প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্বের পর...
মাস দুয়েক পরের কথা। ঘুমিয়ে ছিলাম আমি, যোগাযোগ কেন্দ্রটা মাথার কাছে বালিশের পাশে রাখা ছিল। কর্কশ শব্দ করে বেজে ওঠায় ঘুমন্ত অবস্থা থেকে এক মুহূর্তে জেগে উঠলাম আমি।
নিশ্চিত না হলেও, বুঝতে পারছিলাম তখনও ভোর রাত, আনুমানিক সাড়ে পাঁচটা বাজে। এসময় কে হতে পারে? মনটা কুডাক ডেকে উঠলো, ভাস্কর না তো! হাতে নিয়ে অবাক হলাম, ততদিনে যোগাযোগ কেন্দ্রের পর্দা দেখেই বুঝতে পারি কোন ঘর থেকে ফোনটা এসেছে। ০২ নাম্বার ঘর থেকে, ঝর্ণা আর বারিধি - দুই যমজ বোনের বাসা। বিচ্ছু একেবারে দুটো পিচ্চিই, তবে সবচাইতে বড়ো শয়তান হলো তাদের ভাই, বর্ষণ। সাধারণ কোনও ঘটনা না বুঝতে পেরে দ্রুত পর্দায় স্পর্শ করে যোগাযোগ শুরু করলাম আমি, ওইপাশ থেকে বর্ষণের কান্না ভেজা গলার আওয়াজ ভেসে আসলো। শান্ত হয়ে পুরোটা সময় ওর কথা শুনে গেলাম আমি। উঠে যখন আব্বুকে ডাক দিলাম আস্তে করে, টের পাচ্ছিলাম হাতগুলো অল্প অল্প কাঁপছে আমার।
আব্বু অবশ্য কয়েকবার ডাকে দিতেই উঠে বসলো, সাথে আম্মুও একরকম লাফিয়ে উঠলো। দুজন প্রায় একই সাথে প্রশ্ন করল আমাকে, "কি হয়েছে?"
"আব্বু, বর্ষণ ফোন দিয়েছিল। ওর আব্বা-আম্মা দুইজনই নাকি গতরাত থেকে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। খুব অনুরোধ করছে, তুমি যেন একটু যাও ওদের ঘরে। ছেলেটা খুব ভয় পাচ্ছে, একা তো। বোনদুটোকে বাসার বাইরে বের করে দিয়েছে এরমধ্যেই, ঘরে থাকতে দিচ্ছে না। ও নিজে অবশ্য ভেতরেই আছে ওর বাবা-মায়ের পাশে," বলে থামলাম আমি। ওদের দুজনের চোখে নিখাদ আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখলাম।
আম্মু আগে কথা বলে উঠল, "তুমি ওর সাথে যোগাযোগ করে বলো তোমার আব্বুও এখন অসুস্থ, যেতে পারবে না।" জানি আম্মু কেন বলছে কথাটা, এটাও জানতাম এখন আব্বু কি করবে।
ঠিক তাই হল, হাত তুলে আম্মুকে চুপ করতে ঈশারা করল আব্বু। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "লক্ষণ দেখে কি মনে হচ্ছে বলেছে?"
আমি কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললাম, "হ্যাঁ, বলেছে।"
আব্বু আর কোনও প্রশ্ন করল না, শুধু আম্মুর দিকে তাকালো একবার। আম্মু ততক্ষণে আব্বুর হাত ধরে ফেলেছে শক্ত করে। অবশ্য, সে নিজে এই লোকটাকে চেনে। আমার চাইতে ভালো করেই চেনে। হাজার হোক, বাইশ বছর ধরে সংসার করছে তার সাথে।
"আমাকে যেতে হবে রেহানা। এটা আমার দায়িত্ব। প্রত্যেক ডাক্তারের নেয়া শপথের অংশ এটা। আমাকে যেতেই হবে।"
"না, এখনই ছুটে যাওয়ার দরকার নেই তোমার। আগে নিয়ন্ত্রক সদস্যর সাথে যোগাযোগ করি, দেখি কি বলেন তিনি," আম্মুও নাছোড়বান্দা। আমি জানি কেন এমনটা করছে আম্মু। আমার চোখের সামনেও যেন সেই বছর তিনেক আগের বিভীষিকাময় দিনগুলো ভেসে উঠছিল।
হঠাৎ করে আমার হাতে থাকা যোগাযোগ কেন্দ্রের পর্দাটা লাল হয়ে জ্বলে উঠলো, চমকে উঠলাম আমি। জানি, স্থানান্তর মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা দেয়ার সময় এমনটা হয়। "১৫১ঘ হতে ২০০ঘ নং পাড়ার বাসিন্দাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমি আবারও বলছি, ১৫১ঘ হতে ২০০ঘ নং পাড়ার বাসিন্দাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আপনাদের বিশেষ অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, এসকল পাড়ার ঘরসমূহে সরবরাহকৃত বাতাসের কেন্দ্রীয় পরিশোধন কেন্দ্রে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে গতকাল রাতে দূষিত বাতাস ঘরগুলোতে প্রবেশ করেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত, আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেনাবাহিনীর বিশেষায়িত দল পাড়ায় পাড়ায় রেকি চালাবে ও শনাক্তকৃত রোগীদের সরিয়ে বাকীদের জীবাণুমুক্ত করণ প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। সকলকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য বলা হচ্ছে। ধন্যবাদ।"
