২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহের সময় ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর কাছে সাহায্যের জন্য ফোন করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০০৯ সালের ২ মার্চ নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স স্টিভেন হোয়াইট ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শিবশংকর মেননের বৈঠক সম্পর্কিত কূটনৈতিক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।
গত রোববার ভারতের দ্য হিন্দু’র অনলাইন সংষ্করণে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। উইকিলিকস থেকে সংগৃহীত কয়েকটি কূটনৈতিক বার্তা থেকে ওই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
বার্তায় জানানো হয়, শেখ হাসিনা প্রণব মূখার্জীর কাছে সহায়তা চেয়েছেন। তবে কী ধরনের সাহায্য প্রয়োজন তা সুনির্দিষ্ট করে বলেননি তিনি। তবে ‘যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তারা সক্রিয় হবেন’- শেখ হাসিনাকে এমনই আশ্বাস দেন প্রণব মূখার্জী।
পররাষ্ট্র সচিব শিবশংকর মেনন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে জানান, ভারতীয় সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে চীন, জাপান ও যুক্তরাজ্যের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়।
বিডিআর বিদ্রোহে ভারতের উদ্বেগের কারণ ছিল দুটি। ভারতের ভয় ছিল, বিডিআর বিদ্রোহ থেকে সৃষ্ট অস্থিরতাকে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের’ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে জামায়াতে ইসলামী। মেনন স্টিভেনকে জানান, বিডিআর বিদ্রোহ দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। জামায়াতে ইসলামীকে এক্ষেত্রে সরাসরি দোষ দেননি তিনি। তবে তিনি জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল এবং মহাজোট সরকারের জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের পর থেকে হতাশার মধ্যে আছে দলটি।
ভারতের ভয়ের আরেকটি কারণ ছিল, এই ঘটনা সেনাবহিনীর সঙ্গে নতুন নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে।
বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা নিহতের ঘটনা এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মেনন। এই ঘটনায় শেখ হাসিনার সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটা ঝামেলা তৈরি হবে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।
বিদ্রোহের পর যুক্তরাষ্ট্র যে বিবৃতি দেয়, সেটির প্রশংসা করেন মেনন। এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতকে আলোচনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
স্টিভেন জানান, সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়া কী হবে এবং ভবিষ্যতে আরো কোনো সহিংসতা হবে কি না তা বোঝা যাবে প্রাথমিক পর্যায় কেটে যাওয়ার পর।
২০০৯ সালের ৯ মার্চ ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে আরেকটি কূটনৈতিক বার্তায় ভারতের উদ্বেগের কথা জানানো হয় আবারো। শেখ হাসিনার সরকারকে অস্থিতিশীল করার বিষয়টিই ভারতের উদ্বেগের প্রধান কারণ।
ওই বার্তায় বলা হয়, মার্কিন দূতাবাসকে বিডিআর বিদ্রোহে ‘মৌলবাদী শক্তিগুলোর’ জড়িত থাকার সম্ভাবনার কথা জানান ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। তিনি জানান, বিডিআর বিদ্রোহে জড়িত পরিচিত অনেক অপরাধী রয়েছে যারা বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় বিডিআরে ঢুকেছিল।
২০০৯ সালের ১৩ এবং ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব। বিডিআর বিদ্রোহের বিষয়টি ছায়া ফেলে অনেকটা। এর একদিন পরেই তিনি দেশে গিয়ে ভারতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্টের রাষ্ট্রদূত পিটার বারলেইর সঙ্গে বিষয়টি তিনি আলোচনা করেন। বিডিআর বিদ্রোহের পর থেকে বাংলাদেশের অবস্থা খুব নাজুক বলেও জানান পররাষ্ট্রসচিব।
২০০৯ সালের ১৬ এপ্রিল নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো কূটনৈতিক বার্তায় ওয়াশিংটনকে ভারতের দুশ্চিন্তার জানানো হয়। শিবশংকর মেননের বরাত দিয়ে জানানো হয়, বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিতিশীল অবস্থায় ভারত অনেক চিন্তিত। ভারত মনে করে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে উৎখাত করতে মৌলবাদীরা এরকম পরিবেশকে ব্যবহার করবে। এছাড়া এই পরিবেশের সুবিধা নিয়ে তারা ভারতের ওপর আক্রমণও করতে পারে বলেও ওই কূটনৈতিক বার্তায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
কোন চরমপন্থী গ্রুপগুলোর ব্যাপারে ভারত উদ্বিগ্ন তা জানতে চান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্টদূত। তার চাপাচাপির পর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব তাকে জানান, রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী থেকে শুরু করে চরমপন্থি গ্রুপ হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীকে পর্যন্ত তাদের ভয়।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে খুব সামান্য ইস্যু নিয়েই রাজনীতি উত্তপ্ত হয়। তারা খুবই আশ্চর্য হন এই দেখে যে, সেখানে বিডিআর বিদ্রোহের মতো ইস্যু থাকার পরও রাজনীতিবিদরা বিরোধীদলীয় নেতার বাড়ির মতো সামান্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
বার্তায় জানানো হয়, পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশের সরকারের মধ্যে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়ার মতো একটা ব্যাপার দেখা যাচ্ছে। তিনি জানান, এই সরকার ঠিকঠাকভাবে কাজ করছে না।