তন্বী কি বাসে উঠতে পারবে? ও আমার সম্পর্কে কি ভাববে? স্বামী এতো বড় অফিসার অথচ একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারলো না। কি করবো? শুক্র-শনিবারসহ তিনদিনের ছুটি পড়ে গিয়েছে। যাদের কাছে গাড়ি চাবো তারা নিজেরাই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। তাও ভালো যে টিকিট বাস। শুভ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আনমনে এসব ভাবতে লাগলো। বাস থামতেই লাইনে সামনে দাঁড়ানো তন্বী টিকিট হাতে বাসে উঠলো। শুভ পিছনে উঠতে উঠতে ভাবলো, তাহলে মনে হয় ওর বাসে উঠার অভ্যাস আছে।
বাসে অনেক ভিড়। প্রায় সবাই বাড়ির পানে ছুট দিয়েছে। চৈত্রের দুপুরে বাসে মানুষের ভিড়ে মানুষজন ঘামছে। এই ভিড়ে তন্বী মানুষের মাঝখানে কোনোরকমে জায়গা করে সামনে এগোচ্ছে। পিছনে শুভ্র মানুষের মানুষের ঠেলাঠেলিতে বুঝতে পারছে না তন্বী ঠিকমতো এগোতে পারছে কিনা। এর মধ্যে বাসের হেল্পারের কণ্ঠে শোনা গেলো, ‘ভাই পিছে যান।‘
‘পিছে জায়গা নাই।‘
‘পিছে পুরা খালি। ইচ্ছা কইরা সামনে খাড়ইয়া খালি জাম করেন। পিছে যান।‘
লোকটি সরে যেতে তন্বী মহিলা আসনের সামনে দাঁড়ানোর জায়গা পেলো।
‘এক্সকিউজ মি। এটা মহিলা সিট।‘ মহিলা আসনে সামনের সিটে বসে থাকা একজন ভদ্রলোককে তন্বী বললো।
‘আপনারা মহিলারা যখন পুরুষের সিটে বসেন তখন কি আমরা কিছু বলি?’
লোকটির পিছনে বসে থাকা ভদ্রমহিলাটি বললো, ‘আপনি তো আচ্ছা লোক! আপনি একটা মেয়েকে দাঁড়া করায়ে রাইখা বইসা থাকবেন? ছেলেরে মায়ের কোলে দিয়া মেয়েটাকে বসতে দেন।‘
এরমধ্যে পরবর্তী বাস স্টপেজে কিছু কলেজ ছাত্রী ও কিছু লোক উঠলো। তন্বী দেখলো বাবার কোলে ৭/৮ বছরের ছেলেটা কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক বুঝতে পারছে না। আর তার পাশে বসে থাকা স্ত্রী নারীর সম্মানের জন্য লড়বে না স্ত্রী ধর্ম পালন করবে বুঝতে পারছে না। ছেলে অবুঝ চোখে আর মা দোটানায় পড়া চোখে একবার ওর দিকে, একবার লোকটার দিকে, একবার ভদ্রমহিলার দিকে তাকাচ্ছে। তন্বী হাতের ইশারায় ভদ্রমহিলাকে বুঝালো, থাক, ঠিক আছে। বামপাশে পুরুষ সিটে বসা একজন ভদ্রলোক ওই লোকটিকে বললো, ‘মাইয়া মানুষ নিজেদের দুর্বল বইলা সুবিধা নিতে চায়। তানাহলে বলেন চাকরিতে প্রতিবন্ধীর চাইতে মহিলা কোটা বেশি ক্যান?’