"দূষিত বাতাস, দুঃখিত, ধৈর্য," বিড়বিড় করে বলে গেলো আম্মু, চোখের দৃষ্টিতে কেমন যেন শূন্যতা এসে ভর করেছে। "এখন কি হবে তানভীর? আমার নিজের কথা নিয়ে ভাবছি না আমি। কিন্তু, চোখের সামনে তোমাকে আর সূর্যপ্রিয়াকে মারা যেতে দেখতে পারবো না আমি। পারবো না।"
বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো আমার। খুব সম্ভবত যখন আমার, পাঁচ কি ছয় বছর বয়স ছিল তারপর এই প্রথম আমাকে পুরো নাম ধরে ডাকলো আম্মু। আব্বুর মুখটা কেমন শক্ত, কঠিন লাগছে আমার কাছে। মুখের চোয়াল-দুটো চেপে বসেছে। চোখে শান্ত দৃষ্টি কিন্তু আড়ালে চাপা ভয়ের চিহ্ন আমার চোখ এড়ালো না। হাতের আঙ্গুলগুলোকে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে আব্বু, তারপরও হালকা কাঁপছে সেগুলো। বুঝতে পারছি নিজের ভেতরের প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ, হতাশা আর অসহায়ত্ব তেড়েফুঁড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে আমার নিরীহ, শান্ত আব্বুর ভেতর থেকে। সেটাকে থামিয়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে আব্বু। অবশ্য আমার বুকের ভেতরেও তো একটা পাগলা ঘোড়া দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ভয়ে যে এখনো অজ্ঞান হয়ে যাইনি সেটাই ভাগ্য।
"আমি বর্ষণদের বাসায় যাচ্ছি," শান্ত স্বরে বলল আব্বু।
"তানভীর, কি বলল..."
আব্বু হাত তুলে মাঝপথেই থামিয়ে দিল আম্মুকে, "যাই বলেছে ঘোষণায় তার আসলে কোন অর্থ নেই। তুমি নিজেও শুনেছ। প্রত্যেকটা বাসাতেই দূষিত বাতাস প্রবেশ করেছে, এমনটাই ধরে নাও। জীবাণু যদি এসে থাকেই, তবে এতক্ষণে আমি-তুমি, আমরা সবাই আক্রান্ত হয়ে গেছি। কাজেই আমার যাওয়া-না যাওয়ার সাথে জীবাণু সংক্রমণের কোন সম্পর্ক নেই।" কথা শেষে উঠে দাঁড়ালো আব্বু। বাসাতে আলো জ্বলে উঠেছে এরই মধ্যে, নিশ্চয়ই বিশেষ পরিস্থিতির জন্য। বাথরুমে গিয়ে হাতে-মুখে পানি দিয়ে, কাপড়টা পালটে, এঘরে এসে খাটের নীচে থাকা তার ডাক্তারির ব্যাগটা টেনে বের করল আব্বু। আম্মুর মাথায় হাত বুলিয়ে, আমার কপালে চুমু দিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো কথা না বাড়িয়ে।
জীবাণু সংক্রমণ - কি ভয়ংকর একটা সত্য অবলীলায় বলে গেল আব্বু। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে আমার, ভীষণ ভয় লাগছে। আব্বু চলে যাওয়ার পর আম্মুকে সামলে রাখাটাই দায় হয়ে গেল। চিৎকার করে কাঁদতে থাকলো আম্মু, একসময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। তারও পর সব শক্তি হারিয়ে বিছানায় শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদলো। আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ, এরপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। আগেই ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি আম্মুকে যাতে এই সময়টুকু ঘুমিয়ে পার করে দেয়। আম্মুর মতন ভালো মানুষ কখনো দেখিনি আমি, কিন্তু সবসময় মানসিকভাবে একটু বেশি দুর্বল ছিল আম্মু, ভয় পায় আমাদের নিয়ে, আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। পৃথিবীপৃষ্ঠে থাকাকালীন তো একবার মনঃচিকিৎসকের সাহায্যও নিতে হয়েছিলো আম্মুকে, জীবাণু যখন প্রথম হামলা চালায় বাংলাদেশে। আম্মু ঘুমিয়ে পড়ার পর, যোগাযোগ কেন্দ্রটা হাতে নিয়ে ভাস্করের সাথে যোগাযোগ করলাম আমি।
সংযোগ হওয়া মাত্র ওইপাশ থেকে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার আর হুড়োহুড়ির শব্দ ভেসে আসলো।
