ঠিক কোন জায়গা থেকে লেখা শুরু করবো ভাবছি। সালটা ২০০১, আমি তখন মডেল স্কুলে ক্লাস ৯ এ পড়ি। সময় টা দুরন্ত, তার থেকেও বেশী দুরন্ত আমার মন। দুই চোখে দেখা দুনিয়াটা রঙিন আর যা দেখি তাই ভালো লাগে। এমনই এক ঘোর লাগা সময়ের মাঝে প্রথম দেখা তার সাথে।
বয়সের দোষ বলুন আর না বলুন, যা হবার তাই হল। প্রথম দর্শনেই ভালোলাগা সেখান থেকে প্রেম। যদিও তার নামটা এখন সঠিক মনে করতে পারছিনা, ধরে নেই তার নাম ছিল ঝর্না। সে ছিল আমার বন্ধু রকির কাকাতো বোন। রকির বাসাতে বেড়াতে যেয়েই পরিচয় ঝর্নার সাথে। সেখান থেকে অল্প সল্প কথা, মাঝে মাঝে দেখা, বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে চিঠি দেওয়া, তারপর শুরু ভালোবাসা। সম্পর্কের শুরুটা এখন যত সহজে বলে ফেললাম, বিষয়টা আসলে ততোটা সহজ ছিলনা। এই সম্পর্ক তৈরির পিছনে আমার বন্ধু রাজীবের আবদান ছিল ব্যাপক।
যা হোক, ঝর্নার কথায় ফিরে আসি। সে ছিল আমার প্রথম প্রেম, তাই হয়তো ঘটনাটা বলতে যেয়ে বেশী অপ্রয়োজনীয় কথা বলে ফেলছি। ঝর্না! ঝর্না! ঝর্না! না সে ঝর্নার মতই চঞ্চল ছিলনা, বরঞ্চ সে ছিল অনেক ঠাণ্ডা প্রকৃতির মেয়ে। দেখতে কি খুব সুন্দরী ছিল? না। সৃষ্টিকর্তা মনে হয় তাকে তৈরি করার সময় একটু বেশীই বেখেয়াল ছিলেন। যদি তার আকর্ষণীয় কিছু থেকেই থাকে, তা ছিল তার চোখ আর ম্যাগী নুডুলস এর মতো কোঁকড়ানো চুল। আর আমি সবথেকে পছন্দ করতাম তার সহজ সরল মানুষিকতা টা।
কৈশোর প্রেমের সেই সময়গুলো মনে করলে আমি এখনো শিহরিত হই। কি সুন্দর,কত আনন্দেই না কেটেছে দিনগুলো। স্কুল পালিয়ে একসাথে ঘোরা, আইসক্রিম খাওয়া, পোস্ট অফিসের ভিতরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করা। কখনো তাকে এক পলক দেখার জন্যে বন্ধুর বাসায় বেড়াতে যাওয়া। ওদের বাসা ছিল মোহাম্মদপাড়া (এলাকার সঠিক নাম ভুলে গেছি মনে হচ্ছে), সেখান থেকে বীণাপাণি স্কুলে যাবার পথে পড়ত আমার স্কুল (মডেল স্কুল), আর তাই পোস্ট অফিসের মোড়ই ছিল তার সাথে দেখা করার জন্যে সবথেকে সুবিধাজনক জায়গা। মোটামুটি প্রত্যেক দিনই চিঠি চালাচালি হত আমাদের মাঝে। (তখন তো আর মোবাইল ছিলনারে ভাই! সত্য কথা বলতে কি, এই প্রেমপত্র লিখতে লিখতেই আমার হাতের লেখার কিছুটা উন্নতি হইছিল।) এই ভালোবাসাবাসি, তাকে দেখার জন্যে আনচান মন, মাঝে মাঝে একটু আধটু রাগ, মিছেমিছি কান্না পাওয়া, সারারাত ধরে একই চিঠি বার বার করে পড়া, সব মিলিয়ে ভালই কাটছিল জীবন। যদি কোনদিন দেখা না হত, তাহলে মনটা খুবই খারাপ থাকত দুইজনেরই। মডেল স্কুলের সামনে বাবুর চটপটির দোকান ছিল (এখনো আছে কিনা জানিনা), দেখা না হলে পাগলীটা আমার জন্যে লেখা চিঠিটা ঐ চটপটির দোকানে দিয়ে যেত। এইরকম ছোটখাটো নানা ঘটনায়, প্রজাপতির ডানায় ভর করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সেই সময়গুলো।
