কোন একটা ক্রাইসিসে একেক মানুষ একেকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। কারন, ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সবার একরকমের হয় না। মানুষ হিসাবে আমি কেমন….…..দুর্বোধ্য নাকি সহজবোধ্য? প্রশ্নটা আমার নিজের কাছেই।
গত কয়েকদিন ধরে মাথায় ঘুরছে এই প্রশ্ন। কেন ঘুরছে তা যদিও জানি, তারপরেও মাথা থেকে এটাকে বের করতে পারছি না। মানব জীবনে মন খারাপ এবং মেজাজ খারাপ, দুটোই ক্রাইসিস। 'মন খারাপ'কে আমি হ্যান্ডেল করতে পারি; বেশ ভালোভাবেই পারি। কিন্তু কেন জানি 'মেজাজ খারাপ'কে একেবারেই পারি না। আর একবার মেজাজ খারাপ হলে তার প্রভাব পড়ে চারপাশে। তাতে পরিস্থিতি আরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একসময়ে হাল ছেড়ে দেই। ভাবার চেষ্টা করি, যার ইচ্ছা সে মুড়ি খাকগে……..আমি আমার সুখ কেন নষ্ট করি!! শর্ট রানে এসব ভেবে আদপেই খুব একটা লাভ হয় না, পরিস্থিতিরও তেমন একটা উন্নতি হয় না। এমন অবস্থায় কোন একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা আমাকে পূর্বাবস্থায় ফেরাতে ম্যাজিকের মতো কাজ করে। প্রসেস অফ ডিফ্লেক্টিং দ্য মাইন্ড!!
ব্লগের একটা ব্যাপার নিয়ে গত কয়েকটা দিন মন-মেজাজ ছিল খুব খারাপ। ব্লগে আসতে ইচ্ছা করে না, আবার না এসেও পারি না। ছাড়া ছাড়াভাবে দু‘একটা পোষ্ট মাঝে-মধ্যে দেখি, কিন্তু কোন মন্তব্য করতে ইচ্ছা করে না।
এমনি এক অবস্থায় হঠাৎ বুলবুলভাইয়ের ফোন পেলাম। থাকেন পর্তুগালে। ব্যবসার কাজে শুক্রবার লন্ডনে এসেছেন। ২/৩ দিন থাকবেন। জানালেন, কতোটা কাঠখড় পুড়িয়ে আমার নাম্বার উনি যোগাড় করেছেন। কাতর কন্ঠে অনুরোধ করলেন, আমি পারলে যেন রবিবারে একবার দেখা করি।
উনার এই একেবারেই অপ্রত্যাশিত ফোনকল পেয়ে আমি এক ঝটকায় ফিরে গেলাম আমার শৈশবে। উনার সাথে আমার শেষ দেখা হয়, সেটাও দেশে; প্রায় বিশ বছর আগে। একটা বিশেষ ঘটনার বা আরো নির্দিষ্ট করে বললে, ভুল বোঝাবুঝির গেরোয় পড়ে সেটাই শেষ দেখা এবং কথা বলা। এরপরে উনিও আমাকে সম্ভবতঃ ভুলে গেলেন, আমিও উনাকে। হঠাৎ বিদেশ-বিভুইয়ে উনার ফোন আমার কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই একটা ব্যাপার! পুরানো ঘটনাগুলোকে একশত হাত দুরে ফেলে দিয়ে গতকাল লন্ডনে ছুটে গেলাম, দেখা করলাম। জানলাম, হঠাৎ পুরানো অভিমান ভুলে গিয়ে আমাকে খুজে বের করার কাহিনী। সেটা অন্য কাহিনী…….আপাততঃ সরিয়ে রাখি। দেখলাম, চুল-দাড়িতে সাদার আধিক্য ছাড়া মানুষটার তেমন একটা পরিবর্তন হয় নাই।
অনেক অনেক আগের কথা। আমি তখন ম্যাপল লীফ ইন্টারন্যাশনালের ক্লাস ফোরের ছাত্র। আমাদের পাশের বাসায় বুলবুল ভাইদের পরিবার এসে উঠলেন। অচিরেই দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়া-আসা শুরু হয়ে গেল এবং এক পর্যায়ে উনার আব্বা-আম্মা আমার আব্বা-আম্মার জিগরী দোস্ত বনে গেলেন। পুরানো ঢাকায় তখন তরকারীর বাটি চালাচালির কালচার ছিল। কোন বিশেষ উৎসব বা উদযাপনের প্রয়োজন হতো না, এমনিতেই; যখন-তখন। ভর্তা-ভাজি থেকে শুরু করে যে কোন কিছুই আশেপাশে চালান হতো নিয়মিত। কারো বাসায় বাটি নিয়ে যাওয়া আমার ছিল চরম অপছন্দের একটা ব্যাপার, আম্মা তাই পারতপক্ষে আমাকে ঘাটাতেন না। একদিন দুপুরে বললেন, বুলবুল তোকে যেতে বলেছে, যা দেখা করে আয়……...আর যাওয়ার সময় এই বাটিটা নিয়ে যাস!!!