"সরি। ভিডিকন চালু করতে পারছি না এই মুহূর্তে। আব্বু রাগে উন্মাদ হয়ে গিয়েছে, বাসার সব জিনিস ভাংচুর করছে," ভাস্কর আস্তে করে বলল।
"তুমি ঠিক আছো তো? জ্বর কিংবা মাথাব্যথা নেই তো? কিংবা সর্দি? শ্বাসকষ্ট?" আমি প্রশ্ন করলাম, যেকোনো দুঃসংবাদের জন্য প্রস্তুত।
"না, আমি ঠিক আছি। তোমার কি অবস্থা? আর আঙ্কল-আন্টির?" ওর জবাব শুনে এর মধ্যেও একটু সাহস পেলাম আমি।
"আব্বু বাইরে বের হয়েছে। ০২ নং ঘরে গিয়েছে, বর্ষণের আব্বু-আম্মুকে দেখতে। এরপর অন্য বাসাগুলোতেও যাবে, আমার যা মনে হয়। আম্মু কান্নাকাটি শেষে এখন ঘুমিয়েছেন। আসলে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। আর আমি, ভালো আছি। চিন্তা করো না।"
"আমি তোমার বাসায় আসছি। এখানে এরকম অমানুষিক পরিবেশ সহ্য করতে পারছি না আমি," ওর গলায় তিক্ততার সুরটা টের পেলাম। কথা শুনতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল আমার। বুঝতে পারছি, ভাস্করের বাবা ঘোষণাটাকে শান্তভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি, উনাকে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। অবশ্য তা নিয়ে আর মাথা ঘামালাম না।
"চলে আসো, আমি আছি।" বললাম ভাস্করকে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই ভাস্কর বাসায় এসে হাজির হলো। মাথার চুল এলোমেলো, চোখগুলো রক্তাভ - রাতের ঘুম ঠিকমত শেষ হয়নি মনে হয় ওর-ও। আমি দরজা খোলা মাত্র আমাকে জড়িয়ে ধরল সে। কানে কানে ফিসফিস করে বলল, "আমি মারা যেতে চাইনা সূর্যপ্রিয়া। আমার মৃত্যুর কথা ভাবতে অনেক ভয় লাগে। এখনই মারা যেতে চাই না আমি।"
"আমিও না," ওকে সাহস দেয়ার জন্য বলতে গেলাম আমি, গলা ভেঙ্গে গেলো অবশ্য।
"কখনো আব্বার কথা বিশ্বাস করতাম না আমি, এবার করেছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে, হয়তো ঐ জীবাণুগুলোকে মাটির ওপরেই ফেলে রেখে এসেছি আমরা। কিন্তু না, আমাদের পিছু নিয়েছে ওগুলো। আমাদের শেষ না দেখে ছাড়বে না," কম্পিত গলায় বলতে থাকলো ভাস্কর।
বুঝতে পারছি আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, মৃদু কাঁপছিও আমি - কান্নার দমকে কিংবা ভয়ে, "আমার কাছে মনে হতো এসবই যেন একটা দুঃস্বপ্ন। একসময় সব শেষ হবে, রাত শেষ হবে, ভোর হবে। আমরা আবার উপরে ফিরে যাবো, সূর্যের আলোর নীচে।" ওকে শক্ত করে ধরে রাখলাম আমি। আমরা দুজনই দুজনকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। যে শ্বাস বুক টেনে নিচ্ছি, সেই শ্বাসই জীবাণুর বাহক হয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মৃত্যুর কারণ হতে পারে এই ভাবনাটা মাথায় আসতেই সব এলোমেলো লাগছে। ওকে কাছে টেনে নিতে চাইছিলাম আমি, ওকে চুমু খেতে চাইছিলাম, আমার বুকে ওর মাথা চেপে ধরে বলতে চাইছিলাম আমি আছি ওর পাশে। কিন্তু, সেটা সঠিক সময় ছিল না। মানসিকভাবে আমরা দুজনই ভেঙ্গে পড়েছিলাম। পিছনে আম্মু শুয়ে আছে, আব্বু যে কোনও মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে আর সবচাইতে বড়ো কথা আমার অতটা সাহস কোনকালেই ছিল না।
সারাদিন আমাদের ঘরেই থাকলো ভাস্কর। দিয়ে যাওয়া খাবার ভাগ করে খেলাম আমি আর ভাস্কর। আব্বু যে কোথায় আছে জানিও না, আম্মুকেও আর ডেকে তুললাম না। টানা ঘুমিয়ে কাঁটালো আম্মু। রাত্রেও এখানে থেকে গেলো ভাস্কর। আমার বিছানাটা ওকে ছেড়ে দিয়ে আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমলাম। সকালে যখন উঠলাম, টের পেলাম আম্মুর শরীরে মারাত্মক জ্বর এসেছে। ঘুমের মধ্যে কয়েকবার বিড়বিড় করতে, কেঁপে উঠতে দেখলাম আম্মুকে। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি, দুর্ভাগ্য হানা দিয়েছে আমাদের ঘরেও বুঝি।
