আজ একেবারে সক্কালবেলা বউয়ের সাথে ঝগড়া করে নাস্তা না করেই বাসা থেকে বেড়িয়েছি। রাগের চোটে কোথাও কিছু খাইওনি। সেই সকাল নয়টা থেকে রমনা পার্কের এই বেন্চটাতে বসে আছি। এখন বাজে দুপুর একটা। এগারোটার দিকে প্রচন্ড ক্ষুধা লাগাতে দশ টাকার বাদাম আর এক কাপ চা খেয়েছি। ক্ষুধাটাও এখন মরে গিয়েছে মনে হচ্ছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা কিছুই বোধ হচ্ছে না। নিজেকে কেমন সন্নাসী সন্নাসী লাগছে। ভাবছি, এই জগৎ-সংসার সব ছেড়েছুড়ে গৌতম বুদ্ধের মতো সন্নাসীর খাতায় নাম লেখালেও নেহায়েত মন্দ হয় না!
আমি একজন উচ্চশিক্ষিত বেকার। বেকার জীবনের প্রায় আট মাস হতে চললো। ভালো একটা চাকুরীই করতাম। বসের সাথে ঝগড়া করে রাগের মাথায় চাকুরী ছেড়ে চলে আসলাম। ভেবেছিলাম, আমার যা যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা.......চাকুরী জোটানো কোন ব্যাপার না। তারপর যতোদিন যেতে লাগলো, আমি ততোই কল্পনার রাজ্য থেকে বাস্তবে নেমে আসতে থাকলাম। এখন এমন অবস্থা, মোটামুটি কোন একটা চাকুরী পেলেও করবো........কিন্তু তাও পাচ্ছি না। দেশটা ছোট। চারিদিকে পরিচিত লোকজনের ছড়াছড়ি, না হলে এখন পেলে পিয়নের চাকুরীও করতাম। তার উপরে আজকাল রুটিন করে সকাল-বিকাল বউয়ের সাথে ঝগড়া হয়। এতো মায়াবতী মেয়েটা দিনকে দিন কেমন রুক্ষপ্রকৃতির হয়ে যাচ্ছে। টাকার যে এতো ক্ষমতা আগে বুঝিনি। এই বয়সেই মনে হচ্ছে যেন দিনে দিনে মেরুদন্ডটা কেমন অশক্ত হয়ে যাচ্ছে!
বসে থাকতে থাকতে বেন্চটাকেই এখন নিজের ঘরবাড়ি মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ শুয়েও ছিলাম। বেন্চ থেকে উঠে যে একটু হাটাহাটি করবো সেই উপায়ও নাই। আশেপাশে কয়েকজন ঘোরাঘুরি করছে। আমি উঠলেই বেন্চ দখল করবে, এমন ভাব। মনে মনে বললাম, হু হু বাবা, আমাকে এখনও চিনো নাই। বেকার বসে থাকতে থাকতে আমি এখন এক বসাতেই রাতও কাবার করে দিতে পারি!
বসে থাকতে থাকতে একসময় ভাবলাম, ঘটনা কি? উঠতেও তো দেখি ইচ্ছা করছে না। শিকড় গজিয়ে গেল নাতো! চেক করার জন্য একটু উঠে দাড়াবো ভাবছি, এমন সময় পাশে একজন এসে বসলো। নেহায়েত ছা-পোষা চেহারার মধ্য-বয়সী এক লোক। আধাময়লা কাপড়-চোপড় পরা। অনেকক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকার ফলে আশেপাশের সবার চেহারাই মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। একে কোন একবারও দেখেছি বলে মনে পরছে না; কোত্থেকে উদয় হলো? আমার সাম্রাজ্যে কোন অংশীদার আবার আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। কিন্তু সমস্যা হলো, এই পার্ক এবং বেন্চ; দু’টোই সরকারী সম্পত্তি। তাই ব্যাটাকে কিভাবে তাড়ানো যায় ভাবছি, এমন সময় লোকটা কথা বলে উঠলো,
- ভাইজান কি আজ সকাল সকাল বউয়ের সাথে ঝগড়া করছেন?
