somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ষোলই ডিসেম্বর ও আমার শৈশব

১১ ই জুন, ২০১১ দুপুর ২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ষোলই ডিসেম্বর ও আমার শৈশব


নির্ভয়পুর। বদরপুর। বাঙলাদেশের রাজশপুর গ্রামের সাথে সমান্তরাল জমজ। আমরা নির্ভয়পুর-বদরপুর এলাকায় ছিলাম। উদ্বাস্তু হয়ে। তবে রিফিউজি ক্যাম্পে নয়। অন্যের বাড়িতে ঘর তুলে ছিলাম। জগদীশ-যুধিষ্ঠির কাকাদের বাড়িতে। আমাদের বাংলাদেশের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটারেরও কম দূরে। আমার স্মৃতিতে রিফিউজি ক্যাম্প কেমন তার কোন কিছু আর মনে পড়ে না। তবে এটা মনে পড়ে যে আমার অতি নিকটের বাংলাদেশের বাড়িটি যেন বা সূদুর।


মাঝের প্রাকৃতিক লীলাক্ষেত্র –শাল, লালমাটি, পদ্ম জলা- যা এক ব্যাঘ্রলম্প দূরত্ব- পার হতাম চিতার সতর্কতায়। ১৯৭১ সালে আমার গ্রামের প্রায় সবাই প্রাণ বাঁচাতে চলে গিয়েছিলো ওপাড়ে। অনেকেই বার বার ফিরে ফিরে আসতো যুদ্ধের সময়। এ গ্রামটি মুক্তিযুদ্ধের ফ্রন্ট লাইনে অবস্থিত ছিলো। আমার বাড়ির সমুখে দাদা-আদমের দিনের এক প্রকান্ড আমগাছ ছিলো। এর ছায়া, এর উচ্চতা ও বেড় সবই গেরিলা যুদ্ধের জন্য অতি উপযোগি ছিলো। প্রকৃতি মুক্তিসেনাদের আশ্রয় দেয়। যোদ্ধার খবারও, নিভৃত নিরাপদ নীড় যখন প্রকৃতি প্রস্তুত রাখে তখন যুদ্ধে বিজয় অনিবার্য। প্রকৃতির এই গোপন মেহমানদারির মোজাজা সবাই বুঝতে পারে না।

১৯৭১ সালের ষোলো ডিসেম্বর। বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই আমরা ব্যাংকারে ছিলাম। নভেম্বর-ডিসেম্বর ছিলো তুমুল যুদ্ধের মাস। সেপ্টম্বর মাস থেকেই ব্যাংকার তৈরির উপর কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈনিকগণ এল টাইফ, টি টাইফ বাংকার তৈরির কলা- কৌশল শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

আমার দাদা ব্যাংকারে স্টোভ নিয়ে যেতেন। চা বানাতেন। সবাইকে খাওয়াতেন। তিনি ডাক্তার ছিলেন। বহু আহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা করেছেন তিনি। পাশের শরণার্থী শিবিরেও তার চিকিৎসা ক্ষেত্র বিস্তৃত ছিলো।

সবাই যুদ্ধে। আমরা শিশুরা, কিশোররা কী করবো। আমরা পাঞ্জাবি-মুক্তিযোদ্ধা খেলতাম। কত বাঁশ ঝাড়ের বাঁশ কেটেছি। বন্দুক বানিয়েছি। জংগলে এক ধরনের গোটা পাওয়া যায়। এই গোটা ছিল গুলি। খেলাচ্ছলে আমরা কী আগামি দিনের গেরিলা হয়ে উঠছিলাম।

আমার মনে আছে ষোলো ডিসেম্বর আমরা এক দৌড়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিলাম।

