
হুজুগে জাতি হিসাবে আমাদের একটা বদনাম আছে। কেউ একটা কিছু করে সাফল্য পেলে বা আনন্দ পেলে আমরা পুরো জাতি কেন জানি সেটাতে ঝাপিয়ে পরি, যেন সেটাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। গার্মেন্টেসে যখন প্রথমদিকে সাফল্য এলো, তখন দেখতাম, মানুষ ব্যবসা বলতে প্রধানতঃ গার্মেন্টসই বুঝতো। যেন এই সেক্টর ছাড়া দুনিয়াতে আর কোন ব্যবসা নেই। পড়ালেখাতেও একসময়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান আর ব্যবসা প্রশাসনের যুগ গিয়েছে। তখন কারো কারো ভাবভঙ্গি দেখে মনে হতো এই দুই বিষয়ের বাইরে পড়ালেখা করলে বাকী জীবন ভিক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। দুনিয়াতে যে আরো হাজারটা বিষয় আছে; সেগুলোতে পড়ালেখা করলেও যে জীবনে সাফল্য লাভ করা যায়, এটা তাদের কে বোঝাবে তখন? ছাত্র-অভিভাবক সবাই একই দিকে ধাবিত। কার মগজ কতোটুকু ধারন করতে পারবে কিংবা কার মেধা কোনদিকে বেশী; সেসব যাচাই-বাছাইয়ের কোনও বালাই নেই। এখন দেখি ছেলে কিংবা মেয়ে কোন ব্যাপার না, ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করে দাও। সন্তান দুবলা, পাতলা কিংবা অশক্ত? কোন ব্যাপারই না। কমপ্লান খাইয়ে মাঠে পাঠিয়ে দাও.......মাশরাফি হয়ে ফিরে আসবে!
এসব হচ্ছে নাদান এবং সাধারন মানুষের কথা। এরা হুজুগে; তবে কি আর করা, চরিত্রটাই যে এমন! কিন্তু আমাদের নেতা-নেত্রী, যারা দেশকে পরিচালিত করছে তারা যদি হুজুগে হয়ে যায় তাহলে কিভাবে কি? গতকাল একটা খবর পড়ে একেবারে বাক্যহারা হয়ে গেলাম। খবর হলো, মহাকাশে দ্বিতীয় স্যাটেলাইট পাঠানোর পরিকল্পনা করছে সরকার view this link। ভাবে মনে হচ্ছে, আমরা স্যাটেলাইট হুজুগের যুগে পদার্পন করছি। আমাদের জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধুর নাম মহাকাশে একবার পাঠিয়ে আমরা ক্ষ্যান্ত দিবো না, বার বার পাঠাবো। মহাশুন্যের আনাচে-কানাচে আমাদের জাতীর পিতার নাম ছড়িয়ে দিবো। জানিনা, এটা আমাদের জাতীর পিতার স্বপ্ন ছিল কিনা!
বুঝতে পারছি, এটুকু পড়ার পর আওয়ামী লীগের সমর্থক যারা আছে তারা ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু তবুও আমি এসব কথা আর না বলে পারছি না। আপনারা আমাকে আজ 'দাবায়ে' রাখতে পারবেন না। আমার একটা বিশ্বাস আছে; ব্লগাররা যে পন্থিই হোন না কেন, সবাই উচ্চ শিক্ষিত এবং সবাই দেশের ভালোটাই চান। প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, আমি ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি বুঝি না। আমি দেশ বুঝি, দেশের উন্নতি বুঝি; সেটা যার হাত ধরেই আসুক না কেন! তিনি এমনকি একজন ডিক্টেটর হলেও আমার আপত্তি নেই। তাই আওয়ামীপন্থি ব্লগারদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ থাকবে, উনারা যেন আমার এই পোষ্ট পুরোটা পড়েন এবং পোষ্টের বক্তব্য অনুধাবনের চেষ্টা করেন।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যেটা বুঝি........তা হলো একটা সংসার, একটা ব্যবসা এবং একটা রাষ্ট্র; এই তিনটাতেই পরিচালনাগত তফাৎ খুব একটা নেই। মূল তফাৎ শুধুমাত্র আকৃতিগত। সুতরাং আমি যদি সার্বিকভাবে বাংলাদেশের কথা না বলে একটা পরিবারের কথা বলি, মনে হয় ব্যাপারটা সবদিক দিয়েই একটু সহনীয় হবে।
জীবনের সব ক্ষেত্রে, সব পর্যায়ে প্রয়োরিটি সেটিং বলে একটা কথা আছে। সেটা রাষ্ট্র, ব্যবসা কিংবা পরিবারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উদাহরন দেই। একবার একটা পরিবারের কর্তা পড়েছেন মহা সমস্যায়। রাজধানীর সার্বিক যানবাহন পরিস্থিতি বিবেচনায় পুরো পরিবারের কষ্ট লাঘবের জন্য উনার একটা গাড়ী কেনা খুবই জরুরী। ভালো একটা গাড়ী কেনার টাকাও উনি অনেক কষ্টে যোগাড় করেছেন। এরই মধ্যে ছেলে একটা ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। বেশ ভালো এমাউন্ট দরকার সেটার জন্য। গাড়ী না কিনলে উনি এই এমাউন্ট দিতে পারেন। এখন উনার করনীয় কি? একেবারে গাধা না হলে যে কেউ বলবে, আরে ভাই, এতোদিন কষ্ট করেছেন, আরো কিছুদিন না হয় করলেন! ছেলের ভবিষ্যত আগে নাকি অন্য কিছু? গাড়ী বাদ দিয়ে ছেলের ভবিষ্যত ঠিক করেন আগে। গাড়ী পরেও কিনতে পারবেন, কিন্তু ছেলের ভবিষ্যত এখনই যদি ঠিক না করেন, তাহলে আর পারবেন না। আপনাদের কি মনে হয়? ভদ্রলোকের কি করা উচিত? বুুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট, নয়কি?
