সময়টা মনে নেই, এটুকু মনে আছে আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি আর দৈনিক সমকালে লিখি। মাথায় ভুত চাপল হুমায়ূনের ইন্টারভিউ করব! আমার সম্পাদক শাহেদ ভাইকে বললাম ভাই হুমায়ূনের ইন্টারভিউ করব, তিনি কিছু একটা টাইপ করছিলেন; হঠাৎ তার আঙ্গুল থেমে গেল। আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে খেকিয়ে উঠলেন-যাও মিয়া! আসছে হুমায়ূনের ইন্টারভিউ করবে, হাতি ঘোড়া গেল তল আরিফ কয় কত জল! আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল! আমি নিচে চায়ের দোকানে বসে সিগারেট পোড়াতে লাগলাম একের পর এক। পাভেল ভাই এসে আমাকে দেখে বললেন ওই মিয়া কেডা মরছে কান্দ ক্যান! আমি করুণ মুখ করে বললাম-হুমায়ূন আহমেদ! ওনার হাত থেকে চা ছলকে পড়ে গেল; বেচারা আরিফ তখন কি জানত খুব শীঘ্রই এই চা ছলকানোর দিনটা আসছে...!
পাভেল ভাইকে ভড়কে দিয়ে আমার খুব আরাম লাগল! এরপরের কয়েকদিন আমি মরিয়া হয়ে হুমায়ূনের ফোন নাম্বার তালাশ করলাম এবং প্রথম আলোর এক সাংবাদিক বন্ধুর কৃপায় তা পেয়েও গেলাম! ফোন নাম্বার হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরি কিন্তু ফোন করার আর সাহস পাই না! ভয়ে ভয়ে শাহেদ ভাইকে বললাম, ভাই হুমায়ূনের নাম্বার পাইছি একটু ফোন দিবেন! উনি চকমকি পাথরের মত জ্বলে উঠেই নিভে গেলেন। বেজার মুখ করে বললেন, উনি আজাইরা কারো ফোন রিসিভ করেন না! পরপরই খেকিয়ে উঠলেন হুমায়ূন সম্পর্কে কি ‘বাল’টা জান তুমি, আবার ইন্টারভিউ করতে চাও...!
পরদিন রাতে জাহাঙ্গীরনগর সেন্ট্রাল ফিল্ডে হু হু বাতাসে একা বসেছিলাম, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে, কোন কথা নেই হনহন হেটে মাঠের শেষপ্রান্তে গিয়েই ডায়াল করলাম ০১৭৩... এখন আর নাম্বারটা মনে নেই! রিং হচ্ছে তো হচ্ছেই, মনে হল একযুগ পেরিয়ে গেল! কেটে যাওয়ার আগ মুহুর্তেই হুমায়ূন কন্ঠ ভেসে এল-হ্যালো! আমি যেন তড়িতাহত হলাম! গলা দিয়ে কোন আওয়াজই বেরোচ্ছিল না! দুই টাকার ফিচার রাইটার এত বড় রাইটারকে কি বলবে, চরম দার্শনিক সংকট! এই সংকট কাটার পূর্বেই তিনি ফোনটা রেখে দিলেন! বেকুবের মত পাক্কা একঘন্টা পায়চারি করলাম! শরীরের সব সাহস সঞ্চয় করে আবার ফোন দিলাম, এবার আর রিস্ক নিলাম না; হুমায়ূন হ্যালো বলার আগেই বললাম- ‘স্লামালিকুম স্যার, কেমন আছেন! তিনি বললেন কে? ভুলেও বললাম না সাংবাদিক, স্যার আমি আপনার ছাত্র’ আপনার সাথে সাক্ষাতে একটু কথা বলতে চাই! তিনি কোন ভনিতা না করেই বললেন, ঠিক সাতদিন পর একটা ফোন দিয়ে দুপুড়ের পর পরই চলে আসো, ভাত খেয়ে আসবা শুধু চা খাওয়াতে পারবো আর কিছু নাই, বলেই ঠা ঠা হাসি...!