কাঁকড়ি ও গেরিলা

কাঁকড়ি আমাদের গ্রামের কাছাকাছি গাঙকূল, চকলক্ষ্মীপুর, কৃষ্ণপুর-কোমারডোগা হয়ে, বেলঘর, আশ্রাফপুর হয়ে চলে গেছে ডাকাতিয়ার দিকে। এর জন্ম ভারতের রঘুনন্দন পাহাড়ে। এই নদী আমার মধূসূদনের মতো প্রিয়। আমার কপোতাক্ষ। এই নদী সামরিক কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ নদীতে জাহাজ দূরে থাক, ছোট নৌকাও চলে না। তবে বরষায়- আষাড়ে- ভাদরে একেবারে ফুঁসে উঠে, প্রবল, প্রমত্ত। এই নদী ১৯৭১ সালে বহু গেরিলার জন্য পথরেখা ও মানচিত্রের এক অনন্যসাধারণ প্রতিক হয়ে ওঠে। কত গেরিলার গন্তব্য গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড চিনিয়ে দিয়েছে এই নদী। নদী আপনাকে অভিবাদন! ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর এই নদীর বুকের উপর দিয়ে অনেকই দৌড়ে দৌড়ে গেছে মিঞাবাজারের দিকে। এই বাজারের মিঞাবাজার লতিফুন্নেছা বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে ছিলো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। নদীর উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলো দলে দলে মানুষ। ভয় ছিলো নদীর পাড়ে মাঈন পোঁতা আছে।

যে কোন পোষাকই সামরিক পোষাক


আসলে মুক্তিসেনার সাথে সাথে আরো অনেক কিছু সামরিক হয়ে উঠে। আসলে পোশাকি সামরিক বস্ত্রের বাইরে যে কোন পোষাকই যুদ্ধের পোশাক হয়ে উঠতে পারে। যেমন লুঙ্গি। গোঁজ দেয়া লুঙ্গি কোমড়ের জোড় সাংঘাতিক বাড়ায়। যে ছাত্র তার একমাত্র প্যান্ট নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে, সেটাও সামরিক হয়ে উঠতে পারে। যুদ্ধে যে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের জুতা ছিলো না, তাদের একজনের পায়ে খেঁজুর কাঁটা বিদ্ধ হয়েছিলো। সে-ই স্মৃতি এখনো তিনি বয়ে বেড়ান। তারপরেও বিধ্বস্ত পা নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। মাথায় গামছা বাঁধা আমাদের ঐতিহ্য। শ্রমিকতা ও সশস্রতার সবচে স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ।

মাটির ঘরঃ হঠাৎ বাংকার

যে কোন ভৌত অবকাঠামোই যুদ্ধের অংশ ও আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে। যেমন, আমাদের বাড়ির মাটির বড়ো ঘরটি। ওটা মাটির উপর একটা বড়ো বাঙ্কারের মতো। যেন হঠাৎ একটা বাঙ্কার এইমাত্র মাটি ফূঁড়ে বেরিয়ে আসলো। কতো বুলেট যে এই মাটির ঘরের গায়ে বিঁধে আছে। বাঙলার সমস্ত ভৌত অবকাঠামো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলো। বাংলার বাস্তশিল্প নিয়ে কোন কাজ হয়নি। বাংলার বাস্তশিল্পের ক্রমবিকাশের সম্ভাবনার পথ পরিহার করে কিংবা নাকচ করে পশ্চিমা ধাঁচের বিকৃত নগরায়ন ঘটেছে। বাঙলার ঘর বাড়ির আর্কিটেচার ও সাংস্কৃতিক টেক্সচার দুটোকেই আমরা জীবন থেকে ত্যাগ করে যে যাপিত জীবন তা আমাদের নিজেদের জন্য বয়ে বেড়ানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তা-ই আজ অনেক মানুষই ঢাকা ত্যাগ করতে পারলে বাঁচে, যদিও যাওয়ার উপায় নাই। এ যেন এক বন্দী জীবন। আমি জানি মাটি যে কোন যুদ্ধের জন্য, প্রকৃতি যে কোন সামরিক কৌশল নিরূপণের জন্য, বৃক্ষ ও তরুরাজি আশ্রয় ও আড়ালের জন্য দরকার। আমাদের শালবন আর লালমাটি তেমনই। যে তার প্রকৃতিকে যতো ভাল করে চেনে, সে ততো ভালো যোদ্ধা।