কিছু কিছু সমস্যা আছে যেগুলোর সমাধান হলে অন্য অনেক সমস্যার অটোম্যাটিক-সমাধান হয়ে যায়। অশিক্ষা-কুশিক্ষার সমস্যা তেমনি একটা সমস্যা। কোন কালে, কোন যুগেই শিক্ষার কোন বিকল্প ছিল না, এখনও নেই। আমাদের দেশের শিক্ষার সামগ্রিক চিত্রটা কেমন? এক কথায় বললে, ভয়াবহ! দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তারাও তা বিলক্ষণ জানে। তাদের সন্তানরা তাই বিদেশে যায় উচ্চশিক্ষার জন্য। আর এরা দেশের মানুষকে অশিক্ষিত রেখে স্যাটেলাইট উড়ায় কোন এক অজানা এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য! আমি অবশ্যই মানছি; হ্যা, আমাদের স্যাটেলাইট, পারমানবিক বোমা, স্টিলথ জঙ্গী বিমান, বিমানবাহী জাহাজ, সাবমেরিন, ঘরে ঘরে বিএমডাব্লিউ গাড়ি সবই দরকার। এর প্রতিটার জন্য আমি মোক্ষমসব যুক্তি দিতে পারি। কিন্তু তার আগে কি দরকার? প্রয়োরিটি সেটিং কি বলে? জনগনের মৌলিক চাহিদা পূরণের দিকে নজর না দিয়ে এসবের পিছনে টাকা খরচের আদৌ কোন যুক্তি আছে কি? যে শিশুটি পড়ালেখা বাদ দিয়ে টাকা উপার্জনের জন্য শিশুশ্রমিক হতে বাধ্য হয় কিংবা যে মেধাবী ছাত্রটি ভালো রেজাল্ট করার পরও টাকার অভাবে উচ্চশিক্ষা না নিতে পেরে রিকসাচালক বনে যায়, তার কাছে স্যাটেলাইট কি আশীর্বাদ? নাকি অভিশাপ?
আমার এক বন্ধুর কাছে শোনা; তার দাবী অনুযায়ী এটা একটা সত্যি ঘটনা। এক দুতাবাস কর্মকর্তা বিদেশে কোন এক রাতের পার্টিতে এক ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হাউ ইজ ইয়োর বডি টুনাইট? বলাই বাহুল্য, উনি বলতে চেয়েছিলেন, আপনার শরীর কেমন আছে কিংবা আপনি কেমন আছেন? ট্রানশ্লেসান করতে গিয়েই না এই বিপত্তি! আমরা জানি, বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারে লিষ্টের একেবারে উপরের দিকের ক্যান্ডিডেটরাই যায়। তাদেরই যদি এই অবস্থা হয়, লিষ্টের নীচের দিকের লোকজনের অবস্থা কি? বলতে পারেন, এটা গল্প, বাস্তবে এমনটা ঘটে নাই। আমি বলবো, হতে পারে, আবার নাও হতে পারে! তবে এর চেয়ে ভয়াবহ ইংরেজি-বলুয়া রাষ্ট্রদূতের প্রমান আমি দিতে পারি!
শিক্ষা খাতে আমরা জাতীয় বাজেটের কতোভাগ খরচ করি? কিংবা যতোটুকুই করি তার কতোটুকু প্রকৃত শিক্ষার জন্য ব্যয় করি? আমি কোন উন্নত কিংবা প্রতিবেশী দেশের সাথে তুলনামূলক পরিসংখ্যানে যাবো না। আপনারা চাইলেই ওসব দেখতে পারেন। তাছাড়া, কে কি করছে তা আমার কাছে যতোটা বিবেচ্য বিষয়; তার চেয়েও অধিকতর বিবেচ্য বিষয় হলো, আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থায় প্রকৃত শিক্ষার অভাব কতোটুকু প্রলয় সৃষ্টি করছে সেটা অনুধাবন করা। আমার প্রতিবেশী প্রতিদিন পোলাও খায় সেটা দেখে আমার কি লাভ? বরন্চ আমি প্রতিদিন ঠিকমতো ভাত খেতে পারি কিনা, সেটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত!
সবশেষে একজন বিখ্যাত কবির কবিতার দু'টো লাইন আপনাদের সামনে পেশ করলাম। এর মর্মার্থ আপনারা নিজগুনে বুঝে নিবেন।
বুঝবি না এখন, বুঝবি কাল
চুলকাবি মাথা, ছিড়বি বাল!
ছবি: গুগল থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১৯ ভোর ৪:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