- কেন আপনার এমনটা মনে হলো? মেজাজ খারাপ করে বললাম।
- মনে হওয়া-হওয়ির কিছু নাই, আমি জানি। লোকটা সবজান্তা ভঙ্গিতে মাথা দোলাতে দোলাতে বললো।
- আচ্ছা! আপনে মনে হচ্ছে সর্বজ্ঞ! আপনার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আমি এখনও বিয়েই করি নাই......কাজেই বউ থাকার কোন প্রশ্নই আসে না।
- হুস! লোকটা মাছি তাড়ানোর একটা ভঙ্গি করলো। আপনে তো দেখি খুব সুন্দর মিথ্যা কথা বলতে পারেন! এমন লোকই আমার পছন্দ। আমার চেলারা তথ্যে কোন ভূল করে নাই দেখি! বলে লোকটা একটা বিশ্রী, কুটিল-মার্কা হাসি দিল।
হারামজাদা বলে কি? লোকটাকে ভালো করে দেখলাম। কথা যা বললো, তা যদি ভূল না শুনে থাকি তাহলে এই বান্দা আমার সম্পর্কে খোজ-খবর নিয়েই আমার পাশে এসে বসেছে! কিন্তু তা কি করে হয়? আমি এমন কোন বিগশট না যে আমার সম্পর্কে লোকজন খোজ-খবর নিবে। এদিকে নিজেরই যা চেহারা-সুরত; এর দেখি আবার চেলাও আছে! এবার একটু কৌতুহল হলো, আবার একটু ভয়ও হলো; পাগল-টাগল নয়তো? বললাম,
- আপনার চেলারা আমার সম্পর্কে আর কি কি তথ্য আপনাকে দিয়েছে?
- তা শুনে আপনার কাম নাই। এখন আমি যা যা বলি, শুনেন।
লোকটার গলায় পুরাপুরি কর্তৃত্বের আভাস পেয়ে দিনে দ্বিতীয়বারের মতো মেজাজ খিচড়ে গেল আমার।
- আপনে ভাবলেন কিভাবে, আপনে যা বলবেন আমি শুনবো? চিনি না, জানি না। কোনখানকার কোন বাল-ছাল আপনে! ভালো চান তো উঠেন এইখান থিকা। নয়তো কিন্তু ধাক্কা দিয়া উঠামু।
আমার রাগতঃ চেহারা দেখে লোকটা একটু থতোমতো খেয়ে গেল। এবার আপোষের সুরে বললো, আরে ভাই চেতেন কেন। আমার কথা পুরাটা শুনেন, আপনের লাভ হবে। তারপরে আপনে বলবেন যা বলার, ঠিক আছে?
প্রথমেই আমার বৈবাহিক অবস্থা নিয়ে সঠিক তথ্য দেয়া, চেলা থাকা, কথা শোনানোর জন্য জোড়াজুড়ি করা; সবমিলিয়ে কৌতুহলেরই জয় হলো। ভাবলাম......আচ্ছা, বসেই যখন আছি; কি বলে, শুনেই দেখি!
কথাবার্তা সরাসরিই বলি, লোকটা শুরু করলো। ভনিতা আমার এমনেই পছন্দ না; আমি আসলে শয়তান। এটুকু শুনেই আমার মুখ দিয়ে কিছু গালি বেড়িয়ে যাচ্ছিল, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাত উচু করলো। না, কোন গালাগালি না! আমার কথা শেষ হউক আগে। ও আচ্ছা, ভালো কথা, আমার কথা শোনার পারিশ্রামিক হিসাবে আপনেরে পাচ হাজার টাকা দিলাম, বলে আমার শার্টের বুক পকেটে কয়েকটা এক হাজার টাকার নোট গুজে দিল সে। এখন আপনের সময় আমার কেনা, কাজেই শুনতে আর কোন অসুবিধা হওয়ার কথা না।
তো, যা বলছিলাম। আমি এতোদিন ছিলাম ইরাকে। একটু আগে বাংলাদেশে আসলাম। পৃথিবীতে আমার একজন সওয়ারী লাগে, নয়তো আমি আমার কাজ-কারবার ঠিকমতো করতে পারি না। এতোদিন আমার সওয়ারী ছিল ইসলামিক স্টেটের স্বঘোষিত খলিফা আবু বকর আল বাগদাদী। এই খিলাফতের পতনের পর চেলাদেরকে বললাম, এই ছাগলটার উপরে ভর করার দিন শেষ। এখন এমন একটা জনগোষ্ঠী আর মানুষ খুইজা বার কর যেইখানে আমি আমার পরবর্তী আখড়া গাড়তে পারি। বাংলাদেশের উপর আমার আগ থিকাই নজর ছিল। আমার কাজের জন্য খুবই উপযোগী একটা দেশ। এইখানে আমার খুব একটা কষ্ট করতে হইবো না। তো, এইবার ভাবলাম কোন নামীদামী লোক না, সাধারন কারো উপর ভর করবো, যাতে লোকের ফোকাসটা কম থাকে। তো আপনেই সেই নির্বাচিত ভাগ্যবান মানুষ। আপনার মাধ্যমেই আমি এখন আমার নতুন কার্যক্রম শুরু করবো।
আমি বললাম, অতি উত্তম কথা। এখন আমার কথা শুনেন। আপনের কিছু অনুমান মিলে যাচ্ছে এইটা ঠিক। কিন্তু তাই বইলা এইটা ভাইবেন না যে আপনের মতো পাগল-ছাগলের কথা আমি বিশ্বাস করবো। আপনে যে শয়তান, তার প্রমান কি? আর শয়তান হইলেও আপনের কথা আমি মানবো তা আশা করেন কেমনে? আপনেরে তো পুলিশে দেওন দরকার! নিশ্চয়ই কোন পাগলা-গারদ থিকা ভাইগা আসছেন!