আগেই বলেছি ১৯৭১ সালের শেষদিকে আমরা বাঙ্কার তৈরি করে সেখানেই থাকি রাতের বেলায়, বিশেষ করে বোম্বিং শুরু হলে। দিনের বেলায় দেখে দেখে আর রাতে স্মৃতি ও শ্রুতির ক্ষমতার উপর ভর করে বলে দিতে পারতাম কয়টা মর্টার কোন দিকে থেকে গেলো। আকাশে উড়ন্ত কলার মোচার মতো। এক বাঙ্কার থেকে আরেক বাংকারে ক্রল করে এসে কেঊ কেঊ বেঁচে থাকার ইংগিত দিতো। আমি জানি আমার এক বাংকারের গল্প শত বাংকারের।

ফ্রণ্ট

এই বাংলদেশের যে গ্রামটিতে আমার জন্ম সে-ই গ্রাম ছিলো যুদ্ধের ফ্রণ্ট। এই ফ্রণ্টের অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে শাল-বীথিকার বিস্তীর্ণ ফরেষ্ট। সে-ই বনভূমে মুক্তিসেনানি হেঁটে বেড়িয়েছে বীরদর্পে। বাঙলাদেশের প্রতিটি গ্রামের লড়াই ও সংগ্রামের ইতিহাস আলাদা করে লিখা যাবে। পৃথিবীতে এরকম দেশ খুব কমই আছে। জাতির ইতিহাসের অংশীদার বাংলার প্রতিটি গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত অতিক্রম করে অপারেশনে যাচ্ছেন আমার দাদী-দাদা তাদের জন্য চায়ের বন্দোবস্ত করতেন। এটি যেন শেষ চা পান না হ্য় সে-ই দোয়াও নিশ্চয়ই আমার সুফী দাদা করতেন। কোন কোন মুক্তিযোদ্ধা বদর শাহ ‘র দরগায় ফানা চাইতেন। মৃত্যুঞ্জয়ীরা মৃত্যুর ভয় অতিক্রম করে প্রিয়জনের মুখ স্মরণ করে। যে যুদ্ধে বাংলার সকল মানুষ একাট্টা সেখানে সুফী ও দরবেশদের শক্তি দুর্গম এম্বুস আর মাঈন ছড়ানো পথে দুরন্ত গেরিলার মত হেঁটে বেড়াবার সাহস দেবে এই তো স্বাভাবিক। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি তালগাছওয়ালা খিল পার হয়ে দশজনের একটি কন্টিনজেন্ট শালবন ও পদ্মজলার মাঝখানে বাংলাদেশের শালবন বিধৌত উর্বর ফসলি ক্ষেতে পা রাখল। এটা বাংলাদেশ। এক চিলতে বন যেখানে ভারত-বাংলা সীমান্ত পৃথক করেছে তার পরে তালগাছ ওয়ালা খিল। এখনো তেমনি আছে। আমরা সীমান্ত থেকে বেশি হলে দু’শ মিটার দূরে। সেখান থেকেই বসতির সূত্রপাত।
তারা পদ্মজলার পাড়ে পৌঁছে গেছে। হঠাৎ গুলির শব্দ। এক রাউন্ড। ভয় পেলেন না। বোঝার চেষ্টা করছেন নিশানা ও দিক। আজ সফল হতেই হবে। কোন পিছপা নয়। মিঞাবাজারে ঢাকা-চিটাগাঙ হাইওয়ের উপর বিশাল বটবৃক্ষের মগডালে পাক হানাদারদের ওয়াচ টাওয়ার। আজ শেষ। উড়িয়ে দিতেই হবে। সব প্রস্তত। রেকি করা হয়েছে। বার বছরের এক কিশোর এই রেকি করেছিলো। তাকে পরে পাক হানাদার বাহিনী হত্যা করে।