আব্বু ফিরে আসলো তার একটু পরেই। আম্মুকে ডেকে তোলার চেষ্টা করছি তখন আমি। গতকালের খাবার গরম করে নিয়েছি সেই সাথে নিয়েছি সকালে বাক্সে দিয়ে যাওয়া প্রতিষেধক ওষুধ যা কাজ করার সম্ভাবনা ১১ শতাংশ মাত্র। আব্বুকে দেখে চোখে পানি চলে আসছিল আরেকটু হলে আমার। একদিনেই যেন বুড়িয়ে গেছে আব্বু। চুল এলোমেলো, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি, চোখের নীচে কালো দাগ পড়ে গেছে। পরিশ্রান্ত আর হতাশ অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছিলাম খবর খুব একটা ভালো না।
"কি খবর বর্ষণের আব্বু-আম্মুর?" প্রশ্ন করলাম আমি, মনে মনে উত্তরটা আগেই যেন জানা।
"গতকাল রাতেই মারা গেছে, দুইজনই। বর্ষণ নিজেও ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিছুই করার নেই আমার, এতটা অসহায় লাগছে। অবশ্য, দুই যমজ বোন ভালো আছে এখন পর্যন্ত। ওদেরকে ০৪ নং বাসায় দিয়ে এসেছি আমি। সুস্মিতা আপা দেখে রাখবেন।"
"এত তাড়াতাড়ি, আর বর্ষণ তাই বলে? এতটুকু একটা ছেলে," কাঁদতে শুরু করলাম আমি।
আমার কাঁধে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরল ভাস্কর, "আমাদের কি একেবারেই কিছু করার নেই? এভাবে বসে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে?"
"জানিনা বাবা। ভাগ্যে কি লেখা আছে আল্লাহ মালুম। এখনও তো সেনাবাহিনী থেকে কেউ আসলো না, মৃতদেহগুলো সরিয়ে না নিলে তো জীবাণু আরও ছড়িয়ে পরবে।" মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে অবসন্ন স্বরে বলল আব্বু। "ভালো কথা, প্রিয়ামণি, তোর আম্মুর কি অবস্থা?"
"ভালো না আব্বু," আর সহ্য করতে পারছিলাম না আমি। ঝাঁপিয়ে পড়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।
'ভালো না' কথাটা এই অসুখের বর্ণনার জন্য উপযুক্ত শব্দ ছিল না। দুপুর নাগাদ আম্মুর কাশি শুরু হলো, মনে হলো একেক সময় কাশতে কাশতে ভেতর থকে ফুসফুসটাকেই বের করে ফেলতে চাইছে আম্মু। ঘুম ভেঙ্গেছে আম্মুর, তার মুখে তুলে খাওয়ানোর সব চেষ্টা বিফল হয়েছে। বিছানা থেকে উঠার শক্তিটুকুও ছিলো না। আম্মুর মুখে আর কখনো আমার নাম ধরে ডাক শোনা হলো না। সূর্যপ্রিয়া বলে যদি আর একবার ডাক দিতো আম্মু, কিছুটা হলেও তার ভালোবাসার ছোঁয়া পেতাম সেই ডাকে। দূর থেকে দুয়েকবার আমার দিকে তাকালো আম্মু, কাছে যেতে দিলো না আব্বু কিছুতেই। হাত ধরতেও না। তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখলাম এক পা, এক পা করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমার জন্মদাত্রী মা। বিকাল থেকে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলো আম্মুর। কাশির সাথে দমকে দমকে রক্ত বেড়িয়ে আসছে। মধ্যরাতের দিকে সকল কষ্টের অবসান ঘটিয়ে আম্মু মারা গেলো। আরও দুই ঘণ্টা আগে থেকেই আমি মনে মনে চাচ্ছিলাম যতটা দ্রুত সম্ভব যেন মারা যায় আম্মু। কষ্টটা চোখে দেখার মত ছিল না, সহ্য করার মত ছিল না।
কাছাকাছি সময়ে বর্ষণও মারা গেলো। আশেপাশের বাসা থেকেও কান্নার শব্দ ভেসে আসছিলো। কাঁথার নীচে আমাকে জড়িয়ে ধরে পাড়ার উন্মুক্ত স্থানে, সেই বেঞ্চিতে বসে থাকলো ভাস্কর। গভীর রাতে ওর আম্মু, অন্বিতা আন্টিকে হেটে আসতে দেখা গেলো। আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিছুক্ষণ, তারপর ভাস্করের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, "ঘরে একটু আসতে হবে যে, বাবা। তোমার আব্বা আর পৌষালী- দুজনই অসুস্থ। এই সময়টা তো পাশে থাকতে হয় বাবা। আর তো কখনো দেখা হবে না।"
ঝট করে দাঁড়িয়ে গেলো ভাস্কর, কি যেন বলতে গিয়েও বলল না। ফিরে আমার দিকে তাকালো সে। ওর উদভ্রান্ত চোখ, আর তার পেছনে চাপা কষ্ট দেখে বুঝতে পারলাম আমি ওর না বলা কথা, উঠে ওর হাতটা ধরে আন্টির দিকে তাকিয়ে বললাম,"সাথে আমি আসি, আন্টি?"
