তাসিনের মামা বাংলাদেশে ছিল। মামার বাসা ওদের বাসার কয়েক রাস্তা পরেই। এক সুন্দর সকালে সে বাসার প্রতিবেশী তাসিনদের ফোন করে বলে, মামার বাসায় পুলিশ। কি কান্ড, ওরা হন্ত দন্ত হয়ে ছুটে গেল সেই খালি বাসায়। গিয়ে দেখে বিতিকিচ্ছিরি কান্ড। বাসার প্রধান দরজা কপাট থেকে আলাদা করা, খান খান করে ভাঙা। ভিতরেও লন্ড ভন্ড কান্ড। আর বিকট গন্ধ.. কিছু একটার...
পুলিশ বুঝিয়ে বললো। কোন এক প্রতিবেশী এই গন্ধ পেয়েই ফোন করেছে পুলিশকে। ভেবেছিল, ভিতরে কোন হতভাগার লাশ গলে পঁচছে বুঝি। আসল কান্ড হল, মামার ফ্রীজ ভর্তি গরুর গোশত ছিল। ফ্রীজ ব্যাটা নষ্ট হওয়ার সময় পায় নি। কয়েক দিন অচল থাকার ফলে ভিতরের গোশত সব পঁচেছে। সেটাই এই বিকট গন্ধের জন্য দায়ী।
নাহ, এরকম কিছু অনুমান করতে পারে নি পুলিশ। খারাপটাই ভেবেছে। যে, ভিতরে কোন মৃতদেহ অযত্নে অবহেলায় পঁচছে। ভাববেই বা না কেন... এরকম ঘটনা কম ঘটছে না। বুড়ো বা বুড়ি একা থাকে ছোট্ট এক রুমের বাসায়। একা একাই শপিং করে, রান্না করে, খায়, ঘুমায়, গোসল করে, যৌবনের স্মৃতিচারণ করে। একা একাই টুপ করে মরে যায়। কারো জানার উপায় থাকে না। খবরে এসেছে একটা ছয় মাসের পুরানো লাশ উদ্ধারের ঘটনা। সেটাই সবচেয়ে খারাপ ছিল। দু'এক দিন অবহেলায় পড়ে থাকা লাশ খুব অস্বাভাবিক কিছু না।
গিয়েছিলাম রেড ক্রসের একটা ব্রিফিঙে। রমযানেরই কোন এক দিন। ডিলেকের সাথে। ও ড্রাইভ করে ইনস্টিংটের উপর। উত্তর না দক্ষিন দিকে, এই ভাবে। এই করে কখনও ভুল করে না। সেদিন করল! পৌছেছিলাম আধা ঘন্টা পরে। মহিলাটা বলছিল রেড ক্রসের ভূমিকার কথা। সমাজে যাদের যত্ন নেয়ার প্রয়োজন হয় তাদের ঠিক কি ভাবে যত্ন নেয়। বয়:বৃদ্ধদের কথা এসে পড়ল। এই সমাজে বয়:বৃদ্ধদের মূল সমস্যা দেখা শোনা করা আর নি:সঙ্গতা দূর করার মানুষ নেই। রেড ক্রস এই সমস্যার সাময়িক সমাধান হিসেবে ভলান্টিয়ার চায়। এক একজন ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব থাকে একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাকে প্রতিদিন সকালে ফোন করা। তাঁর অষুধ খাওয়া হল কি না খোঁজ নেয়া। সারাদিনের প্ল্যান জানা। যদি বুড়োবুড়ি ফোন না ধরে, তাহলে বুঝা যায় কিছু একটা হয়েছে। তখন রেড ক্রস চলে যায় বাসায়। অনেক সময়ই দেখা যায় মৃত। তখন সৎকারের ব্যবস্থা করে।
আবার কখনও অন্যধরণের সমস্যা হয়। সেই বুড়িটার মত... সত্তর বছরের বুড়ি বাথটাবে নেমেছিল গোসল করতে। গোসল সেরে খেয়াল করল উঠতে পারছে না বাথটাব থেকে। অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। ততক্ষনে পানি ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাত পা জমে আসছে। বুড়ি বাথটাবের পানি সব যেতে দিয়ে নতুন করে গরম পানি ভরে হাত পা গরম করল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল। রাত হল। সারা রাত এভাবেই কাটল পানি বদলাতে বদলাতে। ঘুমিয়ে পড়তে দিল না নিজেকে। ঘুমিয়ে পড়লেই সমস্যা। পানি পুরো ঠান্ডা হয়ে গেলে বুড়ো শরীরে হাত পা আর নাড়াতে পারবে না একদম। পরদিন সকালে ফোন আসল রেড ক্রসের ভলান্টিয়ার থেকে। বুড়ি ফোন ধরল না, পারল না বলে। রেড ক্রস চলে আসল খোঁজ নিতে। এভাবেই বেঁচে গেল একটা জীবন।
এরকম ঘটনা কম হয় নি। বাথরুমে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কত বুড়ো বুড়িকে বাঁচিয়ে দিল একটা ফোন।
আরেকটা ব্যবস্থা আছে, নার্সিং হোমগুলোতে যাওয়া। একজন ভলান্টিয়ার সপ্তাহে একদিন এক ঘন্টা নার্সিং হোমে একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার সাথে সময় কাটায়। সাধারন কথা বার্তা, খোঁজ খবর নেয়া, একটু হাত ধরে কথা বলা... এসব। একবার গিয়েছিলাম নার্সিং হোমে। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না... ওই বুড়িটা রোদে হা করে ঘুমাচ্ছিল, মুখে মাছি ঘুরাঘুরি করছিল। আরেক বুড়ো সুযোগ পেলেই বের হয়ে যেত সোজা রাস্তায়। আরেক বুড়ি আরেক জনের খাবার চুরি করত সুযোগ পেলেই।
মনটা আমার হু হু করছিল। এই মানুষগুলোই না কিছুদিন আগে কি সারা পৃথিবী চষে বেড়াতো। স্বপ্ন দেখত পৃথিবী বদলে দেওয়ার। ভালবাসত সব দিয়ে। দু:খ বিলাসে বিলাসী হয়ে কাঁদত। আকাশের ওই চাঁদটা দেখে পাগল হয়ে যেত...
