"কফি হাউজের আড্ডা" শুনলেই সবারই মানসপটে একটি নামই উঠে আসে মান্না দে।গানটির গীতিকার কিংবা সুরকার কারোর নামই আসে না, জগতের নিয়মটাই এমন! হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে, ' জো দিখতাহে ওহি বিকতাহে।' পেছনের মানুষগুলোর যৎসামান্য স্বীকৃতি মিলে আর জমতে থাকে পাহারসম অভিমান। এমন অভিমান থেকেই হয়ত তিনি বলেছিলেন, ‘কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে গীতিকারদের স্থান দেওয়া হয় না। এ বড় ক্ষোভের কথা। অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, মোহিনী চৌধুরী প্রমুখ গীতিকারদের কবি প্রতিভা সম্বন্ধে কারোর কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবু কবি সম্মেলনে কোন গীতিকারকে ডাকা হয় না। কবিতায় সুর দিলেই গান হয় না। গানের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। তা না হলে রবীন্দ্রনাথ কবিতা ছাড়াও অত গান লিখতেন না। তিনি যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তা একটি গানের বইয়ের জন্য।’
১৯২৫ সালের ৫ই ডিসেম্বর পাবনার গোপালনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতনামা অধ্যাপক উদ্ভিদবিদ গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার। মা সুধা মজুমদার ছিলেন স্নাতক। শৈশব থেকেই বাড়িতে বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত ভাষার তালিম পেয়েছেন। বাবা চাইতেন ছেলে বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করবে। কবিতা ও প্রবন্ধ লেখার প্রতি ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ। ছোট থেকেই গৌরীপ্রসন্নের হাতের কাছে দেশি-বিদেশি বই। ছাত্র জীবনের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেললেন কালীদাসের ‘মেঘদূত’।
ছন্দের মায়াজালে আটকে যাবার পিছনে সম্ভবত মুখ্য ছিল সুরের মুর্ছনায় হারিয়ে যাওয়াই। কাকার বিলেত থেকে নিয়ে আসা গ্রামোফোন হয়ত অণুঘটকের কাজটা করেছিল। গ্রামোফোনে চলত আব্বাস উদ্দিন, শচিন দেব বর্মনের সুরের মুর্ছনা। সেই সুরের মায়া জাদুতেই তাকে যেন বেঁধে দিল আষ্টেপৃষ্ঠে গানের জগতে। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালে সুরকার অনুপম ঘটকের কাছে কিছুদিন গান শিখেছেন। গায়কীর চেয়ে লেখক স্বত্বাই বেশি আকৃষ্ট করেছিল তাকে।
গীতিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাবার পিছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল তিনি শচীন দেববর্মণ এর। যাঁর কণ্ঠ-সুর তাঁকে সবচেয়ে বেশি মোহিত করেছিল, সেই মানুষটির জন্যই প্রথম গান লেখার সুযোগ আসে তার। তারপর আর থামা নয়, চলেছেন দুরন্ত- দুর্বার গতিতে। রোমান্টিক বাংলা গানের জগতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল তার লেখা গান। ‘‘শচীন দেববর্মণ, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোরকুমার, রাহুল দেববর্মণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায় মত লেজেন্ডদের কার সাথেই কাজ করেন নি তিনি! একটু বিস্তৃতভাবে বলতে গেলে তাদের সকলের সেরা ৫ টা গানের লিস্ট করলে তার মধ্যে অন্তত ৩ টি করে গান তারই লেখা।
পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
আজ দুজনার দুটি পথ - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
ও নদীরে - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি - হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
এই মম জোছনায় - আরতি মুখোপাধ্যায়
আজ এই দিনটাকে - কিশোর কুমার
আমি যে কে তোমার - লতা মুঙ্গেসকার
বাঁশি শুনে আর কাজ নাই - শচীন দেব বর্মন
এই পথ যদি না শেষ হয় - হেমন্ত
কফি হাউজের আড্ডা - মান্না দে
যেতে দাও আমায় ডেকো না - আশা ভোসলে
