্তি। তাদের আলাপ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, কারণ মে ফ্লাওয়ার রেস্তোরাঁয় যারা আক্রমন চালিয়েছিল, তারাও নেশা করে আক্রমনে নেমেছিল কিনা, সেটা খুঁজবার জন্যে তাদের রক্ত ও চুলের নমুনা বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। আরও জানা যায় এগারো শতক থেকে পবিত্র ভূমি জেরুজালেমে বেজে ওঠা ক্রুসেডের গল্প।
.
শফির মুখে বাইজেন্টাইন রাজকুমারি অ্যানা কমনিনার বই আলেক্সিয়াড থেকে জানা যায়, পবিত্র যুদ্ধের নামে ক্রুশ ধারন করে পোপের আশীর্বাদ নিয়ে খৃষ্টান ক্রুসেডারদের হাঙ্গেরি, ইতিয়ালি হয়ে জলপথে এজিয়ান সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কন্সত্যান্টিনোপোল ট্রানজিটে আসার কেচ্ছা। প্রথম ক্রুসেডের হিংস্রতার প্রতীক তাফুরদের গল্প। ক্রুসেডারদের বিখ্যাত নেতা, ফরাসি সন্ত পিটার দা হারমিট, এবং পিটারের এক ভক্ত, রাইনল্যান্ডের কাউন্ট এমিগোর গল্প, যে ক্রুশের শত্রু হিসেবে ইহুদীদের চিহ্নিত করে ইউরোপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইহুদী নিধনযজ্ঞ শুরু করে, যার খেসারত আজ ফিলিস্তিনিদের দেয়া লাগছে। জেরুজালেমে প্রবেশের পর যে গণহত্যা ক্রুসেডাররা শুরু করে, তা থেকে বাঁচতে কেউ কেউ পালিয়ে আশ্রয় নেয় দামেস্কের প্রধান কাজী আবু সাদ আল হারাবির দরবারে। ক্রুসেডাররা মৃতদের মাংস রেঁধে কাবাব বানিয়ে খায়। বিশ হাজার মা'আররাত বাসী নিহত হয় তাদের হাতে। আলেপ্পোর প্রধান কাজী আবু সাদ আল হারবি বাগদাদে দাঁড়িয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে হৃত পুণ্যভূমি জেরুজালেম পুনরুদ্ধারে জিহাদের জন্যে। তারই সূত্রে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবির জেরুজালেম বিজয়। এরকম আরও ছোট বড় অসংখ্য গল্পে ঔপন্যাসিক জিহাদ - ক্রুসেড - অ্যাসাসিনদের অতীত ইতিহাস প্রাসঙ্গিক করে তোলেন।
.
৬।
যেহেতু এটা পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস নয়, কাজেই এতোটুকু পাঠের জের ধরে অন্তিম কোন মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া জানানো মুশকিল। কিন্তু, বরাবরের মতোই ভালো লেগেছে শাহীন আখতার আপার ইতিহাস সংশ্লিষ্টতা, ইতিহাসের পাতা ছেনেছুঁয়ে এক অস্বস্তিকর বিষয়ে উপন্যাস লেখার প্রয়াস। এবং, তার দৃষ্টিভঙ্গির অনন্যতা আলাদা করে উল্লেখ করবার মতো বিষয়। যারা ধর্মীয় জঙ্গ লড়তে গিয়ে নিরপরাধ মানুষ মারল, পরে নিজেরাও মারা পড়লো বেঘোরে, তাদের লাশটুকুর উপর কেন প্রতিশোধস্পৃহা? - এই প্রশ্ন কয়জন উপস্থাপন করতে পারেন?

.
উপন্যাসে আমাদের সমসাময়িক কথ্য ভাষার ব্যবহার চরিত্রগুলিকে আমাদের আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলে। শফি মুহাম্মদের সঙ্গে দিলরুবার আলাপচারতাই ধরা যাক। দিলরুবার সামনে চেয়ার টেনে বসতে বসতে শফি বলে -
.
'এদিকে একটা চাকরির ইন্টারভিউ ছিল। কুড়িল ফ্লাইওভার থেকে নাইম্যা ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই।'
.
নারীদের দৃষ্টিকোন থেকেই পৃথিবী দেখার লেন্সস্থাপন, শাহীন আপার লেখনীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ উপন্যাসেও তার ব্যত্যয় ঘটে নি। উপন্যাসের মূল পার্সপেক্টিভগুলোর প্রায় সবই নারীর। টেরোরিস্ট হামলার মূল বিষয়বস্তুর আড়ালেও দেখা যায় নারী জীবনের খুঁটিনাটি উঠে এসেছে বারবার। উদাহরণত, দিলরুবার ইউনিভার্সিটির কলিগ ফারিহা ক্রমাগত যখন দিলরুবাকে তার সংসারের গল্প বলে বলে কান ঝালাপালা করে দেয়, তখন দিলরুবা ভাবে -
.
'নাক বরাবর দেয়ালে সাঁটা সহকর্মীর পারিবারিক রঙ্গিন ছবি নজরে পড়লে কেমন বিবমিষা জাগে। ওরা সংসারের বোঝাটা অফিস - ইউনিভার্সিটি সর্বত্র বয়ে বেড়ায় কেন? নাকি পুরাটাই লোক দেখানো - আমার আছে তোমার নাই!'
.
অথবা, কাতর দিলরুবা ভাবে -
.
‘দিলরুবার প্রেমিক যখন আত্মঘাতী হামলাকারী হচ্ছে, ফারিহা তখন দ্বিতীয়বারের মতো ম্যাটারনিটি লিভে যাচ্ছে।’
.
