পিচ ঢালা নির্জন রাস্তাটায় তখন আমি একা হাঁটছি। পুরো সিডনীটাই উঁচু, নিচু, ঢালু জায়গায় ভরা। পিচ ঢালা রাস্তাটা একটু উপরে উঠে যায়, আবার ঢালু হয়ে নিচে নেমে যায়। রাস্তার পাশের বিশাল বিশাল ইউক্যালিপটাস হালকা বাতাসের আদরে হঠাৎ হঠাৎ শিহরিত হচ্ছে। আর আলোটা... উফ... এই সোনালী আলোর আদরটা কি মায়া মায়া। আমি মুগ্ধ হয়ে ভাবি, আলোটা দেখলেই কেন অপার্থিব মনে হয়। কেমন ঘোর লাগা স্বপ্নালু চোখে সব দেখছি মনে হয়। একই পৃথিবী এত অন্যরকম লাগে কেন শুধু পরিবর্তিত আলোতে।
আহা, জানি তো রে... ওই রিসেপ্টর থিওরী জানি। চোখের দুই ধরনের রিসেপ্টর, রড আর কোন। একটা কাজ করে কম আলোয়, আরেকটা বেশি আলোয়। গোধুলীর এই সময়টায় ওরা কাজ বদলা বদলি করে। তাই গোধুলীতে পৃথিবী অন্যরকম হয়ে ধরা দেয়। জোছনায় ভেজা পৃথিবীও তাই অন্যরকম। তবু, মুগ্ধতা আমাকে ছেড়ে যায় না।
মুগ্ধ হয়ে গাছগুলো দেখি। সবুজ গাছগুলোয় এক পাশ থেকে সোনালী আলো পড়ে কি যে সুন্দর লাগছে, গাছগুলো কি বুঝতে পারছে! এত সৌন্দর্য দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় প্রিয় কারো সাথে দেখি। উচ্ছ্বসিত পাগলামী করে আমার মাথা খারাপ ছড়িয়ে দেই। ডেনিম স্কার্টটা ছেড়ে শাড়ি পড়তে মন চায়। হন্টন উপযোগী স্যান্ডেলগুলো ছুঁড়ে ফেলে খালি পায়ে হাঁটতে ইচ্ছা করে খুব।
বাসার কাছে পৌঁছাতেই মাথা নতুন করে খারাপ হলো। এত রং! বসন্ত কাকে বলে বুঝতে হলে আমার বাসার ফ্রন্ট ইয়ার্ডে আসতে হবে এখন। প্রথমেই অভ্যর্থনা জানাবে লেটার বক্স ঘিরে দুলতে থাকা উজ্জ্বল ম্যাজেন্টা আর কমলা ফুলগুলো। জঙলী ফুলগুলো বসন্তে এমনিই হয়েছে, একটুও যত্ন ছাড়া। সাথে আছে নয়ন তারা। তারপরেই গন্ধরাজ। উফ, গন্ধরাজের নামটা কে দিল? আসলে গন্ধরানী হওয়া উচিৎ ছিল না? এত মারাত্মক গন্ধ! আমি লোভ সামলাতে পারি না, প্রতিদিন বাসায় ঢুকার আগে একটা করে ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যায়। টেবিলের উপর রাখি। সারা ঘর সেই পবিত্র গন্ধে ভরে যায় মুহুর্তে। এতক্ষণে দেখে ফেলেছেন জানি, মানে ফ্রন্ট ইয়ার্ডে গেলে ওটাই সবার আগে চোখে পড়বে। সাত রঙের গোলাপ। অদ্ভূত ব্যপার হল, এবার কেউ পানি দেয় নি গোলাপ গাছগুলোতে। ব্যস্ততার অজুহাতে। অথচ বসন্ত আসতেই কি তুমুল উত্তেজনায় দুর্দান্ত সব ফুলগুলো বের হয়ে এসেছে। এই কনে দেখা আলোয় মাথা দুলিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে নি:শব্দে। আমার দেখতে ভাল লাগে ওই কমলা গোলাপটাকে। কেমন মিষ্টি কমলা রং... আর সাদা গোলাপটাকে। শুভ্র, পবিত্র। আকৃতিটা পারফেক্ট। বরাবর কাছে গিয়ে আদর করি লাল টকটকে গোলাপটাকে। ওটার গন্ধ আমাকে পাগল করে। তীব্র মাতাল করা গন্ধ আছে। দাম দেখায় কিন্তু খুব... পুরো মৌসুমে হবে মোটে দশ বারোটা ফুল। তবে গোধুলীর এই আলোয় যেদিকে তাকিয়ে থাকা যায় অ-নে-ক-ক্ষ-ন, সেটা ওই ঝাউ গাছগুলো। গাছগুলোর সবুজে প্রাণ আছে। সোনালী রোদের আদরে আরেকটু জীবন্ত হয়ে উঠেছে যেন।
বসন্তের রাতগুলোতে আমার ঘরে বিনামূল্যে এয়ার ফ্রেশনার হয়ে সার্ভিস দেয় ব্যাক ইয়ার্ডের হাসনা হেনা গাছটা। এই বাসাটা পছ্ন্দ হওয়ার পিছনে এটা একটা বড় কারণ ছিল... হাসনা হেনা গাছ। আমার একটু পুরানো পাগলামী... সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরে ব্যাকইয়ার্ডে যাওয়া। কানে এমপিথ্রি প্লেয়ারে বিষন্ন কোন গান। হাসনা হেনার মাতাল গন্ধে ডুবে খালি পায়ে একটু ভেজা নরম ঘাসে হাঁটা জোছনার আলো গায়ে মাখে। অথবা চুপচাপ বসে থাকা এক পাশে... আমার জোছনা বেদীতে। মূল বাসা থেকে একটু বাড়ানো অংশ... এক ফুট চওড়া, এক ফুট উঁচু প্লাটফর্ম। সেখান থেকে আমি জোছনায় ভেজা পৃথিবী দেখি। যেদিন আকাশে চাঁদ থাকে না, সেদিন পৃথিবী আর দেখা হয় না। ভীষণ মুগ্ধতা নিয়ে স্বচ্ছ আকাশে বসিয়ে দেয়া তারাগুলো দেখি।
আজকে সকাল থেকে কেমন বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব... স্যাঁতস্যাঁতে আলোয় অনেক নিচে নেমে আসা আকাশটা দেখছি আর ভাবছি, কি গান শোনা যায়?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



