- কি নাম?
- জ্বী….তারেক সীফাত।
- তোমরা কি দুই ভাই?
- জ্বী।
- দু’জনের নাম তো একসাথে জিজ্ঞেস করি নাই। তোমার নাম কি? তারেক না সীফাত?
- এই……পুরোটাই আমার নাম।
- এই নাম কে রেখেছে? নামের শেষে পদবী থাকতে হয়। তোমাদের পদবী কি সীফাত? আমার বয়স ৫৭ ছুই ছুই; এমন পদবী কস্মিনকালেও শুনি নাই।
কি বলবো? বলার মতো কিছু খুজে পাচ্ছি না। বসে বসে কুল কুল করে ঘামছি। এই রুমের এসি মনে হয় ঠিকমতো কাজ করে না। লাবনী আমাকে এই রকমের একটা ঝামেলায় ফেলবে চিন্তাও করি নাই। লাবনী নামটা এখন আমার কাছে মোটেও লাবন্যময় মনে হচ্ছে না। আমাকে এখানে, ওর বাবার সামনে বসিয়ে দিয়ে সে ভেগেছে। উদ্ধারের আশায় বারে বারে দরজার দিকে তাকাচ্ছি, কিন্তু লাবনীর টিকিটাও নজরে পরছে না। হঠাৎ মাথায় চিন্তা এলো, আচ্ছা, লাবনীর কি টিকি আছে? না, তা কি করে হয়, ওতো উচু করে পনিটেইল বাধে। অবশ্য আশেপাশে চুল না থাকলে ওটাকেই একটা টিকি হিসাবে ধরে নেয়া যায়। এসব সাতপাচ ভাবনার মধ্যেই আরেকটা প্রশ্ন ধেয়ে এলো আমার দিকে।
তুমি কি কোন রকমের নেশা-টেশা করো?
এর মধ্যেই ঝড়ের বেগে লাবনী ঘরে ঢুকলো। বাবা, বড় ফুপ্পি ফোন করেছে। তোমাকে ডাকছে। কি নাকি জরুরী কথা আছে তোমার সাথে।
সামাদ সাহেব হাতের দৈনিকটা রেখে উঠে দাড়ালেন। চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি বসে থাকো, নড়াচড়া করবে না একদম। আমি আসছি।
লাবনী তার গালে টোলপরা বিখ্যাত হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি তো দেখি একেবারে গোসল হয়ে গিয়েছো। এতো ভয় পেলে আমাকে বিয়ে করবে কিভাবে? চলো, বের হই।
ওর এই টোল পরা হাসিটা দেখলে আমার সব টেনশান মূহুর্তে দূর হয়ে যায়। বললাম, তোমার বাবাতো আমাকে বসতে বলে গিয়েছেন। এখন যাবো কিভাবে?
আরে দূর! লাবনী হাত দিয়ে মশা তাড়ানোর ভঙ্গি করলো। বড় ফুপ্পিকে আমিই ফোন করেছিলাম। উনি সব জানেন। উনিই বাকীটা ম্যানেজ করবেন। তোমার সাথে শুধু বাবার মোলাকাত করানোর দরকার ছিল। ব্যস, আর কিছু না। বসে বসে ঘামাটা তোমার বোনাস। চলো এখন।
এই হচ্ছে লাবনী। আমার প্রেমিকা। আমি এখনকার ছেলেপুলেদের মতো গার্লফ্রেন্ড টার্লফ্রেন্ড বলি না। না, ভুল বুঝবেন না। আমিও এ’যুগেরই ছেলে, শুধু চিন্তা-চেতনায় একটু আলাদা, এই আর কি। গার্লফ্রেন্ড মানে হলো মেয়েবন্ধু। সে আমার আরো আছে। তাই বলে ওদের সবার সাথে তো আর আমি প্রেম করি না। যার সাথে প্রেম করি, সে আমার প্রেমিকা। সোজা হিসাব।
লাবনীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়টাকে নাটকীয় বলা যায় কিনা, আমার সন্দেহ আছে। আপনাদেরকে বলি, আপনারাই বিচার করেন।