অন্বিতা আন্টি নীরব থেকে একটু পর বললেন, "দুজনই কিন্তু অসুস্থ, প্রিয়া। ভেবে দেখো।"
আমি মৃদু হেসে বললাম, "এসব ভেবে এখন কোন লাভ আছে কি আন্টি? আব্বু তো সবার বাসাতেই গিয়েছেন, আম্মুও মারা গেলেন। এখন পর্যন্ত সুস্থ আছি আমি। হয়তো, জীবাণুর আমাকে পছন্দ হয়নি। এযাত্রা বেঁচে যাবো ইনশাআল্লাহ।"
এতটা নিশ্চয়তার সাথে কথাটা বলা উচিত হয়নি আমার।
---
বিকেলবেলা ভাস্করের বাবা মারা গেলো। রাতের বেলা পৌষালী। পাথরের মতন ভাবলেশহীন মুখ করে সব দেখলো ভাস্কর। ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম আমি। একা থাকার কথা বলে একটু পর হেঁটে বাইরে চলে গেলো সে, অন্বিতা আন্টিকে স্তব্ধ অবস্থায় রেখে আমিও ফিরে আসলাম। ঘরে না ঢুকে বাইরেই, করিডোরের মেঝেতে বসে থাকলাম, আম্মুর মৃতদেহের দিকে তাকাতে পারবো না এখন আমি। মাঝরাত নাগাদ সারা গা কাঁপিয়ে জ্বর আসলো। এরপরের ঘটনা কিছুই আমার মনে নেই। সবই ঝাপসা, ঘোলাটে। কাজেই ঠিক করে লিখতে পারছি না। ঐ সময়ের অন্যসব ঘটনা আমার মাথায় থাকলেও অসুস্থ থাকার সময়ের কথা কিছুই স্মৃতিতে নেই। শুধু ছাড়া ছাড়া মনে পড়ছে, ভাস্কর আমার পাশেই চেয়ার টেনে বসে আছে, আব্বু আমার বিছানায় বসে আছে। চোখগুলো ভেজা, নিশ্চয়ই কান্না করেছে আমার জন্য। মুখ দেখে মনে হচ্ছে পুরোপুরি হেরে যাওয়া একজন মানুষ। কাশতে কাশতে ঘুম থেকে উঠে বসছি আমি, জ্বর-তপ্ত মাথা ধুয়ে দিচ্ছে কেউ। সর্দি জমে নাক বন্ধ হয়ে আছে, কেউ একজন কাপড় গরম পানিতে ভিজিয়ে নাক পরিষ্কার করে দিচ্ছে। শ্বাসকষ্ট যখন শুরু হলো, এক ফোটা, এই এতটুকু বাতাসের জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছিল আমার। কি যে কষ্ট - এখনো ভাবলে ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে।
মৃত্যুর এতটা কাছে চলে গিয়েছিলাম আমি যে ফিরে আসবো তার আশা কেউ করেনি। আব্বু না, ভাস্কর না, কেউই না। কিন্তু পাঁচদিন পর বিছানায় উঠে বসলাম আমি। প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছি। জীবাণুর সংক্রমণ থেকে ভূগর্ভস্থ পৃথিবীর প্রথম বেঁচে ফেরা মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে একমাত্র উদাহরণও ছিলাম। অনেকে অসুস্থই হতো না, কিন্তু একবার অসুস্থ হলে ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছে ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে প্রথমে মনে হচ্ছিল নিজের বাসাতেই আছি। পরে বুঝতে পারলাম, ১০ নাম্বার ঘরে আছি আমি। অসুস্থ সবাইকে এই ঘরে নিয়ে আসা হয়েছিলো অস্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র করে। কেউই বাঁচে নি। শেষ পর্যন্ত শুধু আমি টিকে ছিলাম। সেনাবাহিনীর সেই দল কখনও আসেনি আমাদের জন্য। বেঁচে থাকা কয়েকজন মিলে করিডরের সিমেন্টের স্ল্যাব খুড়ে, মাটির নীচে গর্ত করে একে একে সবাইকে কবর দিয়েছিল। আমার কথা ভেবেই তখনও সেই স্ল্যাবের মুখ বন্ধ করা হয় নি। জানা গেলো, আমাদের এই পাড়ার মাত্র এগারো জন বাসিন্দা শেষ পর্যন্ত বেঁচে আছে। আব্বু, অন্বিতা আন্টি, ভাস্কর, আমি, যমজ দুই বোন, সৌহার্দ্য আর নেহাল আংকেল, সীমন্তি, শৈবাল আর সুহৃদ।