এরকম অজস্র কালজয়ী গান পেয়েছে বাংলা গানের জগত উনার কলম থেকেই। এত এত বিখ্যাত কাজ করেছেন ঠিকই কিন্তু সত্যিকারের প্রফেশনালিজম ছিল না তার মধ্যে। নিজের নিঃসন্তান থাকা এর একটা কারণ হতে পারে। হুটহাট করেই অনেক কিছু করে ফেলতেন। অবশ্য এই হুটহাট থেকেই অনেক বিখ্যাত কর্ম পেয়েছি আমরা। বাংলা গানের জগতের অন্যতম সেরা গান কফি হাউজের আড্ডা গানটাও এসেছে এমন পরিস্থিতিতেই। সুরকার নচিকেতা ঘোষ আর তিনি ছিলেন পরম বন্ধু। নচিকেতা ঘোষ এর পুত্র সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষকে খোকা বলে ডাকতেন। সুপর্ণকান্তি ঘোষকে একদিন দেখে বললেন, কী বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ। সুপর্ণকান্তি উত্তর করলেন, কী সব গদগদ প্রেমের গান লিখছ ? এই যে আড্ডার কথা বললে, এই আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পারো। বেশ কিছু সময় কথা বলার পর গৌরীবাবু বললেন, লিখে নাও দুটি লাইন ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই/ আজ আর নেই’। নচিকেতার বাড়ি থেকে ফিরে সেদিনই সারা রাত জেগে পুরো গানটি লিখেছিলেন। গৌরিপ্রসন্নের সেই লেখায় অবশ্য শেষের অংশটুকু ছিল না তখন। কিন্তু সুপর্ন চাইছিলেন পুর্নতা, যা আবার গৌরিপ্রসন্নের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। তবে খোকার ইচ্ছার কাছে পরাজিত হতেই হয় উনাকে। চেন্নাই ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য যাওয়ার আগে হাওড়া স্টেশনে সিগারেটের প্যাকেটের কাগজে লিখে দেন শেষ তিন লাইন, - ' সেই সাত জোন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে ......"
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তার বিশাল অবদান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সবে শুরু হয়েছে। রামগড়ের একটি চায়ের দোকানে দীনেন চৌধুরী ( রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসঙ্গীতের অধ্যাপক), অংশুমান রায় ( সুরকার, গায়ক), উপেন তরফদার (আকাশবাণীর প্রযোজক) এর সঙ্গে আড্ডায় বসেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। উপেন তরফদার তাঁর রেকর্ড প্লেয়ারে শোনাচ্ছিলেন ৭ মার্চের মুজিবরের বক্তৃতা। শুনতে শুনতে সিগারেটের প্যাকেটের সাদা কাগজে গৌরীপ্রসন্ন লিখে ফেললেন ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি/ আকাশে-বাতাসে ওঠে রণি।’ গানটিতে সুর এবং কণ্ঠ দিয়েছিলেন অংশুমান রায়। ১৯৭১-এ মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে বাজানো হয় সেই গান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও নিয়মিত বাজানো হত এই গান। হেমন্তের কণ্ঠে উনার লেখা ‘মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে’ গানটাও পেয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা।
মরনঘাতী ক্যান্সার তার শরীরে ছড়িয়ে পরেছিল মারাত্মকভাবেই। খুব দ্রুতই শরীর ভাঙতে থাকে তাঁর। চিকিৎসার জন্য ২৫ জুন ১৯৮৬ সালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল বম্বেতে। নিজের বিদায়ের সময় খুব সন্নিকটে এই কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। হাসপাতালে শুয়ে লিখেছিলেন শেষ গান, ‘এবার তাহলে আমি যাই, সুখে থাক ভালো থাক, মন থেকে এই চাই।’ মোহাম্মদ রাফির কন্ঠে তার শেষ গানটিও পেয়েছিল জনপ্রিয়তা। ২০ আগস্ট ১৯৮৬, মাত্র ৬২ বছর বয়সে চলে গেলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সমাপ্তি হল এক সোনালী অধ্যায়ের। ইহলোক ত্যাগ করলেও নিজের কাজের মাঝেই বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের মৃত্যু বার্ষিকিতে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:০৫