আজ থেকে তিন বছর আগের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ করেছি মাত্র। কিছুদিনের মধ্যেই মাস্টার্সের ক্লাশ শুরু হবে। এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এনেক্স ভবন যাচ্ছিলাম। টিএসসির সামনে হালিমওয়ালাকে দেখে দাড়ালাম। টিএসসির সামনে হালিমওয়ালার উপস্থিতি সচরাচর চোখে পরে না। বললাম, মামা, এক বাটি। টক ঝাল বেশী কইরা দিবা। চোখের পানি নাকের পানি য্যান এক্কেরে এক হয়া যায়। বুঝছো নি, কি কইলাম! মামা সবজান্তার মতো বড় করে মাথা দোলালো। বুঝেছে। এমন সময় শুনি কে যেন ফ্যাচ ফ্যাচ করে হাসছে। শব্দের উৎস অনুসরন করে দেখলাম, হালিমের বিশাল হাড়িটার ওপাশে একটা পনিটেইল দেখা যায়। গলা একটু লম্বা করে দেখি, এক মেয়ে হালিম খাচ্ছে। আমাকে দেখে মুখে হাত দিল।
বললাম, আপনিই কি এমন বিশ্রীভাবে হাসছিলেন? মেয়েটা হাল্কা করে মাথা ঝাকালো। চরম বিরক্তি নিয়ে বললাম, হাসির কারনটা জানতে পারি?
মেয়েটা আমাকে পাত্তা না দিয়ে হালিমওয়ালাকে বললো, মামা, আমারেও আরেক বাটি। টক ঝাল বেশী কইরা দিবেন। চোখের পানি নাকের পানি য্যান এক্কেরে এক হয়া যায়। বুঝছেন নি, কি কইলাম!
মেয়েটার কাজ-কারবার দেখে রাগে হতবাক হয়ে গেলাম। এ দেখি আমাকে নকল করে! রাগ চেপে বললাম, কি হলো, বললেন না হাসির কারন?
মেয়েটা এবার মুখ থেকে হাত সরিয়ে বললো, ভাইয়া, রাগ করবেন না। আমার দাদী বলতেন, ছেলেরা বেশী টক খেলে বুদ্ধি কমে যায়। সেজন্যে হাসছিলাম….হি হি হি।
মেয়েটার চলনসই ফর্সা মুখটার দিকে তাকিয়ে একেবারে চিৎপটাং হয়ে গেলাম। কি সুন্দর টোল পরেছে দুই গালে। আমার সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন একটাই। টোলপরা গালওয়ালা কোন একটা মেয়ের সাথে প্রেম করবো। দেখতে দেখতে ভার্সিটির জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এখনও তেমন কাউকে পেলাম না। বললাম, শুধু ছেলেদেরই বুদ্ধি কমে? মেয়েদের কমে না?
না, মেয়েরা টক-প্রুফ। তাদের কিছুই হয় না।
সপ্তাহ দুই পরের কথা। মধুর ক্যান্টিনের সামনে খুব গন্ডগোল হচ্ছে। বিকট শব্দে দু’টো ককটেলও ফুটলো। আমি কেন্দ্রিয় লাইব্রেরী থেকে মাত্র বের হয়েছি, যাবো আমার ফ্যাকাল্টিতে, কমার্স ফ্যাকাল্টি। মধুর ক্যান্টিনের সামনে দিয়েই যাওয়া দরকার, তবে নিরাপদ না। তাই একটু ঘুরে ডাকসু ভবনের সামনে দিয়ে ক্যাম্পাস শ্যাডোর দিকে চলে এলাম। দেখি সেদিনের সেই মেয়েটা বেকুবের মতো বিকারহীনভাবে মধুর ক্যান্টিনের দিকেই যাচ্ছে। কাছে গিয়ে বললাম, ওদিকে কই যান। শব্দ শোনেন নাই, গন্ডগোল হচ্ছে!