এ সমাজের এই ক্ষতগুলো দেখতে মানুষের কত দিন লাগে! চোখে ঘোর লাগা মুগ্ধতা কাটবে কখন?
আমার নব্বই বছর বয়সী দাদুর কথা মনে পড়ল। দাদু কাউকে চিনে না এখন। সারা রাত গান গায়। মানে মনের কথাগুলোই সুর করে বলে যায়। মনোযোগ দিয়ে শুনলে ভালই লাগে। কারণ দাদুর মন:স্তত্ত এখন আটকে আছে আরও পঞ্চাশ বছর আগে। সেই সময়ের মত করে তাঁর ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সাথে কথা বলেন। স্বামীর সাথে কথা বলেন। অনেক আগে রেখে দেয়া কোন তর্ক শেষ করেন এখন নিজের মনের মত। শীতের রাতে বিছানায় শুতে নিয়ে চিৎকার। ভিজা বিছানা কেন? আসলে ঠান্ডা হয়ে থাকা বিছানা। টেস্টবাডহীন ঝুরঝুরে জিহবায় কিছু মজা লাগে না। আধা খেয়ে হাত ধুয়ে উঠে পড়েন। আর সে কি রাগ, আমাকে নষ্ট ভাত দিছিস ক্যান? টক টক লাগে। শান্তিমত খেতেও পারলাম না। নরম তুলতুলে স্যান্ডেলটা পায়ে দিয়ে সাথে সাথে পা সরিয়ে ফেলেন... 'প্যাক তো...'। কখনও শুধু শুধুই বলেন, আমি রোজা। বা জ্বর... খুব জ্বর। আসলে জ্বর থাকে না। একদম বাচ্চাদের মত অষুধ খেতে ভালবাসেন। একটা ভিটামিন দিয়ে দিলেই খুশি। 'বড়ি' খেয়ে অসুখ সেড়ে যায় যে!
এত যন্ত্রনার পরেও তো স্মৃতিহীন মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে আগলে রাখে সবাই... দাদু এখন আর হালকা রঙের শাড়ি পছন্দ করে না। আগের সময়ে আটকে আছে যে। খুব রাগ করে, আমি ইত্তা পড়ুম নাকি? রাঙা কাফড় পিন্দাম। তাই নিয়ে আমাদের হাসাহাসি। দাদুর সাথে খুনসুটি... নানুর সাথে খুনসুটি। সারা জীবন মা হয়ে ছায়া দিলেন তিনি, এতটুকু তো তাঁর প্রাপ্য... এই মানুষগুলো কেন বুঝে না! বস্তুবাদী ইনডিভিজুয়ালিজমের অভিশাপ কবে টের পাবে! ভলান্টিয়ার সমাধান তো স্থায়ী সমাধান না। আজ আছে তো কাল নেই। ভিতর দিয়ে ধ্বসে পড়ছে এই সমাজ ব্যবস্থা, ইনডিভিজুয়ালিজমের স্বার্থপরতা কি করে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে... কেউ কি দেখছে না?
রোমে থেকে রোমানদের মত হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না... নরম্যাটিভ স্ট্যান্ডার্ডহীন বিভ্রান্ত মানুষগুলোকে দেখে একটু্ও মুগ্ধতা আমার মনে দানা বাঁধে না। আমি মানুষ হতে চাই। অনুভূতিহীন যন্ত্র না। না না না।
ভলান্টিয়ার হিসেবে যোগ দিলাম এ রমজানেই।
সেই মানুষগুলোর উত্তরসূরী হওয়ার কথা আমাদের, যারা মনে করে, যা কিছুই আপাত দৃষ্টিতে নিজের জন্য খরচ করা হয়... নিজের খাওয়া বা পড়া, তা শেষ। সেগুলো বস্তুত: নিজের জন্য খরচ করা না। যা কিছুই বিলিয়ে দেয়া হয়, অন্যের জন্য, তাই আসলে 'নিজের' জন্য, কারণ আসল জীবনে সেগুলোই পুঁজি।
বস্তুবাদী ইনডিভিজুআলিজমের চেয়ে কি ভীষণ অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি হওয়ার কথা... অথচ... রমজানীয় ভাবনায় আমার তীব্র আকুতি ছিল কয়েকটা... এর মধ্যে একটা হল, আমাদের ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক অন্ধত্ব এবং স্বার্থপরতা যেন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়...
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০০৬ বিকাল ৫:৫৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