এর পরের সাতদিন ছিল আমার জীবনে যাকে বলে ভয়ঙ্কর সাতদিন! শার্টের বোতাম খুলে বুক চিতিয়ে সমকালে গেলাম, খুব ভাব নিয়ে শাহেদ ভাইয়ের পাশের চেয়ারে বসলাম! রিভলবিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তারিয়ে তারিয়ে বললাম শাহেদ ভাই নেক্সট শনিবার দুপুড়ের পর হুমায়ূন টাইম দিছে! ছোটবেলায় তিন গোয়েন্দায় হরহামেশাই পড়তাম কথায় কথায় সবার কেমন চোয়াল ঝুলে পড়ে! সেদিন স্বচক্ষে দেখলাম কিভাবে শাহেদ ভাইয়ের চোয়ালটা ঝুলে পড়ল! ওখানে বেশিক্ষণ বসাটা ঠিক হবেনা ভেবে দ্রুত উঠে চলে আসলাম! নিচে চায়ের দোকানে আরাম করে বসে এককাপ চায়ের অর্ডার দিলাম, একটু পর পাভেল ভাই এসে বসলেন পাশে। পিঠে থাবা দিয়ে বললেন কি মিয়া এত খুশি ক্যান, আমি নিরিহ কন্ঠে বললাম হুমায়ূন স্যার টাইম দিছে, ওনার ইন্টারভিউ করব! উনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ওই মিয়া মজা নাও; প্রতিদিন প্রতিদিন বাইচলামি কর আমার লগে...!
সেই শনিবার আসার আগের রাতে হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠল গম্ভীর! আমি ফোনের দিকে তাঁকিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম শাহেদ ভাই! ফোনটা ধরলাম, ওপাশ থেকে শাহেদ ভাই মিনমিন করে বললেন, ‘আরিফ আমার জীবনের হিরো কে জান? আমি বললাম না, জানিনা! তিনি আরো মিনমিনে গলায় বললেন হুমায়ূন আহমেদ! বললাম আচ্ছা। এরপর তিনি তার আবদার পাড়লেন আমার কাছে-‘আরিফ আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল হুমায়ূনের ইন্টারভিউ করব! আমি যদি কাল তোমার সাথে যাই তুমি কি মাইন্ড করবা। ধরো ইন্টারভিউটা আমরা দুইজনে মিলা করলাম! আমি ওনার থেকও বেশি মিনমিনে কন্ঠে বললাম, ঠিক আছে শাহেদ ভাই! এরপর শাহেদ ভাই হুমায়ূন সম্পর্কে অনেক কথা বললেন, এইটা সত্যি উনি হুমায়ূন সম্পর্কে এত বেশি জানতেন তা সেদিনের আগে আমার কল্পনাতেও ছিল না! তিনি আমাকে সস্নেহে বললেন, রাতটা ভাব কি প্রশ্ন করবা, অভিক যাবে আমাদের সাথে ছবি তুলতে! আমরা কালকে এক্কেবারে কাঁপায় দিবো ঠিক আছে! আমার খুব ভাল লাগল, আমি বললাম ঠিক আছে ওস্তাদ...!
পরদিন হুমায়ূন আমাদের সাথে প্রাণভরে আড্ডা দিলেন! অনেক সময় নিয়ে তার ইন্টারভিউ করলাম। ছবিসহ ইন্টারভিউ ছাপা হল পুরো একপাতা জুড়ে। শাহেদ ভাই হুমায়ূনের কথা থেকেই হেডিং করলেন ‘আমেরিকানরা বাংলাদেশে আসার জন্য ভিসার লাইন দিচ্ছে, আমরা ভিসা দিচ্ছি না!’ (লেখাটা খুঁজে বের করব যেভাবেই হোক, নিশ্চয়ই ঘরেই কোথাও আছে!) হুমায়ূন বেশ কয়েটা বই দিলেন, লিখে দিলেন আরিফকে অনেক ভালবাসা! জানিনা বইগুলো এখন কার কাছে আছে! যার কাছেই থাকুক নিশ্চয়ই অনেক যত্নে আছে, আদরে আছে! আর বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে আছে দু’ টাকার ফিচার রাইটার আরিফের জন্য বড় রাইটার হুমায়ুনের ভালবাসা...!
২৩.০৭.২০১২
কাঁঠালবাগান।