মেয়েটা বললো, কিন্তু আমাকে নিতে বাবা গাড়ী পাঠাচ্ছে। আমি বলেছি, মসজিদের সামনের গেটে আসতে!
আমি বললাম, এখুনি ফোন করে নিষেধ করে দ্যান। গাড়ী এখন না আসাই ভালো। আপনি মনে হচ্ছে নতুন? কোন ফ্যাকাল্টি?
এরমধ্যেই পর পর আরো কয়েকটা ককটেল ফুটলো আর দেখি মধুর ক্যান্টিনের দিক থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়িমড়ি করে এদিকেই ছুটে আসছে। ক্যাম্পাসের অতি-পরিচিত দৃশ্য! মেয়েটা নতুনই হবে, দেখলাম প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। ওকে নিয়ে ভিসির বাংলোর সামনে চলে এলাম। এর মধ্যেই ওর বাবাকে বিষয়টা জানালো। পর পরই ওর মায়ের ফোন। লাবনীর কাছে সব শুনে ওর মা আমাকে বললো, বাবা, তুমি একটু কষ্ট করে ওকে বাসায় নিয়ে আসো। মেয়েটা নতুন ভর্তি হয়েছে। এসব কোনদিন দেখেনি!
এরপর আর কি! নাম জানলাম, বাসা চিনলাম। আমাদের ফ্যাকাল্টি একই, শুধু ডিপার্টমেন্ট আলাদা। ধীরে ধীরে আমার কাংখিত প্রেমও হয়ে গেল। অত্যন্ত মসৃণ গতিতে আমাদের প্রেম এগিয়ে চললো। একেবারে যাকে বলে ''স্মুথ এজ সিল্ক''! এর মধ্যে আমি পাশ করে বের হলাম, একটা চাকুরীও জুটিয়ে ফেললাম। সমস্যা শুরু হলো গতমাসে। যখন লাবনীর বাবা লাবনীকে জানালো যে, উনার এক বন্ধুর ছেলেকে উনার খুবই পছন্দ। ছেলে জার্মানীতে পড়ালেখা শেষ করে ওখানেই ভালো চাকুরী করছে। আগামী মাসে দেশে আসবে বিয়ে করতে। কথাবার্তা মোটামুটি ফাইন্যাল।
লাবনীর জরুরী কল পেয়ে অফিস থেকে মিথ্যা কথা বলে বের হয়ে এসেছি। এখন বসে আছি রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনের মাঠে। বাবার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়ে ও এখন বসে বসে একমনে ঝালমুড়ি চিবুচ্ছে। চেহারায় কোন হেলদোল নেই। আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। বললাম, নির্বিকারভাবে ঝালমুড়ি খাচ্ছো যে বড়? এখন কি করবা?
কি আর করবো। ইউরোপের কোন একটা দেশে সেটল হওয়ার আমার খুব শখ। জার্মানী দেশটাও খারাপ না, কি বলো? ইউরোপের মধ্যেই তো। সমস্যা শুধু একটাই। নতুন একটা ভাষা শিখতে হবে। তুমি তো ইউরোপে সেটল হতে পারলা না। আফসোস!!
রাগে চিড়বিড় করে উঠলাম আমি। এতোদিন তাহলে আমার সাথে অভিনয় করেছো? আমি তো কোনদিন স্বপ্নেও ভাবি নাই, তোমার সাথে প্রতারণা করার কথা! আর এখন এক জার্মানী দেখেই তোমার মাথা ঘুরে গেলো!
