ড্রাগস বিশ্বের বড় সমস্যাগুলোর একটা। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সরকার ''মাদকমুক্ত বাংলাদেশ'' গড়ার জন্য বর্তমানে ঝাপিয়ে পড়েছে মাদক ব্যবসায়ীদের উপর। প্রতিদিনই প্রায় ৮/১০ জন করে মরছে ক্রসফায়ারে। এই ঝাপ দেয়াটা কতোটুকু লোকদেখানো স্ট্যান্টবাজী, আর কতোটুকু আন্তরিক, সেই আলোচনাতে যাওয়ার আগে আসুন একটু সংক্ষেপে দেখে নেই বাংলাদেশে ড্রাগস এর ক্রম-বিবর্তন এবং এর বর্তমান অবস্থা।
প্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশে বিভিন্ন ড্রাগস প্রচলিত। কল্কে দিয়ে গাজা, চরস সেবন বাঙ্গালীর অনেক পুরানো অভ্যাস। ভাং এর শরবতও খুব জনপ্রিয় ছিল একসময়। পরবর্তীতে একে একে মরফিন, পেথেডিন, ফেন্সিডিল, হেরোইন, ভায়াগ্রা এবং হাল আমলের ইয়াবা এদেশের মাদক সমাজে আলোড়ন তুলেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন স্লীপিং পিল, কফ সিরাপ, এন্টিহিস্টামিন জাতীয় অষুধ ইত্যাদি তো সবসময়ই চালু ছিল। একটা ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে, ’হুজুগে বাঙ্গালী’ হিসাবে আমরা সামনে যা পাই তাই নিয়েই মেতে থাকি। এখন ইয়াবার যুগ, সবাই ইয়াবাতেই মাতামাতি করছে। কিন্তু তাই বলে অন্য যেসব ড্রাগসের নাম বললাম সেগুলোর সেবন বন্ধ হয় নাই। বরং তালিকায় নিত্য নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে।
তাছাড়া প্রচলিত ড্রাগস গুলোকে মডিফাই করেও আরো শক্তিশালী করা হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই একটা উদাহরন দেই। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় মাঝে-মধ্যে নীলক্ষেত আর নিউমার্কেটের ২নং গেট থেকে গাজা-চরসের পুরিয়া কিনতাম। তো একদিন বিক্রেতা বললো, ’মামা, নতুন জিনিস আইছে। টেস কইরা দেখেন। দাম ইকটু বেশী, কিন্তু জিনিস সেরাম!’ ঘটনা হচ্ছে, তখন ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশান কুকুর মারার জন্য কি একটা ড্রাগ ব্যবহার করতো। সেটাকে গাজা-চরসের সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে; আর জিনিসও সেরামই ছিল। এক পুরিয়াতেই তিনজন কাইত!!!
যাই হোক, মূল আলোচনাতে আবার ফিরে আসি। আমাদের এই দেশটা এমনিতেই ভৌগলিকভাবে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের খুব কাছে হওয়ায় সুরক্ষিত নয়। তার উপর মাদক পাচার করার জন্য ড্রাগ কার্টেলদের যা যা দরকার (যেমন - দারিদ্রতা, দূর্ণীতি, একদল লোভী রাজণীতিবিদ, দূর্বল রাষ্ট্র ও বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি) তার সবই বাংলাদেশে থাকায় এটা একটা ভালো এবং লাভজনক রুট হিসাবেই বিবেচিত। হেরোইনে যেমন লাভ, তেমন ঝামেলাও কম না; সেদিক দিয়ে ইয়াবাতে ঝামেলা নাই, কিন্ত লাভ অনেক বেশী। কাজেই মাদক ব্যবসায়ীরা যে ইয়াবার দিকে ঝুকে পড়বে তাতে আশ্চর্য কি? আর পুরানো সাপ্লাই তথা মার্কেটিং নেটওয়র্ক তো তৈরীই আছে - গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল, তাই না!