২০০২, স্কুল পাঠ শেষ। বাবার বদলি চাকরীর বদৌলতে গোপালগঞ্জ ছেড়ে পাড়ি জমালাম নতুন আরেক শহরে। সেখানে এসে ভর্তি হলাম কলেজে, শুরু হল নতুন জীবন। আমার প্রথম প্রেম যে কবে কিভাবে কখন হারিয়ে গেল, নিজেই তা জানতে পারলাম না। হয়তো সে প্রেম ধরে রাখার মতো সাধ্য আমার ছিলনা, হয়তো ইচ্ছাও ছিল না, হয়তো আমরা কেউই কাউকে ধরে রাখতে পারি নাই, হয়তোবা এটাই ছিল নিয়তি।
এরপরের ঘটনা ২০০৭/০৮ সালের। আমি তখন ঢাকা থাকি, অনার্স তৃতীয় বর্ষ চলছিল মনে হয়। একদিন বেড়াতে গেলাম গোপালগঞ্জ। বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম বঙ্গবন্ধু কলেজের নিচতালায়, গোঁড়া বাঁধাই করা গাছগুলোর ওখানে বসে। তখন দুপুর ১২ টার মতো বাজে, আমি খেয়াল করছিলাম যে একটা মেয়ে কলেজের বারান্দা থেকে বার বার আমাকে দেখছে। আমি তখন আড্ডায় মশগুল, তাই বিষয়টা খুব একটা সিরিয়াস ভাবে নেইনি। একটু পরেই দেখি দূর থেকে দেখা সেই মেয়েটি আমার সামনে এসে হাজির।
আমি প্রথমে চিনতেই পারি নাই। একটু ভালো করে খেয়াল করতেই চিনলাম, ঝর্না। সেই ঝর্না। যেন হটাৎ করেই আমার সামনে অতীত এসে দাঁড়ালো। ৪/৫ মিনিট কথা হল। না তেমন সিরিয়াস কিছু না। ক্যামন আছ? কি করছ? কোথায় থাকো? এই টাইপের কথা আরকি। জানলাম বঙ্গবন্ধুতে ইংলিশে অনার্স করছে। তখনও বিয়ে করেনি। এ ছাড়া মনে রাখার মতো আর কোন কথা হল না। এত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা যে আমি কিছু বুঝেই উঠতে পারলাম না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম তার চলে যাবার পথের দিকে। ওটাই ছিল তার সাথে আমার শেষ দেখা। তারপর আরও অনেকবার গোপালগঞ্জ গেছি, কিন্তু আর কোনদিনই দেখা হয়নি তার সাথে।
ঝর্নার একটা হাতে পলিও রোগের ফলে একটু সমস্যা ছিল। তার সাথে আমার সম্পর্ক ভেঙে যাবার সময় সে ভেবেছিল তার হাতের সমস্যার জন্যে বুঝি আমি তার থেকে দূরে সরে গেলাম। কিন্তু আমি তাকে কখনো বলতে পারি নাই; “ঝর্না, এই সমস্যার জন্যে আমি তোমার থেকে দূরে সরে যাইনি। শুধু সময়ই জানে, কেন কিভাবে আজ আমরা এত দূরে। আমি তোমার হাতের সমস্যার কথা জেনেই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। সত্যিই ভালোবেসেছিলাম।“ এই কথাটা আর তাকে বলা হল না, আর কোনদিন বলা হবেও না হয়ত। যেখানেই থাকো ভালো থেকো, সুন্দর থেকো ঝর্না।