তোমাদের, ছেলেদের নিয়ে এই এক সমস্যা। প্র্যাকটিক্যাল চিন্তা একেবারেই করতে পারো না। তোমার সাথে যখন প্রেম করেছি, তখন তো এই অফার ছিল না, তাই না! তোমার চেয়ে ওই ছেলে যে ভালো এটা কি তুমি অস্বীকার করতে পারো? তাহলে বোঝাও, কোন যুক্তিতে আমি তোমাকে বিয়ে করবো? মুচকি হেসে বললো লাবনী।
ওই ছেলে তোমাকে আমার মতো ভালোবাসতে পারবে? আর তোমার মনে যদি এই ছিল তাহলে তোমার বাবার সাথে দেখা করার জন্য জোরাজুরিই বা করেছিলে কেন? আর দিশামিশা না পেয়ে বললাম। ইচ্ছে করছে বেইমানটার টোলপরা গালে কষে একটা চড় মেরে এখান থেকে চলে যাই।
আমার কথা শুনে রীতিমতো বিরক্ত হলো যেন লাবনী। বললো, বাংলা সিনেমার ডায়লগ দিও না তো! ভালো লাগে না শুনতে। দুনিয়াতে এমন কোন ছেলে পয়দা হয় নাই যে আমাকে ভালোবাসবে না।
এই নির্লজ্জ মেয়েমানুষটার সামনে আর এক মুহুর্তও বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না আমার। লাবনী বসে বসে মোবাইলটা নাড়াচাড়া করছিল, হঠাৎ বেজে উঠলো ওটা। একমিনিট দাড়াও, বলে একটু দুরে সরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো ও। উঠে দাড়ালাম। সম্ভবতঃ ওই জার্মান বদমাশটা। সকাল-বিকাল, যখন-তখন নাকি ফোন করে! এখানে বসে থাকার আর কোন মানে নেই। ঘুরে হাটা দিলাম। নিজেকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত লাগছে। মুহুর্তের মধ্যে দুনিয়াটা কেমন বদলে গেল আমার!
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পেছন থেকে কে যেনো হাতটা টেনে ধরলো। তাকিয়ে দেখি, লাবনী। মিটিমিটি হাসছে বেহায়া মেয়েটা। বললো, কই যাও? বাবা কিন্তু তোমাকেই তার মেয়ের জামাই হিসাবে মেনে নিয়েছে। গতকালই আম্মুকে গ্রীণ সিগন্যালও দিয়ে দিয়েছে। পুরাপুরি বিভ্রান্ত হয়ে বললাম, তাহলে এখন ফোন করলো কে?
কেউ না। তোমাকে ক্ষেপানোর জন্য এলার্ম সেট করে রেখেছিলাম, ওটা সেই এলার্মেরই টোন ছিল। তোমাকে কি খুব বেশী রাগিয়ে দিয়েছি?
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম বজ্জাত মেয়েটার দিকে। একে বিয়ে করলে এই মেয়ে যে আমার জীবনটাকে ফানা ফানা দিবে, এতে কোন সন্দেহই নাই। কিন্তু ভালোবেসে ফেলেছি যে! উপায়ও তো নাই কোন আর; বিয়ে করলে এখন একেই করতে হবে। সমস্যা একটাই, এই মেয়ে চাইলেই আমার রঙ্গীন দুনিয়াকে সাদাকালো, কিংবা সাদাকালো দুনিয়াকে রঙ্গিন করে তোলার ক্ষমতা রাখে। এমন ক্ষমতাশালী একজনের সাথে ঘর-সংসার করা কি ঠিক হবে?
বললাম, আর কখনও….কোনদিনও আমার সাথে কোনধরনের ফাজলামো করবা না।
ভুবনভোলানো একটা হাসি দিয়ে লাবনী আমার বাকী হাতটাও ধরলো। বললো, তুমি কি আমার বস? মাঝে মধ্যে তো অবশ্যই করবো। তুমি কিন্তু রাগ করতে পারবা না। ইন ফ্যাক্ট, কখনও….কোনদিনও আমার সাথে কোনধরনের রাগ করতে পারবা না তুমি!!!
কিছুকথাঃ অনেকদিন থেকেই মনে একটা সুপ্ত বাসনা নিয়ে আছি। একটা সহজ সরল প্রেমের গল্প লিখবো। কিন্তু মাথায় শুধু যাবতীয় জটিল চিন্তা ভাবনা আসে। হঠাৎ করেই এটা লিখে ফেললাম। আসলে কি সহজ সরল হলো? বিচারের ভার আপনাদের উপরেই দিলাম।
ছবিটা নেট থেকে ধার করা।।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৯ সকাল ১১:৫৭