রাজশপুর গ্রাম থেকে অপারেশন “ওয়াচ টাওয়ার” শুরু হবে। সম্ভবত মথুরাপুরের দিক থেকে গুলির শব্দটি এলো। বহুদূরে। পাক সেনারা মথুরাপুরে আছে। ইচ্ছা করেই সেখানে মুক্তিসেনাদের আরেকটি দল গেছে। সুয়াগাজি ক্যাম্পের পাক সেনাদের ব্যস্ত রাখার জন্য। রাজশপুর থেকে ওয়াচ টাওয়ার ধ্বংসের জন্য একটি কৌশলগত ত্রিকোণ তৈরি করা হয়েছে। দুই কোণে গেরিলার ঠুস ঠাস, শুধু চুনা আমগাছের চূড়া থেকে বটবৃক্ষের মগডাল টার্গেট। রকেট লাঞ্চার আর মর্টারসেলিং। ম্যাপ তৈরি। দূরত্ব পরিমাপ করা হয়েছে নিখুঁতভাবে। লোংগার ক্ষেত আর বাছরইগা জলার পাড় ধরে তারা এগিয়ে চলেছে (ধারাবাহিক প্রতিদিন)

নিষ্ঠুরতা সৈনিকের জন্য মর্যাদাহানিকর


নির্যাতনের জবাবে মুক্তিসংগ্রামীরা কখনোই বর্বরোচিত আচরণ করে না, করেনি।

নিষ্ঠুরতা সৈনিকের জন্য মর্যাদাহানিকর।পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তার সৈনিকোচিত সংকল্প থেকে বিচ্যূত হয়ে এক লুটেরা দস্যুর দলে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে আমাদের এলাকায় পাঞ্জাবি বলা হত। মার্কিনিদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আর চীনাদের “চিকন বুদ্ধির পররাষ্ট্রনীতির” দোলাচলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এতো বাড়াবাড়ির অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন। আমাদের অঞ্চলের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাশিয়ায় চিকিৎসারত অবস্থায় সাংবাদিকেরা জিজ্ঞাসা করেছিল, “ আপনি এমন ভাবে আহত হলেন কেমন করে?” তার জবাব ছিলো, মার্কিন অস্ত্রের আঘাতে। আসলে স্বাধীনতা সংগ্রাম অর্থ্যাৎ ১৯৪৮- ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত পুরো কালপর্বটি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের পটভূমিতে বিনির্মিত হয়েছিলো। দুঃখজনক এবং কলংকজনক হলো পি-এল ৪৮০ –এর গম ( মার্কিনিদের পঁচা গম রাজনীতি) না আসার সাথে চুয়াত্তরের চরম খাদ্যাভাবের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জন এফ কেনেডি যখন কোলকাতার শরণার্থি শিবিরে দেখে যখন আঁতকে উঠেছিলেন , তার সেই দরদি প্রাণের বয়ান নিক্সন সরকারর মন গলাতে পারেনি। পরে কি করে আমরা ঐসব পঁচা গমের উপর ভরসা করে বাঙলার মানুষের বর্তনে দু’মুঠো অন্নের সংস্থানের কথা ভাবতে পারলাম। খাদ্য সার্বভৌমত্বের সকল শর্ত বিরাজ করা সত্ত্বেও, শরণার্থী শিবিরে আট লক্ষ শিশু ও হাজার হাজার মানুষ মারা যাবার পরেও এবং নয় মাসে রক্তপ্লাবলে পরিপুষ্ট বাংলার জমিতে এত ফসল হবার পরেও আমরা দুর্ভিক্ষে পড়লাম। যুদ্ধের সময়ও প্রায় তিন/চার কোটি কৃষক চাষবাস করেছিলো। কৃষি ও মুক্তিসংগ্রাম একসাথে চলেছিলো।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান প্রাণশক্তিই ছিলো কৃষি বিপ্লবের, কৃষকের সংগ্রামের ধারাবাহিকতা ও এই বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে যাবার তীব্র আকাঙ্খা।