বুলবুল ভাইও ম্যাপল লীফে পড়তেন, ক্লাস নাইনে। উনাকে পছন্দ করতাম খুবই। ড্যাশিং টাইপের ছিলেন, আমাদের বয়েসীদের চোখে হিরো। কিন্তু কাছে ঘেষতাম না বয়সের বড় পার্থক্যের কারনে। দরজা উনিই খুললেন। আমাকে বসালেন, তারপরে বললেন, কিরে, তুই নাকি পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাদিন গান শুনিস? কি গান শুনিস? সে সময়ে আম্মাদের বাটি চালাচালির মতো আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ক্যাসেট চালাচালি হতো। ব্যক্তিগত মালিকানার ক্যাসেট ছিল সীমিত। ঘুরে ফিরে হাত-বদল হয়ে যেসব গান শুনতাম তার মধ্যে ব্যান্ড হিসাবে যতোটুকু মনে পরে বি জি'স, ডীপ পার্পল, রোলিং স্টোন, এ্যাবা, বনি এম ইত্যাদি আর সোলো'র মধ্যে স্টিভি ওয়ান্ডার, রড স্টুয়ার্ট, ম্যাডোনা, জর্জ মাইকেল; আর ওয়ান এন্ড ওনলি মাইকেল জ্যাকসন তো ছিলই। বুলবুল ভাইয়ের ক্যাসেটের বিরাট কালেকশান ছিল। উনার হাত ধরেই স্করপিয়নস, ইগল্স এর মতো ব্যান্ড আর কান্ট্রি মিউজিকের জন ডেনভার, কেনি রজারর্স; এরিক ক্ল্যাপটন, ক্রিস ডি'বার্গ, ফিল কলিন্স, ডোনা সামার, উইলি নেলসনের মতো ক্যারিশম্যাটিক গায়কীর সাথে পরিচয় ঘটে আমার। আমার গান শোনার জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন উনি!!! ধুম-ধারক্কা থেকে এক ধাক্কায় মেলোডিয়াস!!
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ে একটা বিশাল ঝড়ে আমার চেনা-পরিচিত জগতে এক বিরাট ধাক্কা লাগে। বুলবুল ভাই প্রেমের টানে দিওয়ানা হয়ে উনার এক ক্লাসমেটকে নিয়ে একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করেন। এই তোলপাড় করা ঘটনায় আমার বড় চাচা আব্বাকে বললেন, এই কো-এডুকেশানের ইংলিশ মিডিয়ামের পোলাপাইনগুলার কামই হইলো গান শোনা, সারাদিন হৈ হুল্লোড় আর প্রেম করা। তোমার ঘরেও এমন একটা বান্দর আছে। অতএব সাধু সাবধান!!! বুলবুলভায়ের সাথে আমার অতিরিক্ত সখ্যতা কাল হয়ে দাড়ালো। আব্বা ম্যাপল লীফ থেকে আমাকে টেনে হিচড়ে বাড়ির পাশের ওয়েষ্ট এন্ড স্কুলে (পুরাই বয়েজ) এনে ধপাস করে ফেলে দিলেন। সেটা অবশ্য পরবর্তীতে আমার জন্য শাপে বর হয়ে দাড়ায়। ওখানে ইউনিফর্ম ছিল, তবে না থাকার মতো। সবাই ফ্রি-স্টাইলে চলাফেরা করতো। পরিচিত এলাকা হওয়াতে স্কুল পালানো আমার জন্য একটা রুটিন ওয়ার্কে পরিনত হয় একটা সময়ে।
মেট্রিক পাশ করার পরে বন্ধুরা সবাই ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ আর ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরী কলেজে ভর্তি হলো। আর আব্বা আমার কাতর আর্তনাদ আর শত অনুনয়-বিনয় সত্বেও আমাকে নিয়ে বস্তার মতো ফেললেন বহুদুরে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। উনার ভয় ছিল, ওয়েষ্ট এন্ডে আমি যেই বাউন্ডুলেপনা দেখিয়েছি, সেটা বহুগুনে বৃদ্ধি পাবে যদি আমি এই তিন কলেজের কোনটাতে পড়ি। কাজেই কড়া অনুশাসনের আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজই ভরসা। যেই আমাকে স্কুলে ইউনিফর্ম পড়তে হয় নাই, ক্লাশ শুরুর আগে এসেম্বলীতে দাড়াতে হয় নাই; সেই আমাকেই কলেজ লাইফকে ফর্দাফাই করে এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল তখন। বন্ধুদের কাছে তাদের আনন্দ আর স্বাধীনতা ভোগের কাহিনী যতোই শুনতাম, ততোই আব্বার উপর রাগ হতো! ইডেন আর বদরুন্নেছার সামনে বন্ধুদের আড্ডা দেয়ার লালা ঝড়ানো কাহিনী আমার কাছে শুধুই কাহিনী ছিল।