শাহীন আখতার আপার লেখনীর আরেক বৈশিষ্ট্য, পৌরাণিক কল্পকাহিনীর সঙ্গে প্যারালাল তৈরি করে করে গল্প এগুতে থাকা। এই উপন্যাসেও তার উপস্থিতি দেখি। দিলরুবা তার হৃত প্রেমের আখ্যান সমূহকে নিয়ে যখন চিন্তা করে, চিন্তা করে সাম্প্রতিক সময়ে প্রেমের ক্ষণস্থায়ীত্ব নিয়ে, তখন তার দীর্ঘশ্বাস আশ্রয় খোঁজে অতীতে, ইউসুফ নবীর সময়কালের প্রেমের ইতিহাসের, জুলেখার সঙ্গে তার অমর আখ্যানের।
.
সাধারন একটি বালক থেকে শাহরিয়ারের প্রাণঘাতী জঙ্গিতে পরিণত হবার সাইকোলজিও ঔপন্যাসিক দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলেন তার একটি ডায়রি নোটের সাহায্যে। শাহরিয়ারের ডায়রির পাতায় লেখা ছিল -
.
'আমাদের পাড়ার মসজিদে যাওয়ার পথে একটা আন্ডার কন্সট্রাকশন ভবন। অনেক দিন অসমাপ্ত পড়ে আছে। এর পিলার আর আস্তরহীন দেয়ালটা ঝোপঝাড়ের আড়ালে চলে গেছে বহুদিন। ওখানে জ্যোৎস্নালোকে গাছের ছায়ায় একটা কুকুর শুয়েছিল। শরীরটা আবছা অন্ধকারে এলিয়ে দিয়ে গলা বাড়িয়ে মাথাটা রেখেছিল ধবধবা চন্দ্রালোকে। সামান্য নড়াচড়ায় ওর চোখের মণিতে গোল চাঁদটা হীরকখণ্ডের মতো জ্বলে জ্বলে উঠছিল। আমার ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া কুকুর অর্জুন যেন। ইচ্ছা করছিল ওকে কোলে তুলে আদর করি, বাসায় নিয়ে আসি। জিহাদের রাহে জান কবুলের পর ভাঙ্গা বাড়ির সামনে দিয়ে আর মসজিদে যেতাম না। যতই তাড়া থাকুক, দু- তিন গলি ঘুরে পৌঁছাতাম আল্লাহর ঘর ইবাদতখানায়। যদি নাপাক জন্তুটার চোখে ফের আল্লাহ তালার অপূর্ব সৃষ্টি, দ্যুতিমান চাঁদ দেখতে পাই!'
.
এভাবেই, আচার আচরনে ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমেই ব্যাপক বিধ্বংসী এক সত্ত্বায় পরিণত হয় এসব কিশোর তরুণ ছেলেরা।
.
এসবকিছু ছাড়াও, উপন্যাসটির বিষয়বস্তু এবং প্লট সন্দেহাতীতভাবে অস্বস্তিকর, মরবিড। দুপুরে ভাতঘুম দেবার আগে, কিংবা রাতে ঘুমাবার পূর্ব মুহূর্তে আয়েশ করে শরীর এলিয়ে দিয়ে এই বই হাতে তুলে নিলে তা ঘুমের মাঝে সুখস্বপ্নের বদলে দুঃস্বপ্ন ডেকে আনতে পারে। কিন্তু, পাল্টা প্রশ্ন করা যেতে পারে - ঔপন্যাসিকের কাজ কি কেবলি পাঠককে আমোদিত, আনন্দিত করা? মনে হয় না। মহৎ লেখকেরা বরং পাঠককে অস্বস্তিও উপহার দেন, পলায়নপর পাঠককে দাঁড়া করিয়ে দেন নিজের মনের গহীনতম অন্ধকারের মুখোমুখি করে।
.
একই রকম গুণে গুণান্বিত এ উপন্যাস আপনাকে ভাবাবে, ভেতর থেকে কাঁপিয়ে তুলবে, কিন্তু পড়বার পর একজন সচেতন পাঠক ধর্মের নামে অসহিষ্ণুতার চর্চাকে একটি বিচ্ছিন্ন ফেনমেনা হিসেবে বিবেচনা করা বন্ধ করবেন। খুঁজে দেখতে আগ্রহী হবেন - কীভাবে, কিসের প্রেষণে, কিসের কামনায়, কিসের তাড়নায় কিশোর তরুণেরা ধর্মের নামে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। শাহীন আপার আগের উপন্যাস তালাশ, সখী রঙ্গমালা, বা অসুখী দিনের মতো করেই নতুন করে ভাববার খোরাক জোগাবে এই বই।

.
এ উপন্যাস পাঠের সবচে ভালো তরিকা লেখিকা নিজেই, উপন্যাসের একদম গোড়াতেই আমাদের বাতলে দেন ইতালির দার্শনিক লেখক উমবের্তো একোর বয়ানে -
.
'ছাপার অক্ষরে যা আছে, তাই-ই বিশ্বাস করার জন্যে বই রচিত হয় না, বরং অনুসন্ধিৎসাকে উসকে দেয়াই এর উদ্দিষ্ট। কোন বই বিচার করা কালে এতে কি লেখা আছে তা নয়, এর মানে কি - নিজেদের এই প্রশ্নটাই করা উচিৎ আমাদের।'
.
অপেক্ষায় রইলাম আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক শাহীন আখতার আপার ষষ্ঠ উপন্যাসের পূর্ণাঙ্গ সংস্করণের। সামনের জুন - জুলাই মাসে যা প্রকাশ পেতে যাচ্ছে খুব সম্ভব।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০২২ রাত ৮:৪১
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×