তাজউদ্দিনের সরকার জানতেন ভারত থেকে প্রায় এক কোটি এবং দেশের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রিত প্রায় দুই কোটি মানুষ চরম অপুষ্টির শিকার। তাদের পাতে পুষ্টিকর খাবার তুলে দিতে তাজউদ্দিন পরবর্তী সরকার কিছুই করে উঠতে পারেনি।

কাঁকড়ি ব্রীজ উড়িয়ে দেয়া হলো

শিশির শ্রান্ত ভোর। আমাদের এলাকায় ঢলপহরের আগখান। লোকে বলে, ভর কালিঞ্জা। ২৬ মার্চের সকাল। ন্যাপ, ছাত্র ইঊনিয়নের কর্মীরা আমাদের বাহির বাড়ির উঠানে কাছারি ঘরের সামনে। কী যে আলাপ হচ্ছে তার মর্ম বোঝার বয়স তখনও হয় নাই। একেবারে নাবালক। তবে ইঙ্গিত, ভাব ও পরিবেশ দেখে বুঝতে পারছিলাম উত্তেজনাকর ও ভয়ানক কিছু একটার জন্য প্রস্ততিমূলক আলোচনা চলছে। এখনও স্মরণে ঝাপসা-আবছায়া কিছু একটা স্মৃতি ফুঁড়ে প্রকাশ্য হয়ে উঠতে চায়। তবে একটা কথা মনে আছে। কাকে যেন হত্যা করা হয়েছে। পরে জেনেছি, মিঞাবাজার ইপিআর ক্যাম্পের শেষ বিহারি জওয়ান। সে নাকি যেতে চায়নি। এ এলাকায় তার এক প্রেমিকা ছিলো। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের শুরু- এটা অনেকেই মানতে পারেনি। যিনি এই কাজটি করেছেন তাকে তীব্র সমালোচনা করা হলো। মানুষের প্রেম জাতিসত্তা দ্বারা নির্ধারিত হ্য় না।

২৬ মার্চ ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ের উপর কাঁকড়ি ব্রীজ উড়িয়ে দেয়া হলো। আমাদের এলাকা শমসের গাজির এলাকা। মেহেরকূল, চাকলা রোশনাবাদ স্টেট, খন্ডল এই সব এলাকা দু’পাশে রেখে এই রাস্তা ধরে কতো না সৈন্য, বিপ্লবী, সম্রাট, রাজন্য, সুজা বাদশার মত রাজনৈতিক ভাবে পরাস্ত রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থি, গোরা সৈন্য মার্চ করে গেছে,তার হিসাব ইতিহাসের কারবারিরা রাখুক। আমি শুধু এ পথের রাজনৈতিক পথরেখা, হ্রেষা, সিটি আর হুইসেল, হাওয়ার গাড়ি আর ট্যাংকের গল্প বলবো।