সবাই মিলে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা, এই ঘর, এই পাড়া থেকে বের হতে হবে। শুধু তাই না। ২০০ঘ নং পাড়া পর্যন্ত ছড়ীয়ে পড়েছে জীবাণু। এখান থেকে দূরে সরে যেতে হবে আমাদের, যদি বাঁচতে চাই। যোগাযোগ কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ পদ্ধতি হ্যাক করলো নেহাল আংকেল। যোগাযোগ হলো আরও অনেকের সাথেই। বিশেষ করে, নির্দিষ্ট একদল লোকের সাথে কথা হলো আমাদের যারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিল 'বিপ্লবী সংঘ' বলে। আমাদের বায়ুস্তর ভেদ করার পদ্ধতি শিখিয়ে দিল তারা। রাতের মধ্যেই নিজেদের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। এক মুহূর্ত বাড়তি সময় থাকা যাবে না এখানে, ঠিক করেছিলাম সবাই মিলে। হ্যাক করার কথা টের পেলে সেনাবাহিনী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসবে সেটা নিয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। এরপর হাঁটা শুরু হলো। একের পর এক পাড়া, গ্রাম, ইউনিয়ন পার হয়ে আসলাম আমরা। একসময় জানলাম, এই স্তরের নীচেও আরেকটা স্তর আছে পাতালে। সেখানে যাওয়ার নির্দেশনা পেলাম আমরা সংঘের থেকেই। আমাদের জলদি হাঁটতে বলল তারা, নতুন একটা টিকা আবিষ্কার করেছে নিরাময় মন্ত্রণালয়। কিন্তু, তার প্রাথমিক পরীক্ষার ফলাফল ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। মানুষকে সুস্থ করার বদলে রূপান্তরিত করে দিচ্ছে টিকাগুলো। সেই টীকা পরীক্ষার জন্যই নাকি নিজেরাই স্যাবোটাজ করে পাড়ায় পাড়ায় জীবাণু ছড়িয়ে দিয়েছে তারা।
আমাদের লুকিয়ে থাকতে হবে। তাই সেই গোপন প্রবেশপথ দিয়ে ভূ-অভ্যন্তরে আরও এক স্তর নীচে নেমে আসলাম আমরা। দেখে বুঝা যাচ্ছিল, এখানের পুরো স্তরটাই মানুষ নিজের হাতে খুঁড়ে খুঁড়ে তৈরি করেছে। চিকন চিকন সুরঙ্গ, সুরঙ্গের মাঝে খোপ খোপ ঘর। এক পথ থেকে আরও দশ পথ, শত শত, হাজার হাজার সুড়ঙ্গ। এখানে মানুষ বাইরের কারও সাহায্য ছাড়াই, লড়াই করে, পরিশ্রম করে টিকে আছে। অজ্ঞাতপরিচয় আমাদের দেখে তাদের চোখে সন্দেহের দৃষ্টি ফুটে উঠছিল, তাদের আচরণও ঠিক বন্ধুবৎসল ছিলো না। যোগাযোগ কেন্দ্রের কোন সংযোগ এখানে পাওয়া যাচ্ছিল না। আগে দেওয়া পথের বর্ণনা মনে করে পথে এগিয়ে চলছিলাম আমরা।
অসংখ্য মোড়-বাঁক পারি দেয়া শেষে, শখানেক কিলো অন্ধকার সুড়ঙ্গ হেটে পার হয়ে আসার পর, একসময় বিপ্লবী সংঘের একটা ঘাঁটিতে এসে পৌঁছুলাম আমরা। আব্বু ডাক্তার শুনে তাদের খুশি আর ধরে না। এই ছোট দলে তখন একজনও ডাক্তার ছিলো না। যাত্রা শুরু করার বারো দিন পর প্রথম খাবার পেটে ঢোকালাম আমরা। এই বারো দিন ভাস্কর আমার পাশাপাশি হেঁটেছে। হাতে ধরে রেখেছে সারাক্ষণ, যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি পিঠে তুলে হেঁটে গেছে ক্রমাগত। থামার উপায় ছিল না আমাদের, পালাচ্ছিলাম আমরা তথাকথিত নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে নিজেদের আবাসের খোঁজে। এখানে যারা ছিল, বিপ্লবী সংঘের সদস্যরা, সবাই যাকে বলে খেটে খাওয়া মানুষ। রিকশাচালক, কুলি, মজুর, মিস্ত্রি, রাস্তায়, স্টেশনে বা বস্তিতে দিন কাটানো মানুষজন। ভূগর্ভস্থ আবাসস্থলে যখন একে একে সকলকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল, তখন এদেরকে বাড়তি বোঝা মনে করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিলো। তাই তারা নিজেরাই পথ খুঁজে নিয়েছে বাঁচার। এখানে, পাতালের এই দ্বিতীয় স্তরে বিপ্লবী সংঘের ক্ষমতা ঠিক সরকারের পরেই।
আব্বু আসা মাত্রই ঘুরে ঘুরে অসুস্থ সবার পরিচর্যা শুরু করেছিলেন। ভাস্কর আর আমি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সবকিছু। অনেকের থেকে অনেক কথাই শুনছিলাম আমরা। কিভাবে, সরকারের উপর মহলের সকলে নিজেরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে আর সবাইকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিচ্ছে। কিভাবে সাধারণ মানুষকে গিনিপিগের মতন ব্যবহার করা হচ্ছে। কিভাবে, মৌলিক চাহিদা বঞ্চিত মানুষেরা আবার সেই আদিম সমাজে ফিরে গিয়েছে, সভ্যতা