পূর্বকথাঃ শুরুতেই জানিয়ে রাখি, এটা কিন্তু 'হিচকি' মুভির কোন রিভিউ না। হিচকি মুভিটা দেখে আমার যেই অনুভূতি, এর বাস্তবতা, এর বিষয়বস্তু সম্পর্কিত আমার যে অজ্ঞতা; কিংবা বলতে পারেন অভিজ্ঞতা, সেই ব্যাপারগুলো আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করাই মূল উদ্দেশ্য।
আমার বাসা-অফিস যাতায়াতের পথে টেসকোর একটা বিশাল স্টোর পড়ে। হেন জিনিস নাই যা এখানে পাওয়া যায় না। বাসায় ফেরার পথে প্রায় প্রতিদিনই আমি এখানে আসি শপিং এর জন্য। আমাদের দেশের মতো যেখানে সেখানে তো আর দোকান নাই এখানে, তাই বাসায় কাচামরিচ নাই, তার জন্য এখানে আসাটাও শপিং এর মধ্যেই পড়ে। কাজেই কাচামরিচ, ধন্যাপাতা, পাউরুটি থেকে শুরু করে মাসের বড় শপিংগুলোও আমি এখান থেকেই করি। একজন রেগুলার কাষ্টমার হিসাবে চেকআউটের অনেক স্টাফই আমার পরিচিত।
এখানে সন্ধ্যাবেলা প্রায়ই একটা ছেলের সাথে আমার দেখা হয়। সেও কাষ্টমার। সে অবশ্য কোন সময় একা আসে না। আরো ২টা মেয়ে আর ২টা ছেলে ওর সার্বক্ষনিক সঙ্গী। ২৫/২৬ বছরের মতো বয়স হবে ওদের। এ ধরনের ছেলেমেয়েরা যেমন হয়; হৈ চৈ করা, উচ্চ স্বরে হাসা, কথায় কথায় সবকিছুতেই 'এফ' শব্দের ব্যবহার...এসবই সাধারন ব্যাপার। কেউ কেউ নাক একটু কুচকালেও উচ্চ-বাচ্য করে না। তবে, একটা কারনে এই ছেলেটা অন্য সবার থেকে আলাদা। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বেকায়দাভাবে মাথায় ঝাকি মেরে চিৎকার করে বলে উঠে, 'কান্ট'!
বৃটিশ সমাজ এখনও বেশকিছু খারাপ শব্দ জনসমক্ষে বলা খুবই অপছন্দ করে। এই শব্দটা তার মধ্যে একটা। প্রথম যেদিন ছেলেটার মুখে এই শব্দ শুনি তখন আমি চেকআউটে। এক পরিচিত বয়স্ক মহিলা স্টাফ আমার সদায়পাতি স্ক্যান করছিলেন। আমি বললাম, এ পাগল নাকি? মহিলা বললো, ও অসুস্থ। তারপর আস্তে বিড়বিড় করে কিছু একটা বললো, বুঝতে পারি নাই। তবে আর কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিলাম। তারপর, যখনই ছেলেটাকে এটা বলতে শুনতাম, দেখতাম আশেপাশের কিছু লোকজনের নাক কুচকে যাচ্ছে, বিড়বিড় করছে! ছেলেটা মিক্সড রেসের, অর্থাৎ আধা সাদা, আধা কালো। এ ধরনের ছেলেরা সাধারনতঃ একটু উগ্র টাইপেরই হয়। কাজেই এটাকে স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম, ব্যাটা অসুস্থ-টসুস্থ কিছু না; আসলে একটা বদমাশ!
একদিন আমার এক ইন্ডিয়ান বন্ধু বললো, রাণী মুখার্জির একটা নতুন মুভি এসেছে, হিচকি। মুভিটা দেখ, নতুনত্ব আছে। এক ছুটির দিনে একটু অবহেলাভরেই দেখতে বসলাম। ভাবটা এমন, ''তোমার এখন পড়ন্ত বেলা, তুমি আর কি দেখাবা'' প্রথমদিকে একটু বোরিং লাগলেও মুভিটা শেষ করে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষন বসে রইলাম। চলতি বাংলায় যাকে বলে, ''তব্দা মেরে যাওয়া''।
তারপর বসলাম গুগল মামার সাথে। ঝাড়া তিনঘন্টা ব্রাউজিং করলাম। ইউটিউবে বেশকিছু ভিডিও দেখলাম, অনেকগুলো আর্টিকেল পড়লাম। তারপর অত্যন্ত শরমিন্দা হয়ে নিজের মনেই ছেলেটার কাছে মাফ চাইলাম। না জেনে ওর সম্পর্কে যে ধারনা করেছিলাম, তার জন্য অনুতপ্ত হলাম; কারন ততোক্ষনে আমি জেনে গিয়েছি, ছেলেটা যেই স্নায়ুবিক অসুখ বা নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত, তার নাম ''টোরেট সিনড্রোম''।