এ পথ থেকে খুব কাছেই আছে নিলয় ঘাঁটি। দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধের এ্যারোড্রাম। এখন জমি। একেবারে ফসলি জমি। ফেনী পর্যন্ত পথের দু’ধারে সুজা বাদশার দীঘি। জোড়কারণ আর গোত্রশাল, রাজার মার দীঘি। হাইওয়ে থেকে ত্রিপুরা সীমান্ত কোথাও দু’শ মিটার, কোথাও তিন কিলোমিটার, সর্বোচ্চ পাঁচ কিলোমিটার হতে পারে। মাউন্টব্যাটন সাহের যখন মানচিত্রের উপর আঁকিবুকি করছিলেন তিনি বৃটিশ ত্রিপুরার এক বড়ো অংশ স্বাধীন ত্রিপুরাকে দিয়ে দিয়েছিলেন। না হলে কোন দেশের জাতীয় মহাসড়ক থেকে এত কাছে সীমান্ত হয় কী করে। এই গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের এই অংশ সম্পর্কে তার জ্ঞান কম ছিলো তা’ নয়। সে সময়কার বাঙালী মুসলমানের তথাকথিত প্রতিনিধিরা মসনদে বসার তাড়াহুড়াতে এই সব প্রতিরক্ষার সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে এতোই উদাসিন ছিলো যে কসবা দিয়ে ট্রেন আসার সময় জানালা দিয়ে হাত বাড়ালে ভারত ধরা যায়। আমার অঞ্চলে বহু গ্রাম আছে যেগুলো ভারতের পেটের ভেতর। তিন দিকে ভারত। ছোটবেলায় যখন শালবনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সীমান্তে যেতাম, তখন বাংলাদেশ –ভারত সীমান্ত গুলিয়ে ফেলতাম। এতো প্যাঁচ, রেখারিক্ত সীমান্ত জগতে আছে কী না জানা নাই। তবে এসব কিছুই মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজে লেগেছে। তাতে বোঝা যায়, এই বৈষম্যমূলক বিভাজন রেখা, পাহাড়ের কোন ভাগ না দিয়ে শুধু সমতলে বাংলাকে শুইয়ে রাখা, কারো কারো তুডুত বুদ্ধির ফল। মনে মনে এতো প্যাঁচ, আর সীমান্তের ( ফেনী থেকে আখাউড়া) এই সব এলাকায় ভারতের পাহাড়,টিলা টঙ্কর আমাদের উপর নজরদারি রেখে, আর কোথাও অজগরী প্যাঁচ দিয়ে রসুইঘর, থাকার ঘর আলাদা করে আসলে ১৯৭১ –এর ফ্রন্টলাইনের দিক থেকে, গেরিলা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে খুবই বাক্কা সুবিধা দিয়েছিলো।

২৬ মার্চের পরেও আমরা এই চকরা-বক্র সীমান্তের সুবিধা পেয়েছিলাম। চরণ-চঞ্চল ছুট পূবদিকে। পেছনে ঠা ঠা ঠা, গুলি, কোলাহল, আর্তনাদ। রোদন, শোক সন্তাপ বিলাপের সময় নাই। কোথায় যাচ্ছি আমরা? পূবদিকে। পশ্চিম থেকে পুবে। জান বাঁচাতে ছুটছি। আমার প্রিয় বাছইরগা জলা বামে, পদ্মবিভূষিত আড়ালিয়া জলা ডানে রেখে লোঙ্গার খিলে এসে দেখি মানুষ আর মানুষ। জাদু ৫০ সিসি মোটরসাইকেল ঠেলছেন। আক্তার হামিদ খান সাহবের সবুজ বিপ্লবে এই মোট্র সাইকেল কোতয়ালী থানার গ্রাম-গ্রামান্তর চষে বেড়িয়েছে। দাদার হাতে তার জমির দলিলের ব্যাগ, ম্যাডিক্যাল বক্স, কোলকাতা থেকে বৃটিশ আমলে কেনা পিতলের স্টোভ।
কেউ কেঊ সব প্রিয় বস্তু পেছনে রেখে এসেছে। কেঊ কেউ পরম প্রিয় বস্ত কাঁধে করে নিয়ে এসেছে। জীবনে প্রথম মরণের বোধ হল। কেঊ গরু-ছাগল তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। ঘর গেরস্থালির টুকিটাকি আছে প্রত্যকের কাছে। মানুষ তার নিজের চেয়েও পোষা জিনিসের কদর করে বেশী। মানূষের নিজের জান তার জানি দোস্ত। এই দোস্তালি যখন প্রাণ ও প্রকৃতির সকল ক্ষেত্রে বিস্তার করে, তার প্রাথমিক মহড়া হয় প্রাণী পুষে, ক্ষেত-খামারি করে। প্রাণ ও প্রকৃতি এইভাবে মানুষের আপন হয়ে ওঠে। একটা যুদ্ধ কতটা জনযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করবে, তা কেবল জনগণের বিমূর্ত চেতনার বিষয় না, আমাদের উৎপাদন, আত্মীয়তা, খাদ্য, সামাজিক সম্পর্ক ও সংস্কৃতির আরো অনেক দিকের সাথে বিজড়িত। দেহের জখমের চেয়ে মনের জখম আমাদের প্রাণে শহীদ হবার আকাঙ্খা জাগ্রত করে।
সেদিন যারা সীমান্তের ওপাড়কে নিরাপদ ভেবে প্রাণ বাঁচাতে ছুটছিল, তাদের অনেকেই আবার প্রাণ দিতে ফিরে এসেছিল। যারা প্রাণ দিতে ফিরে আসে,তারা ও যারা থেকে গিয়েছিলো সবাই মিলে প্রাকৃতিক ও স্বতস্ফূর্তভাবে একটা যুদ্ধ কৌশল গড়ে উঠেছিল। যুদ্ধের প্রথম কয়েক ঘন্টা আমাদের বাড়ি ও মাটির ঘরের সামরিক মূল্য আমি এখন উপলব্ধি করি। প্রথম এক ঝাঁক বুলেট আমাদের বড় শাল কাটার বছর তৈরি গদল অর্থাৎ পুরু মাটির দেয়ালে বিদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধ কী শুরু হয়ে গেছে?