সে যাই হোক, দুর্জনের যেমন ছলের অভাব হয় না; আমারও তেমনি স্ব-গোত্রিয় বন্ধুর অভাব হয়নি। আমার দেখা সবচেয়ে ত্যাদড় পোলাপান হলো আর্মি অফিসারদের ছেলেপুলেরা। কেউ আবার অন্যভাবে নিবেন না, আমি শুধুই আমার অভিজ্ঞতা বললাম। তো একপর্যায়ে যথারীতি ক্লাস ফাকি দিয়ে সাগরিকা আর গ্যারিসনে সিনেমা দেখা, এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা আর বিভিন্ন রকমের বদমাইশি কার্যকলাপ অচিরেই শুরু হয়ে যায়। আমার মতো একজন নিরীহ সাদাসিদা গোছের ভদ্র সন্তানকে কু-পথে পরিচালিত করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ছিল তিন আর্মি অফিসারের সন্তানের। সঙ্গত কারনেই তাদের নাম বলছি না!!! বুলবুলভাইয়ের অভাবে আমার সঙ্গীত ভুবনে বিচরণের যে সাময়িক বিপর্যয় ঘটেছিল, সেটা আবার পূর্ণ মাত্রা ফিরে পায় এ'সময় কালেই। বলাই বাহুল্য, এই তিনজনের কাছেও ইংলিশ গানের বেশ বড় কালেকশান ছিল।
আপনারা আবার ভাববেন না যেন যে, আমি বাংলা গান শুনতাম না। অবশ্যই শুনতাম। তবে সেটা, আম্মা বা বড়বোনের বাজানো গানের পথচলতি শোনা। নিজস্ব সময়ে নিজের মতো করে শোনা না। তবে হ্যা, প্রেম শুরু করার পর আমরা বেশ ঘটা করে প্রেমের প্রথম বর্ষ উদযাপন করি। তখন আমার 'ইয়ে' আমাকে জগজীৎ সিং এর বাংলা গানের একটা ক্যাসেট উপহার দেয়। সত্যি বলতে, সেটাই আমার ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রথম বাংলা গানের ক্যাসেট। বেদনা মধুর হয়ে যায়, বেশী কিছু আশা করা ভুল, তোমার চুল বাধা দেখতে দেখতে এর মতো চমৎকার চমৎকার সব গান ছিল ওটাতে।
আপনারা আমাকে চাইলে কটুকথা বলতে পারেন, তবে এখনও আমি আমার একান্ত সময়গুলোতে ইংরেজি গানই শুনি। কি করবো বলেন……..সারা জীবনের অভ্যাস! আমার কালেকশানে কতকগুলো গান আছে যেগুলো আমি যতোবারই শুনি, কখনও বোরড হই না। এগুলো আমি সারা জীবন শুনতে পারবো, কখনও পুরানো হবে না আমার কাছে। তার মধ্য থেকে এমনই কয়েকটা এভারগ্রীন গান আপনাদের সাথে শেয়ার করতে মন চাইলো। বেশীরভাগই হারানো দিনের গান, সবাই নিশ্চয়ই শুনেছেন; তবে আবার শুনেন, আর আমার মতোই হারিয়ে যান ফেলে আসা দিনগুলোতে।
Green Green Grass Of Home
Rhinestone cowboy
Jamaica farewell
My Heart Will Go On
Hotel California
Imagine
Home
Always On My Mind
When The Smoke Is Going Down
Lady In Red
Where are we going from here
Save The Last Dance For Me
Summer Wine
Imagine
Whiskey lullaby
What A Wonderful World
Wonderful tonight
Another Day In Paradise
Everything I Do
If Tomorrow Never Comes
Iris
Lebanese night
One More night
Right Here Waiting For You
Sailing
Send Me an Angel
So Beautiful
Stuck On You
When You Say Nothing At All
Everything That Glitters
সবার শেষে দুইটা রিফ্রেশিং মিউজিক দিলাম। প্রথমটা হলো একটা জার্মান মিউজিক্যাল প্রজেক্টের, নাম 'এনিগমা'; আর দ্বিতীয়টা ইকুয়েডরের মিউজিশিয়ান লিও রোজাস এর।
Mea Culpa
El Condor Pasa
আমি রাতের বেলা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে শুয়ে খুবই লো ভলিয়্যুমে শুনি…...চমৎকার লাগে; অন্য একধরনের জগতে চলে যাই তখন। সেই জগতে আপনাদেরকে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছি!!!
গানগুলো সব ইউটিউবের কল্যানে, আর ছবিটা গুগলের।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২০ দুপুর ১২:৫৯