আমি এই কথা বলার সাথে সাথে কেমন একটা ঝোড়ো বাতাস উঠলো। ধুলায় চারদিক ভরে গেল। ধুলার হাত থেকে বাচার জন্য আমি মুখ ঢেকে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। একটু পর বাতাস কমতে চোখ খুলে দেখি, অচেনা কোন একটা জায়গায় বসে আছি। পরিবেশটাই কেমন যেন ভুতুড়ে! আশেপাশের গাছ-গাছালীরও কেমন যেন পোড়া পোড়া চেহারা। দিনের আলো নাই, কিন্তু কেমন যেন একটা গা ছমছম করা আলো। সেই আলোতে দেখি, পায়ের কাছে এক ভয়াল-দর্শন বানর বসে আছে!
সেই বানরই কথা বলে উঠলো, দ্যাখ.......আমিই শয়তান! আমারে অবিশ্বাস করলে আর আমার কথা না শুনলে তোর খবর আছে কইলাম। মনে রাখবি, তুই এখন আমার দখলে!
হালার বান্দরে কয়কি? কথা শুনে আমার চান্দি গরম হয়ে গেল। স্থান-কাল-পাত্র ভূলে আমি লাফিয়ে উঠলাম। বললাম, দ্যাখ হুমুন্দির পুত, তুই শয়তান হ আর বান্দরই হ, জাইনা রাখ আমরা বাংলাদেশী.......বীরের জাতী। কারো কাছে মাথা নত করা আমাদের স্বভাবে নাই। শয়তান পাইক্কারাই আমাদেরকে নত করতে পারে নাই, সেইখানে তুই তো কিছুই না! ভালো চাইলে তোর এই বান্দরের সুরত নিয়া অন্য কোনখানে যা। এইখানে তোর কোন ভবিষ্যত নাই।
আমার কথা শুনে বান্দররুপী শয়তান প্রচন্ড ক্ষেপে গেল। এক লাফে আমার কোলে চড়ে বসে আমার গলা চেপে ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বললো, তোর এত্তোবড় সাহস? পাইক্কাদের সাথে আমার তুলনা করোস। পাইক্কাগোরে পয়দা করছে কে? আমার কথা না শুনলে তোর আইজকা খবরই আছে!
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
গালে প্রচন্ড ব্যথা নিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। দেখি আমার বউ জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আশপাশ দেখে হাফ ছেড়ে বাচলাম। যাক, স্বপ্ন দেখছিলাম তাহলে? কিন্তু বুঝলাম না, স্বপ্নে শয়তান তো আমার গলা চেপে ধরেছিল; গাল কেন ব্যথা করছে? বউকে বললাম, ব্যথায় চোয়াল তো খুইলা পরার উপক্রম, ঘটনা কি জানো কিছু?
বউ ঘোষণার ভঙ্গিতে জবাব দিল, আমার নানী বলতো......কারেন্টে ধরলে লাঠির বাড়ি, আর বোবায় ধরলে হাতের বাড়ি, মানে থাপ্পড় হইলো সবচেয়ে ভালো অষুধ! তুমি ঘুমের মধ্যে দাপাদাপি আর অ্যা অ্যা করতেছিলা, তাই একটা থাপ্পড় দিছি।
চোয়াল ডলতে ডলতে বাথরুমের দিকে হাটা দিলাম। এক থাপ্পড়ে এই অবস্থা! এতো দেখি মহিলা হারকিউলিস! সাবধান হওয়া দরকার এখনই!! বাথরুমের কাজ সেরে আয়নায় মুখ দেখলাম, গাল টমেটুর মতো লাল হয়ে আছে। হঠাৎ মনে হলো, বুক পকেটে কিছু একটা আছে।
বের করে দেখি..............পাচটা একহাজার টাকার নোট!!!
ছবিঃ গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১০