ঠিক যখন গ্র্যাণ্ড ট্রাংক রোড কিংবা তার নিকটবর্তি কোন গ্রামে-লালবাগ, মথুরাপুর, চান্দশ্রী- গুলি হল, তখন মনে হল সবাই এই গুলির জন্যই অপেক্ষা করছিল। আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। কেঊ কেঊ দূরে গৃহদাহ দেখতে পাচ্ছে। সকল গ্রাম থেকে সম্মিলিত চিৎকার, কলরব, জলকল্লোলের মত, ঝড়ের আগের বৃষ্টির মত ক্ষীণ থেকে বিশাল নিনাদ। আর পশ্চিম দিক থেকে ছুটে আসছে মানুষ, বাড়ির পোষা মোরগ, কুকুর, গরু, ছাগল। শোনা যাচ্ছে মাকে আনতে পারি নাই, মা। আম্বিয়ার বাপ অচল, আহা মরে পড়ে থাকবে। হায় হায় রব ও বিলাপের কনসার্ট, সবাই ইতিহাসের অংশীদার হবার জন্য ছুটছে। জদর বু’জান কই? কেঊ একজন বলে উঠলো। চন্দ্রবান, নূরবানু – যাদের দুই কূলে কেউ ছিলো না, আমার দাদা-বুবু “গাছির বংশধর” দের আশ্রয় দিয়েছিলো, সে-ই নূরবানুই বোধ হয় বলেছিলো, এটা শিকার। শিকারির গুলি। না, মূহুর্তেই বোঝা গেলো এরকম বন্দুক এ এলাকায় কারো কাছে নাই। এটা বাংলার মানুষদের হত্যা করার জন্য পাক হানাদারদের গুলি। আমি তখন চুনা আমগাছের তলায় আমার বোন শানু সহ “দোকান-দোকান” খেলছিলাম। প্রায়ই আমরা প্রকৃতির উপাদান নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসতাম। পরে আমাদের দু’জনের কেউই দোকানদার হইনি। আমি তো বিশ্ববাজারের দোকানিদের – ওয়েষ্টার্ণ হাই স্ট্রীট-এর বিরুদ্ধে লড়ছি।

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×