নতুন করে যাত্রা শুরু করছে এই পরিবর্তিত পৃথিবীতে। ভাস্কর থমকে দাঁড়ালো চার সুড়ঙ্গের সংযোগস্থলে, চার দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় ছায়াঘেরা ফ্লুরোসেন্ট আলো-নিকষ আঁধারের মধ্যে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই দেখা যাচ্ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল সে, "এটাই সূর্যপ্রিয়া। এটার কথাই বলছিলাম আমি। আমরা মানুষ। দুমরে মুচড়ে আমাদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করতে পারে যে কেউই, কিন্তু আমাদের পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলতে পারবে না কখনও। আবার আমরা সৃষ্টির সেরা হয়ে উঠবো, দেখে নিও। ঐ ঘরে, ওই চিড়িয়াখানার খাঁচাতে আর ফিরে যাচ্ছি না আমি।"
"আমিও যাবো না, তোমার সাথে, তোমার পাশেই আছি আমি। সারাজীবন," ওর হাত ধরে বললাম আমি।
"তুমি না চাইলেও আমার পাশে থাকতেই হবে তোমার। কারণ তুমি আমার," ভাস্করের কথা শুনে চমকে উঠে ওর দিকে তাকালাম আমি। ওর চোখের মণিতে পিছন থেকে ভেসে আসা আলোর প্রতিচ্ছবি ঢেউ তুলছে। কেমন কঠিন, উদ্ধত, দুর্বিনীত বলে মনে হচ্ছে ওকে। যেন ও অদম্য, অপরাজেয়। কোন বীর যেন যুদ্ধজয় শেষে নিজের পুরষ্কার দাবী করছে। আমার কোমরে হাত দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিলো সে, চিবুকের নীচে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে ধরল। আমি বাঁধা দিলাম না, বাঁধা দেয়ার শক্তি ছিল না আমার, ইচ্ছাও ছিল না। এমনভাবে আমাকে চুমু খেলো সে যেন সেটা ওর অধিকার, ওর দাবী -আদায় করে নিচ্ছে কেবলমাত্র। ওর মাথার রুক্ষ চুলগুলো আঁকড়ে ধরলাম আমি। আর কিছুই এখন আমাকে দূরে সরাতে পারবে না ভাস্করের থেকে। যোগাযোগ কেন্দ্র থেকে প্রথম ভেসে আসা ওর কণ্ঠ শুনেই মনে হয়েছিলো, আমার জন্যই জন্ম হয়েছে এই ছেলেটার। আমার ঠোঁটে এর আগে কেউ এমনভাবে ছোঁয়ায় নি নিজের ঠোট, কেউ এভাবে আমাকে নিজের করে চায়নি। আমিও কখনো এভাবে অন্য কারো হয়ে যাইনি। এখনও সেই চুমুর স্মৃতি মনে আছে আমার, যেন মাত্রই ঘটেছে ব্যাপারটা। সারাজীবন এমন একটা চুমুর, এমন একটা স্পর্শের জন্য তৃষ্ণার্ত থাকে মানুষ। দুজন যখন থামলাম, মনে পড়ল শ্বাস আটকে রেখেছিলাম এতক্ষণ। আস্তে আস্তে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম আমি। তাকিয়ে আছি ভাস্করের দিকে। ভাস্কর আমার নাকে নাক ঘষে বলল, "অনেক আগেই চেয়েছিলাম... কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম... যদি হারিয়ে ফেলি তোমাকে।"
"ভয় নেই, আমি হারিয়ে যাবো না তোমার জীবন থেকে। কখনোই।"
সেই রাতে বিপ্লবী সংঘের সাথে আলোচনায় বসলাম নতুন যোগ দেয়া সকলে। নির্দিষ্ট কিছু কাজ করে টিকে থাকতে হবে এখানে, তার বদলে থাকার জন্য একটা ছোট্ট জায়গা দেয়া হবে, দেয়া হবে অল্প কিছু রেশনও। ভাস্করই প্রথম উঠে দাঁড়ালো। যখন কথা বলল, মনে হলো কি বলছে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা রাখে সে, "আমাদের ধরে নিতে হবে আমরা এখন হাজার বছর পিছিয়ে গিয়েছি, আদিকালে, সেই সভ্যতার শুরুতে অবস্থান করছে মানবজাতি এখন। কাজেই সেই আদিম কালের গোত্রগুলোর মত নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিতে হবে। কেউ ঘর বানাবে, কেউ চাষাবাদ করার চেষ্টা করবে, কেউ সুড়ঙ্গ আর বাসা খুঁড়বে, একদল নিজেদের প্রশিক্ষিত করে তুলবে ভবিষ্যতের লড়াইয়ের জন্য।"
অনেকেই হেসে উঠলো ওর কথা শুনে, কিন্তু সংঘের এই দলটার নেতা, সিদ্দীকুর ভাই, শান্ত গলায় জানতে চাইলেন, "অনেকেই আছে যারা এর মধ্যে কোন কাজই করতে সক্ষম না। তারা কি করবে?"
