আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে; যার কেউ নাই, তার আল্লাহ আছে। বিভিন্ন সময়ে আমরা বলে থাকি, এই পৃথিবী নামক গ্রহটার বাংলাদেশ নামক দেশটাকে সরকার না, স্বয়ং আল্লাহ চালান। না, কোন বিতর্ক সৃষ্টির জন্য এই কথা বলছি না। আল্লাহ আসলে সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের মালিক। উনি সবই চালান। তারপরেও এ'কথা বলার পিছনের কারন হলো, আমাদের এই দেশটা এতো অনিয়ম আর বিশৃংখলার মধ্যে চলে যে, দেশী/বিদেশী অনেকেই হয়রান হয়ে যান এই ভেবে, দেশটা আসলেই কে চালায় অথবা দেশটা চলছে কিভাবে? এত্তো এত্তো সমস্যার মধ্যেও যে দেশটা চলছে, সেটার কৃতিত্ব কোন মানুষের পাওয়া সম্ভব না। কারন, দেশের তথাকথিত চালকেরা যে যেভাবে পারছে ক্রমাগত দেশটাকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে অবিরত। তার মধ্যেই দেশটা কিংবা দেশের মানুষ কোন রকমে খেয়ে-পরে এই ধরার বুকে বেচে-বর্তে দিনাতিপাত করছে। মিরাকল বলা যায় না এটাকে?
বাংলাদেশে গ্রীষ্ম সমাগত। সাধারনভাবে গরমের সময় দেশে আমরা তিনটা কারনে অতিষ্ঠ হয়ে যাই।
প্রথমতঃ সরাসরি প্রখর সূর্য কিরণ। এই গরমে চামড়া জ্বালা-পোড়া করে। একটু ছায়ার জন্য আমরা হা-পিত্যেশ করি। বৃক্ষহীন শহরে বৃক্ষের সুশীতল ছায়া খুজি আর চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকি, কখন একটু বৃষ্টিপাত হবে। বেশী গরম হলে সময়ে সময়ে মসজিদে/মন্দিরে বৃষ্টিপাতের জন্য প্রার্থনাও করা হয়।
দ্বিতীয়তঃ উচ্চ তাপমাত্রা। দেশে মার্চ থেকেই তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে এবং একসময়ে তালপাকা গরম পড়তে থাকে। বৃক্ষ নিধনের কারনে বর্তমানে দেশে তালগাছ খুবই সীমিত, কাজেই এই কথা এখন অনেকটা কাগজে-কলমে বলার মতো একটা ব্যাপার। স্বাভাবিকভাবেই এই ওষ্ঠাগত প্রানে একটু শান্তি দেয়ার জন্য আমরা তাপমাত্রা কমার আকুতি মিনতি প্রকাশ করি প্রতিনিয়ত।
তৃতীয়তঃ বাতাসের আর্দ্রতা। এই আদ্রতার কারনে গরমের অনুভূতি তীব্রতর হয়। প্রচন্ড ঘাম হয়। মানবদেহ পানিশুন্য হয়ে পরে। এর কারনেই আদ্রতাহীন মরুভূমিতে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস হলেও ততটা গরম অনুভূত হয় না, যতোটা দেশে ৩২ ডিগ্রীতে হয়।
আসল কথায় আসি এখন। সাধারন মানুষ গরমে যখন পেরেশান হয়ে যায়, তখন এটাকে আল্লাহর গজব বলা শুরু করে। এবার অন্ততঃ গ্রীষ্মের এই তিনটা বৈশিষ্ট্যকে গজব না বলে নেয়ামত বলেন, এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। প্রার্থনা করেন, এই তিনটাই যেন আমাদের দেশে দীর্ঘস্থায়ী হয়। কারন? কারন হলো, এই তিনটা পরিস্থিতিকেই করোনা ভাইরাস প্রচন্ড ঘৃণা করে। করোনা'র এই আভিজাত্য কিংবা অপছন্দই আমাদের জন্য প্রশান্তির কারন। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজীর অধ্যাপক জন নিকলস বলেছেন, তিনটা জিনিস আছে যেটা করোনা ভাইরাস চরম অপছন্দ করে। সেগুলো হলো, প্রখর সূর্য কিরণ, উচ্চ তাপমাত্রা এবং বাতাসের আর্দ্রতা। উনি আরো বলেছেন, সূর্য কিরণ এই ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধির সক্ষমতাকে অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসে….এই অর্ধ-জীবন হলো আড়াই মিনিটের, যেটা কিনা রাতের আধারে হয়ে যায় ১৩ থেকে ২০ মিনিটের। অন্যদিকে জার্মানীর সেন্টার ফর এক্সপেরিমেন্টাল এন্ড ক্লিনিক্যাল ইনফেকশান রিসার্চ এর ভাইরোলজিস্ট থমাস পিটখম্যান বলেছেন, এই ভাইরাস তাপ সহ্য করতে পারে না। যার অর্থ হলো, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে এটার গাঠনিক কাঠামো ভেঙ্গে যায়।
একদল চীনা গবেষক স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোনোরকমের হস্তক্ষেপ ছাড়াই (চীনে এটা খুবই বিরল একটা ব্যাপার!) গবেষণার অনুমতি পেয়েছিলেন। তাদের বিষয়বস্তু ছিল করোনা ভাইরাসের আচরণ। তাদের গবেষণায় দেখা গিয়েছে কম তাপমাত্রায় এই ভাইরাস দ্রুত ছড়ায়। তাপমাত্রা যতো বাড়ে, ঝুকি ততো কমে। এই গবেষকদের ধারনা, উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমের সময়ে করোনার ঝুকি কমে যাবে। আশার কথা, বাংলাদেশের অবস্থানও উত্তর গোলার্ধে।
তবে, ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ মলিক্যুলার বায়োলজী এন্ড বায়োটেকনোলজীর পরিচালক (ইনি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গের বিশ্ব স্বাস্থ্য‘র এডজাঙ্কট প্রফেসরও বটে) ড. এলভেস মরিস সালভানা আল জাজীরা কে বলেছেন, মাটিতে থাকা ভাইরাসের জন্য উপরে বর্ণিত তিনটা অবস্থা কাজ করলেও মানবদেহে ইতোমধ্যে আশ্রয় নেয়া ভাইরাস এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না কিংবা তাদের কার্যকারিতাও হ্রাস পাবে না।
করোনা ভাইরাস নিয়ে এগুলোই শেষ কথা নয়। গবেষণা চলছে প্রতিনিয়ত। আরো নতুন নতুন বিষয় সামনে আসবে অচিরেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাস নিয়ে এখন পর্যন্ত করা সব ধরনের গবেষণা, ফলাফল এবং প্রাপ্ত জ্ঞান নিয়ে একটা ডাটাবেইজ তৈরী করেছে। এটাকে প্রত্যহ আপডেইটও করা হচ্ছে। আপনারা যে কেউ চাইলে ডব্লিউএইচও‘র ওয়েবসাইটে ''গ্লোবাল রিসার্চ অন করোনাভাইরাস ডিজিজ (কোভিড-১৯)'' এ গিয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি দেখতে পারেন। উপরে আমি আপাতঃ দৃষ্টিতে বাংলাদেশের কৌশলগত সুবিধাগুলো বলার চেষ্টা করেছি। এর অসুবিধাগুলো কি কি? এখানেই কিন্তু আমরা ধরা খেয়ে যাচ্ছি।
বিষেশজ্ঞরা সবাই মোটামুটি একটা বিষয়ে একমত। সেটা হলো, এই ভাইরাস আপাততঃ পুরো নির্মুল হবে না। বিরুপ পরিস্থিতিতে বা আবহাওয়ায় ঘাপটি মেরে থাকবে এবং সঠিক আবহাওয়া পেলেই আবার ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। কাজেই এখন মানুষ যে প্রিক্যশান নিচ্ছে সেটাকে চালু রাখার কোন বিকল্প নাই। উনারা বলছেন, শুধুমাত্র উচ্চ তাপমাত্রার উপর নির্ভর করলে বিপদ থেকে পরিপূর্ণ রেহাই পাওয়া যাবে না। কারন, একটা দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো, কতো দ্রুত এই কাঠামো সেবা দিতে প্রস্তুত আর দেশবাসী কতোটা প্রোএক্টিভ, সেটার উপরেও এর নিয়ন্ত্রণ কিংবা নির্মূল বহুলাংশে নির্ভরশীল। আর এখানেই আমাদের দূর্বলতা!
দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোর অবস্থা বলে লাভ নাই। আমাদের দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের উপরে, তারা যে কোনও স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়লেই সবাইকে ঝেড়ে ফেলে যতোদ্রুত সম্ভব বিদেশে চলে যান। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, 'পিতিবি'র অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই অবকাঠামোর উপরে উনাদের আস্থা কতোটুকু! আর এই অবকাঠামো কতো দ্রুত সেবা দিতে প্রস্তুত? সেটা সরকারী হেল্প লাইনে ফোন করলেই জানতে পারবেন। দেশবাসীর প্রোএক্টিভনেস নিয়েও এখন কথা বলতে চাই না। কান টানলে মাথাও এগিয়ে আসে সবসময়ে। কাজের কাজ কিছুই হবে না, খামোখা এই পোষ্টের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পাবে। আমি শুধু একটা বিষয়ের উপরেই আপাততঃ ফোকাস করতে চাই। সেটা হলো, আমাদের চিকিৎসক সমাজ।
আমাদের এই চিকিৎসক সমাজকে উঠতে-বসতে আমরা গালাগালি করি। অবশ্য এটা বেশীরভাগ সময়ে তারা ডিজার্ভও করে। আমার মাতা-পিতা বংশ এবং আমার স্ত্রীর মাতা-পিতা বংশ; এই দুই স্ট্রীমে বড়, ছোট, পাতি সবমিলিয়ে ডাক্তার (ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং দেশে আছে) আছে সাতচল্লিশ জন। একেবারে লিটারেলি একজন একজন করে গুনে দেখা অথেনটিক সংখ্যা। ঘনিষ্ঠ ডাক্তার বন্ধুদের কথা বাদই দিলাম। কথা হলো, এদের অনেককেই সুযোগ পেলে আমিও গালাগালি করি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এনারা দেশবাসীকে কতোটা ঝুকি নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন, সেটা আমরা কতোটুকু জানি? এদের না আছে কোন প্রোটেকটিভ গীয়ার, না আছে কোন প্রাতিষ্ঠানিক সাপোর্ট; আর না আছে রোগী এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাপোর্ট। কিছুই নাই। তারপরেও তারা জীবন বাজী রেখে যতোটুকু পারছে, সেবা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পৃথিবীর বেশ কয়েকটা উন্নত দেশেই ডাক্তাররাও সেবা দিতে গিয়ে সংক্রামিত হয়ে মারা গিয়েছেন। দোয়া করি, আমাদের দেশে যেন এমনটা না হয়।
লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, যার কেউ নাই, তার আল্লাহ আছে। মহান আল্লাহই যেন এনাদেরকে হেফাজত করেন। দেশের চিকিৎসা পেশায় জড়িতদেরকে স্যালুট। কেউ কৃতজ্ঞতা জানাক, চাই না জানাক; আপনারা আপনাদের দায়িত্ব আন্তরিকভাবে পালন করে যান। এর উত্তম প্রতিদান আপনারা অবশ্যই পাবেন কোন একদিন।
কাল রাতে ঘুম আসছিল না। বারান্দায় বসে বসে দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করছিলাম। এক পর্যায়ে মনে হলো; যে পরিমান টাকা এক বছরে আমাদের দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়, ঠিক সেই পরিমান টাকা চিকিৎসা অবকাঠামোর উন্নয়নে কোন একটা নির্দিষ্ট বছরে যদি ব্যয় করা যেতো, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্যখাত 'পিতিবি' না, 'পৃথিবী'র অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবকাঠামো নিশ্চয়ই হতে পারতো, তাই না!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলছি, এই দুর্যোগই শেষ না, সামনে আরো আছে। তবে, এটা কেটে গেলে আমরা কি তেমন কোন পদক্ষেপ আপনার কাছ থেকে আশা করতে পারি না! নির্লজ্জ, অর্বাচীন এবং দেশবাসীকে আনন্দ অথবা বিনোদন দানকারী চাটুকারদের কথা না শুনে একবার আম-জনতার কথা না হয় শুনলেনই। তাতে আপনার কি এমন ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে???
'হস্ত ধৌতকরন' সব সময়ের জন্যই একটা অবশ্য কর্তব্য হওয়া উচিত। স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতন মানুষরা করোনায় উসিলায় হলেও সচেতন হচ্ছে। এটাই বা কম কি? করোনা থাকুক বা না থাকুক, এই অভ্যাসটা যেন আজীবন থেকে যায়। গুগলের সৌজন্যে প্রাপ্ত এই ছবিটা আমাদেরকে এটাই স্মরণ করিয়ে দিক প্রতিনিয়ত।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০২০ দুপুর ১২:৪৬