ছোটবেলা চাইনীজ. জাপানীজ, কোরিয়ান বলতেই বুঝতাম বোঁচা নাকের, ছোট চোখের হলদে মানবদের। কিছুতেই বুঝতে পারতাম না, ওরা একে অন্যকে আলাদা করে চিনে কি করে? সবাই তো দেখতে একই রকম। তার চেয়ে আমরা বাঙালীরা কত বৈচিত্র্যময়, এক এক জনের চেহারায় কত তফাৎ, ওদের সবার চেহারা এত একরকম কেন? সিডনীতে আমার স্কুলে চাইনীজ, কোরিয়ান, জাপানিজ সবাইকে পেলাম এক সাথে। প্রথম প্রথম এমান্ডা আর মে এর চেহারায় পার্থক্য করতে পারতাম না। আর ওদের সবার ভাষা তো সেই একই চ্যাং চুং... এরকম একটা ধারণা নিয়ে থাকতাম। আস্তে আস্তে জাপানীজ মেয়ে এমান্ডা আর চাইনীজ মেয়ে মে এর নিজেদের ভাষার কথা শুনে শুনে বুঝে গেলাম জাপানীজ আর চাইনীজ ভাষায় আকাশ পাতাল তফাৎ। শুধু এমান্ডা আর মে কে আলাদা করে চিনতে শিখলাম না, জাপানীজ আর চাইনীজদের চেহারা মৌলিক পার্থক্যগুলোও চিনে গেলাম।
আমার ছোট বোনের গায়ের রং আমার চেয়ে একটু হালকা, একেবারেই অল্প। দুধ চায়ে দুই ফোঁটা দুধ মেশালে রঙের যতটুকু পার্থক্য হবে, ততটুকুই। এটা আগে বুঝি নি। কারণ বাংলাদেশে, ওকে সবাই 'উজ্জ্বল শ্যামলা' বলতো, আমাকে বলতো শ্যামলা। এবং এই হালকা রঙের পার্থক্য নিয়ে বিশাল ঘটনা হয়ে যেত। মজার ব্যপার হলো, এই গায়ের রঙের পার্থক্যটা সিডনীতে কেউ ধরতে পারে না। একেবারেই কেউ না। সবার ধারণা আমাদের দুই বোনের চেহারা একদম একরকম। এমনকি, এ পর্যন্ত অন্তত: পাঁচ জন মানুষ জিজ্ঞাসা করেছে আমরা জময কি না। অথচ আমরা জানি, আমার চোখ আমি পেয়েছি ফুপীর কাছ থেকে, ও বাবার থেকে, আমার ভ্রু মায়ের মত, ওর বাবার মতো, আমার ঠোঁট বাবার মতো, ওর ছোট খালার মতো। আমার মুখ লম্বাটে, ওর চারকোণা। ওত আলাদা! মানুষের দেখার চোখ নাই নাকি?
তবু, অবাঙালীরা আমাদের প্রথম দেখায় ভাবে, আমরা দেখতে 'একদম' এক রকম। আমার ভাইয়া, যার সাথে গুণে গুণে চোখ, নাক, ঠোঁট সব কিছুতেই আকাশ পাতাল তফাৎ পাই, সেই ভাইকে দেখেও নাকি আমার মতো লাগে। সমস্যাটা কোথায় বুঝলাম পরে। শুধু আমাদের তিন ভাই বোনের চেহারা একরকম বলে না ওরা, বরং সব বাঙালীদের চেহারাই একই ছাঁচে ফেলে দেয়। তখন বুঝলাম, চাইনীজ সিন্ড্রম হচ্ছে!
আসলে আমরা নিজেদের বরাবরই বৈচিত্র্যময় আর রঙিন ভাবি। যাকে 'নিজেদের' ভাবতে চাই না, তাদের সবাইকে 'এক' করে দেখি। নৃতত্ত্ববিদরা একে কি বলবেন জানি না। কিন্তু এই স্পষ্ট সাদা কালো দেখার প্রবনতা থেকেই আগে সামনা সামনি যুদ্ধ চলতো। 'আমার মানুষেরা' সব ভালো আর সব্বাই খারাপ।
পৃথিবী বদলিয়েছে, আমরা 'সহাবস্থান' এর মত রঙিন শব্দ উদ্ভাবন করেছি। একে অন্যের কাছাকাছি আসায়, আদান প্রদান বাড়ায় সাদা কালো এখন আর স্পষ্ট সাদা কালো না। মাঝে অনেকগুলো রঙের শেইড ঢুকে গেছে। একটু ময়লাটে সাদা, ধূসর সাদা, হালকা ধূসর, গাঢ় ধূসর, খুব গাঢ় ধূসর... কত শেইড! তবু, এখনও স্বার্থপর উদ্দেশ্যে মানুষের প্রাচীন 'সাদা কালো' প্রবনতাকে ব্যবহার করে মানুষ। পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্র নেতারা। তাই বুশ বলতে পারো, 'য়ু আর ইদার উইথ আস অর য়ু আর উইথ দা টেররিস্টস'। এখানে মাঝামাঝি কোন পথ নেই। টেররিস্টদের অপছন্দ করে বুশকে অপছন্দ করার পথ নেই। ইসলামের মৌলিকত্ব ভালোবেসে সন্ত্রাসীদের অপছন্দ করার পথ নেই। মাঝের রাস্তা পুরোটাই 'নো ম্যানস ল্যান্ড'।
আমাদের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে অবস্থা এক। যারা 'আমাদের' মানুষেরা না, তাদের স্টেরিওটাইপ করে আনন্দ পাই, তাতে স্বার্থসিদ্ধি হয় যে! চাইনীজ জাপানীজদের ছোট চোখ আর বোঁচা নাক দেখিয়ে যেমন আমরা ওদের এক করে ফেলতে ভালবাসি, তেমনি শুধু মাত্র কিছু বাহ্যিক মিলের জন্য আমরা 'আমাদের' সাথে সংঘর্ষশীল সব মতবাদকে এক ছাঁচে ঢেলে ফেলি। আর দেখুন, সেই তারাই ওপারে বসে আমাদের সবাইকে একই নৌকার ভাবছে।
ইদানিং খুব করে মনে হচ্ছে, পরিপক্কতার পথে খুব বড় একটা ধাপ হলো, নিজের এই সীমাবদ্ধতাটা চিনে নেয়া, এবং কাটানোর আন্তরিক চেষ্টা করা। তাতেই বিভিন্ন মানুষের নিজেস্ব স্বার্থে সৃষ্ট মাঝের 'নো ম্যানস' ল্যান্ডে চলাচল বাড়বে। কে জানে, হয়তো এটাই বেশির ভাগ মানুষের চলার পথ হবে এক দিন!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