লোকটির এমন স্থূল উদ্দেশ্যপরায়ণ কথায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শুভ কি বলা উচিত বুঝতে পারছিলো না। তন্বী সামনে তাকাতেই সহসা খেয়াল করলো অর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন অগোছালো লোকের হাত সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কলেজ ছাত্রীদের একজনের পিছনের দিকে সন্তর্পণে এগোচ্ছে। তন্বী লোকটির হাত আর তার দিকে বারকয়েক তাকিয়ে তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে হাত ধরে পিছনে মুড়িয়ে বললো, ‘মেয়ে দেখলে হাত নিসপিস করে তাইনা? হাত ভেঙে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিবো।?’ লোকটা ভয়ে হালকা জ্যামে থাকা বাস থেকে ভোঁ দৌড় দিয়ে নামলো। মেয়েটা বুঝতে চেষ্টা করলো কি হয়েছে। আর মহিলা সিটে বসে থাকা লোকটা ‘আপা বসেন’ বলে তন্বীকে বসার জায়গা দিয়ে স্ত্রী-পুত্রসহ বাস থেকে নেমে গেলো। মেয়েটি তন্বীকে ইশারায় বসতে বললেও তন্বী মেয়েটিকে আর ওর বান্ধুবীকে ইশারায় বুঝিয়ে দিলো বসতে। মেয়েটি বসে বললো, ’থ্যাংক ইউ।‘
‘এরপর কেউ যদি তোমার দিকে অন্যায় হাত বাড়ায় তবে তুমি সেই হাত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাবে। দেখবে পালানোর জায়গা পাবে না। অন্ততঃ আর দশজনের সাথে একই অন্যায় কাজ করতে হাত তো কাঁপবে। আজ যদি আমি প্রতিবাদ করি, কাল আরেকজন প্রতিবাদ করবে, পরশু আরো দশজন প্রতিবাদ করবে। প্রতিবাদের শুরু হোক আজই।‘
শুভ তন্বীর সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে গেলো।
পিছনে বসে থাকা ভদ্রমহিলার সিট খালি হতেই তন্বী তাতে বসে বললো, ‘যখন আমি বুঝলাম লোকটি আমাকে আঘাত করে কথা বলছে তখন ইচ্ছা করেই আর কথা বললাম না। কারণ তর্ক করলেই কাদা ছিটাছিটি হবে। মাঝখান দিয়ে নারীর সম্মান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আমি সময় নিচ্ছিলাম যাতে লোকটা নিজের কথায় নিজে ধরা পড়ে।'
বাস খালি হচ্ছে। তন্বী খেয়াল করলো শুভ না বসে অর সিটের পাশে ওকে আগলে রাখার মতো দাঁড়িয়ে আছে। তন্বী শুভকে বসতে বললেও শুভ বসলো না। কিছুক্ষণ পর শুভ বাসের সামনে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো, ‘যার সাথে অন্যায় হবে সে প্রতিবাদ করলে হয়তোবা অপরাধ প্রবণতা কমবে। কিন্তু এতে কি বিকৃত মস্তিষ্কের লোকটার নিয়্যত ঠিক হবে?’
তন্বীসহ বাসের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
‘আজ নারীদের তাদের বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখলেও কিছু বলি না।‘
‘কিন্তু আমরা তো নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে প্রতিবাদ জানাই।‘ একজন প্রতিউত্তরে বললো।
‘তো আজ কেন চুপ থাকলেন? আর কত দেয়ালে পিঠ ঠেকলে বলবেন হ্যাঁ আজ প্রতিরোধ গড়তে হবে? ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে প্রতিবাদ আমি চাইনা। নারীরা প্রতিবাদ করেছে, আর প্রতিরোধের দেয়াল আমাদের পুরুষদেরই গড়ে তুলতে হবে এখুনি।‘
বাস থামলো। বাস থেকে নামার সময় শুভর নির্ভরতার হাতে হাত রেখে হয়তোবা তন্বীর মনে এই কথাগুলোই গেয়ে উঠছিলোঃ
“কিছু পুরুষ মনে করে, নারীর চাওয়া
অলংকার, হাতি-ঘোড়া, বাড়ি-গাড়ি।
নয়তোবা রোমান্স নামে টক্সিক ভালোবাসা।
কিন্তু সে কি জানে?
যদি একবার সাথে দাঁড়াও, পাশে থাকবো সারাজীবন।
যদি একবার সম্মান দেখাও, তো শ্রদ্ধা করবো জীবনভর।
যদি একবার ভালোবাসো, তো ভালোবেসে যাবো আজীবন।“