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল এবং বাংলাদেশ
এবার দেখা যাক, ইয়াবা আসলে কি? ইয়াবার মূল উপাদান মিথামফিটামিন যা মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে। একসময় মিয়ানমারের শান প্রদেশের পাহাড়ী এলাকায় মাল টানার জন্য ঘোড়াকে এটা খাওয়ানো হতো। ভারতে এটি 'ভুলভুলাইয়া' নামে পরিচিত। আমাদের দেশে এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন; খাওন, লাল, বাবা, গাড়ী, গুটি, চাক্কা ইত্যাদি। ইয়াবা এখন ইন্ডিয়া, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন ইত্যাদি দেশে; এমনকি ইজরাইল, আমেরিকার মতো দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্নভাবেই ইয়াবা সেবন করা যায়; যেমন গিলে, সিগারেট, ইন্জেকশান এর মাধ্যমে ইত্যাদি। একেকদেশে একেক পদ্ধতি জনপ্রিয়। হংকং এ 'চেজিং দ্য ড্রাগন' পদ্ধতি খুবই চালু। এই পদ্ধতিতে এল্যুমিনিয়াম ফয়েলে ট্যাবলেট রেখে নীচ থেকে তাপ দেয়া হয়। ট্যাবলেট গলে গিয়ে যে বাষ্প বের হয়, তা নাক দিয়ে টেনে নেয়া হয়।
ইয়াবার তোড়ে আরেকটা বিষয় সবার অগোচরে থেকে যাচ্ছে, যেটার ফলাফল ইয়াবার চাইতেও ভয়াবহ। আমাদের দেশে প্রশ্নফাস জেনারেশানের মতো আরেকটা ভয়ংকর জেনারেশান তৈরী হচ্ছে। টোকাইদের মধ্যেও একটা নেশা ভয়াবহ আকারে সংক্রামিত হচ্ছে। এদের নেশাতে ব্যয় করার সক্ষমতা কম থাকায় জুতা তৈরীর একধরনের আঠা দিয়ে এরা নেশা করে। এই আঠাতে টলুইন নামে একটা রাসায়ানিক পদার্থ আছে যা নেশার উদ্রেক করে। এটা ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে আসে। এই নেশায় আসক্ত টোকাইদের কাছ থেকে জানা যায়, এই নেশার মাধ্যমে তারা দুনিয়ার কষ্ট ভুলতে পারে! ইউনিসেফের একটা জরীপ থেকে জানা যায়, এদের ২০% বন্ধুদের দেখে আসক্ত হয়। আর ৬৩% আসক্ত হয় একাকীত্ব দুর করার জন্যে। দিনের বেলা যেখানে-সেখানে সবার সামনেই কয়েকজন বসে এই নেশা করে, দেখার কেউ নাই! কিছু দিন আগে একটা রিপোর্টে পড়েছিলাম, টোকাইরা আজকাল বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে, এমনকি তারা অনেকেই এখন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। বড় হয়ে এরা হেন কু-কর্ম নাই যা করবে না। আমরা এখনও বুঝতে পারছি না যে, এরা প্রত্যেকেই এক একজন ভবিষ্যতের সম্ভাব্য মাদক সম্রাট। আমরা এও বুঝতে পারছি না, কি ভয়ংকর ভবিষ্যত আমাদের সন্তানদের জন্য অপেক্ষা করছে!
প্রকাশ্য দিবালোকে নেশা করছে কয়েকজন টোকাই
এবার ক্রসফায়ার প্রসঙ্গে আসি। এই ক্রসফায়ার নিয়ে সবসময়ই প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়। বলা হয়ে থাকে, সরকার একে বিরোধীদল দমনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে কিংবা নির্বাচনের আগে জনগনকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে যে, দেখ - আমরা অন্যায়ের প্রশ্নে আপোষহীন! কারন যাই থাক, যুক্তি দিয়ে দেখলে এই অভিযোগগুলো একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারন, কোন সমস্যা সমাধানে সরকার যদি সত্যি সত্যিই আন্তরিক হয় তাহলে আইনের শক্ত এবং নিরপেক্ষ প্রয়োগই যথেষ্ট। আইনকে পাশ কাটিয়ে অন্য কিছু করতে যাওয়া মানেই আইনের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করা। কোন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী এটা করলে যদিও বা মানায়, একটা দেশের সরকারকে এটা একেবারেই মানায় না। সরকার যেভাবে মাদক সমস্যার সমাধান করতে চাইছে, তা দেখে আমার উদ্ভিদজগতের একটা বৈশিষ্ট্য নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে।
আমরা সবাই গাছদের একটা ব্যাপার জানি। তাহলো, একটা গাছের ডাল-পালা যদি ছেটে দেয়া হয় তাহলে কিছুদিন পর দেখা যায় আরো বেশী করে নতুন ডাল-পালা গজাচ্ছে। তাই এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করে গাছকে ঝাকড়া করা হয়। সরকারের কর্মকান্ডে মনে হচ্ছে তারা মাদক-ব্যবসাকে ঝাকড়া করতে চাইছে! কেন এমনটা মনে হচ্ছে? কারন, তারা মূল অংশে হাত না দিয়ে ছোট ছোট ডালপালা কাটছে। গডফাদাররা চাইলে একদিনেই এমন একটা ডালের পরিবর্তে দশটা ডাল গজিয়ে নিতে পারে।
আমাদের এই সরকার দুইবার নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীকে অল্পকিছু টাকা আত্মসাতের মামলায় জেলে নিতে পারে, কিন্তু একজন স্বনামধন্য ইয়াবা সম্রাটকে কিছুই করতে চায় না, কারন সে দলের লোক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মাদক গডফাদারদের তালিকায় যার নাম সবার উপরে, যার নামে বিশেষ গোয়েন্দা প্রতিবেদন রয়েছে; আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, 'তার বিরুদ্ধে আরো তথ্য-প্রমান লাগবে!!!' আচ্ছা, উনার ব্যাপারে এত চুলচেরা হিসাব, তাহলে যাদেরকে মারা হলো তারা কি দোষ করলো? তাদের ক্ষেত্রে ভিন্নতর ব্যবস্থা নেয়ার কারন কি? সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ আর ততোধিক বিচিত্র তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী! আরো বিচিত্র হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন মন্ত্রী। তিনি প্রতিনিয়ত হুংকার দিচ্ছেন, মাদক ব্যবসার সাথে যে বা যারা জড়িত, যতো প্রভাবশালীই হোক; কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। না, উনারা অবশ্যই ছাড় দিচ্ছেন না। অন্ততঃ গত কয়েকদিনের হত্যাকান্ড তাই বলে! সরকারকে বাহবা দিতেই হবে, এতোগুলো প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী মারা পড়লো যে!
মাদক বিরোধী অভিযানকে আমরা এখনই সফল বলবো, নাকি আরো কিছুদিন অপেক্ষা করবো???
ছবি এবং তথ্যঃ ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৮ দুপুর ১২:২৭