১৮৮৪ সালে গিলস ডি লা টোরেট নামের একজন ফরাসী নিউরোলজিস্ট তার একটি আর্টিকেলে সর্বপ্রথম এই সিনড্রোমের উপর আলোকপাত করেন। পরের বছর এই আর্টিকেলের উপর ভিত্তি করে ৯ জন রোগীর উপর তার অবজার্ভেশান প্রকাশ করেন যারা কিনা এই সিনড্রোমে ভুগছে। পরবর্তীতে জিন মার্টিন চারকোট নামে আরেক ফরাসী নিউরোলজিস্ট গিলস ডি লা টোরেট এর নামানুসারে এই সিনড্রোমের নামকরন করেন ''টোরেট সিনড্রোম।'' এই অসুখে আক্রান্তরা স্নায়ুবিক কারনে আচমকা কিছু অঙ্গভঙ্গি করে, শব্দ করে যেটাকে ''টিক'' বলে। এই টিক দৃশ্যমান হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। তবে, সমস্যাটা হয় দৃশ্যমান হলে। কারন এই দৃশ্যমান টিক কোন স্বাভাবিক বিষয় না। এটা এই সিনড্রোমে আক্রান্তকে সমাজ থেকে আলাদা করে ফেলে। লোকজনের বাকা চোখে তাকানো দেখতে দেখতে, কিংবা উপহাসমূলক কথা শুনতে শুনতে একসময় সেও নিজেকে অদ্ভুদ কিছু ভাবতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ১০ ভাগ রোগী টিক হিসাবে সামাজিকভাবে আপত্তিকর কোন শব্দ বা গালি ব্যবহার করে। কেন করে? কিছু হাইপোথিসিস আছে, তবে সঠিক কারনটা এখনও বের করা যায়নি। একজন আপাতঃদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মানুষ যদি আচমকা হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুদ অঙ্গভঙ্গি এবং শব্দ করে তাহলে প্রথমেই মানুষ তাকে নিয়ে নেতিবাচক ধারনাই করে। আর উচ্চস্বরে খারাপ শব্দ উচ্চারন করলে তো আর কোন কথাই নাই! আমাদের দেশে তো এটাকে হয় জ্বীনের আছর বলবে, নয়তো বয়সভেদে বেয়াদব, বদমাশ বা অন্যকোন নেগেটিভ ধারনা করবে। পাশ্চাত্যদেশগুলোও এ ব্যাপারে খুব একটা ব্যতিক্রম না। তবে ব্যাপক প্রচারনার ফলে এই অসুখের কথা এখন এখানে অনেকেই জানে। যেহেতু এই রোগের সুত্রপাত হয় খুবই অল্প বয়সে, তাই এই রোগে আক্রান্ত শিশু-কিশোররা সহজেই অন্য শিশু-কিশোরদের আক্রমন এবং বৈষম্যের শিকার হয়, যা আস্তে আস্তে তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং জীবন-যাত্রাকে পঙ্গু করে দেয়।
একটা কেইসস্টাডি আপনাদের বলি, এটার ডিটেইল ভিডিওটাও আমি দেখেছি। জেসিকা নামের ১৫ বছর বয়সের সুন্দর একটা ইংলীশ মেয়ে। এই মেয়ের অন্যতম টিক হচ্ছে বামহাতের মধ্যমাঙ্গুলী প্রদর্শন আর জোরে 'নীগার' বলা। বুঝতেই পারছেন, পরিস্থিতি এই মেয়ের জন্য কতোটা ভয়াবহ। পাশ্চাত্যদেশগুলোতে সব জায়গায় কালো মানুষ আছে, এবং নীগার সেখানে একটা বর্ণবাদী গালি! এই মেয়ে রাস্তাঘাটে, শপিং এ, যেখানে-সেখানে এই কাজ করে। ভিডিওতে দেখলাম, এক সুপারশপে কালো চেক আউট স্টাফের সামনে সে এই কাজ করলো। তবে সেই স্টাফ জানায় যে সে এই রোগ সম্পর্কে জানে। জেসিকার মা দুঃখ করে বললো যে, সে ওকে নিয়ে রাস্তা-ঘাটে হাটার সাহস পায় না; কখন কি ঘটে যায় এই ভয়ে। কারন সবাই তো আর এই রোগ সম্পর্কে জানে না, আবার জানার পরেও অনেকে এটাকে বর্ণবাদী আচরণ মনে করে। অথচ মেয়েটা নিজেই বললো যে, আমি রেসিস্ট না। আমার স্কুলে এবং নেইবারহুডে অনেক কালো বন্ধু আছে!
আগেই বলেছি, এটা হিচকি মুভির রিভিউ না। মুভিটা সম্পর্কে বেশী কিছু বলে যারা মুভিটা এখনও দেখেন নাই তাদের আগ্রহও আমি নষ্ট করতে চাই না। তবে অনুরোধ করবো, যারা এটা দেখেন নাই, দেখবেন দয়া করে। নিশ্চিতকরেই বলতে পারি, রাণী মুখার্জির অসাধারন অভিনয়ের সাথে সাথে একটা দারুন অভিজ্ঞতাও অর্জন করবেন। একটা ভিডিওর লিংকও দিলাম নীচে। আগ্রহীরা মুভির সাথে সাথে এটাও দেখতে পারেন। আমার এই পোষ্ট পড়ে যারা এই রোগের কথা এই প্রথম জানলেন তারাসহ সবাইকে বলবো, হয়তো আপনার পরিচিতদের মধ্যে কিংবা আশেপাশে এই রোগে আক্রান্ত বাচ্চারা আছে। তাদের প্রতি সদয় হোন। অন্যদেরও বলুন, সচেতন করুন। যেহেতু এই অসুখটা নিরাময়যোগ্য নয় এবং এর কোন নির্দিষ্ট মেডিকেশানও নাই, তাই আমাদের সবার সহৃদয় আচরণই শুধুমাত্র তাদেরকে সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক জীবন যাপনে সহায়তা করবে। তাদেরকে এই সমাজের অংশ হিসাবেই গন্য করুন। তাদেরকে সমাজ বহির্ভূত একটা কিম্ভুতকিমাকার প্রানীতে পরিনত করবেন না...... প্লিজ!!!
ভিডিওর লিংক view this link
তথ্য ও ছবি নেট থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ১২:৩০