"তারা সংসার করবে, সন্তান জন্ম দেবে। এটাও অত্যন্ত জরুরী কাজ এমুহূর্তে। মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক-ভাবে কমে গিয়েছে জীবাণুর আক্রমণে। আমাদের জনসংখ্যা বাড়াতে হবে, নিয়ন্ত্রিতভাবে অবশ্যই। প্রজন্মান্তরে আমাদের উত্তরসূরিদের মধ্যেই প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে জন্ম নেবে কেউ না কেউ। আমাদের শুধু অপেক্ষা করতে হবে, লড়াই করতে হবে, টিকে থাকতে হবে।"
সবাই আলোচনা শেষে ভাস্করের সিদ্ধান্তই মেনে নিয়েছিল। একসময় বিপ্লবী সঙ্ঘের নেতা হয়েছিলো সে, কালে কালে সর্বাধিনায়ক। সবসময়ই ওর পাশে ছিলাম আমি। আব্বু মারা গিয়েছিল বছর দশেক পরে, অন্বিতা আন্টি তার দুই বছর পর। সীমন্তি আমার খুব ভালো বান্ধবী হয়ে উঠেছিল, এখনও তাই আছে। ঝর্ণা আর বারিধিও বেঁচে আছে এখনও, অনেকগুলো ছেলে-মেয়ের জন্ম দিয়েছে দুজন মিলে। ভাস্করকে দেয়া আমার প্রতিশ্রুতি আমি ঠিকই রেখেছিলাম। দুই বছর আগ পর্যন্ত।
আমার জীবনের দ্বিতীয় সূর্য, আমার ভাস্কর - সে বছর অস্ত যায়।
আমি ক্লান্ত এখন। ভীষণ ক্লান্ত। তাও লিখে যাচ্ছি আমার কাহিনী। আমার গল্প, আর আমার জীবন দুটোই সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার এই কাহিনী অনাগত কালের উত্তরপুরুষের জন্য, লিখে যাচ্ছি আমি। এ আমার কাহিনী, এ ভাস্করের কাহিনী যে মানুষকে নতুন করে সভ্যতার যাত্রা শুরু করতে পথ দেখিয়েছে, কৃষিকাজ শিখিয়েছে, নেতা হয়ে সামনে থেকেছে। আমার পরিবারের, মানুষের, সভ্যতার কাহিনী এটা। মানুষের ভালোত্ব-পশুত্ব সবই লিখে গেলাম। আমার কষ্টের কথা, অসহায়ত্বের কথা, পরিশ্রমের কথা, ভালোবাসার কথা। ফিনিক্সের মতন আগুনের মধ্য থেকে, ছাইয়ের মধ্য থেকে আবার জন্ম নিয়ে উড়ে বের হওয়া মানবসভ্যতার কথা। একটাই অনুরোধ, একসময় যখন মানুষ আবার জয়ী হবে, পৃথিবীপৃষ্ঠে উঠে আসবে, নিজেদের পৃথিবীতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করবে; সেদিন আমার এই ডায়েরি আর আমার ড্রইং খাতাটা কোনও এক মাঠে শিশির-ভেজা ঘাসের উপর ফেলে আসবে, যেখানে সূর্যকিরণ এসে ছুঁয়ে যেতে পারে তাদের। আমাকে না পারুক, আমার স্মৃতিরা ছুঁয়ে যাক সূর্যকে আরেকবার। এটাই আমার, সূর্যপ্রিয়ার শেষ ইচ্ছা।
(সমাপ্ত)
Image by Thomas Budach from Pixabay
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ৯:০৭