ডিএসএলআর এ তোলা ছবি কিংবা ড্রোন ক্যামেরায় তোলা ভিডিও দেখে নয়, নেত্রকোনাকে আমি ভালোবেসেছিলাম সোমেশ্বরীর টলটলে স্বচ্ছ জলের কারণে।
বহুদিন ধরেই নেত্রকোনার বিরিশিরিতে সোমেশ্বরী নদীর সাথে পুনরায় সাক্ষাতের আগ্রহ বোধ করছিলাম, কিন্তু নানা কারণে সে সুযোগ হয়ে উঠছিল না। তাই যখন জানলাম রবিবারে মেয়ের স্কুল ছুটি তখন নেত্রকোনা বিরিশিরিতে বেড়িয়ে আসার চিন্তাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আর রুহুল কাদের যখন নেত্রকোনা ভ্রমণে সম্মতি দিল তখন সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ হয়ে গেলো এবং রাত সাড়ে দশটার সিদ্ধান্তে পরদিন সকালে আমরা নেত্রকোনা রওয়ানা করলাম।
সম্ভবতঃ ২০১২ সালে আমি প্রথমবারের মতো নেত্রকোনার দূর্গাপুর এবং বিরিশিরিতে যাই। এক দশক সময়ে অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। তখন আমি গিয়েছিলাম বন্ধুদের সাথে। এবার পরিবার ও বাচ্চাদের নিয়ে। সাথে আছে রুহুল কাদের ও তার স্ত্রী রিয়া। স্বাভাবিকভাবেই এবারের যাত্রায় পূর্বের অভিজ্ঞতার সাথে বর্তমানের অভিজ্ঞতার তুলনা চলেছে। এখানেও বোধহয় তার ব্যতিক্রম ঘটবে না।
নেত্রকোনার মূল আকর্ষণ দূর্গাপুরে, যদিও সবাই বলে বিরিশিরিতে। দূর্গাপুর হলো নেত্রকোনার একটি উপজেলা, বিরিশিরি তার একটি ইউনিয়ন। বিরিশিরিতে দেখার কিছু নেই, আছে থাকার জায়গা। চীনামাটির পাহাড়, নীল পানির লেক আর সোমেশ্বরী নদী অর্থ্যাৎ প্রধান ট্যুরিস্ট আকর্ষণ সবগুলোই দূর্গাপুরে। সোমেশ্বরী নদীর উত্তর পাড়ে দূর্গাপুর, দক্ষিণে বিরিশিরি। সমস্যা হলো – বিরিশিরি বা দূর্গাপুরে পরিবার নিয়ে যাওয়ার ভালো কোন ব্যবস্থা নেই। বিগত পঞ্চাশ বছরেও ছিল না। রেলপথে নেত্রকোনা গিয়ে সেখান থেকে বিরিশিরিতে আসা যায়। মহাখালী বাস টার্মিনাল হতে অল্প কিছু বাস দূর্গাপুর বা বিরিশিরিতে যায় বটে, সেগুলোয় দিনের বেলা প্রায় ছয় ঘন্টা সময় লেগে যায়। এ কারণে সাধারণত নাইটকোচেই যাওয়ার পরামর্শ দেয় অভিজ্ঞ ভ্রমণকারীরা। প্রথমবার আমিও নাইটকোচেই গিয়েছিলাম।
কিন্তু এবার জানলাম ময়মংসিংহ গিয়ে সেখান থেকে বিরিশিরি-দূর্গাপুরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাওয়া যায়, সময়টাও অপেক্ষাকৃত কম লাগে। আমরাও সেভাবে গেলাম। মহাখালী থেকে মাসকান্দা বাসে, সেখান থেকে ব্যাটারীচালিত অটোরিকশায় শম্ভুগঞ্জ, সেখান থেকে সিএনজিতে জনপ্রতি ১৭০ টাকা ভাড়ায় বিরিশিরি। ফিরেছিও একইভাবে, তবে তখন সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা।
মৌসুমী গেস্ট হাউজ
যেহেতু হঠাৎ সিদ্ধান্তে যাত্রা, সেহেতু থাকার কোন ব্যবস্থা আগে থেকে করার সুযোগ হয়নি। এবং, যেহেতু সময়টা শীতের শুক্রবার এবং পরিবার নিয়ে যাচ্ছি, তাই আবাসনের ঘাটতি থাকার সম্ভাবনা আছে এবং আগে থেকেই আবাসনের ব্যবস্থা করে নেয়া উচিত। সুতরাং, ময়মনসিংহ রুটের বিখ্যাত এনা বাসে বসে গুগল ম্যাপস ঘেঁটে বিরিশিরিতে থাকার কি কি ব্যবস্থা আছে তার তালিকা তৈরি, ফোন করে দুটো রুম ফাঁকা আছে কিনা খোঁজ করতে লাগলাম। কপাল মন্দ, কোথাও ফাঁকা নেই, কেবল মৌসুমী গেস্ট হাউজ থেকে জানালো – এগারোটার দিকে জানানো যাবে কারণ বর্তমান বোর্ডার এখনও ঘুমাচ্ছে।
প্রথমবার এসে ইয়াং ওমেন ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশন (ওয়াইডব্লিউসিএ) এর গেস্ট হাউজে উঠেছিলাম। এটি ছাড়া আরেকটি প্রতিষ্ঠান ইয়াং মেন ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশন (ওয়াইএমসিএ) এর গেস্ট হাউজে থাকা যেতো। এছাড়া কিছু হোটেল ছিল কিন্তু বাধ্য না হলে কেউ ওগুলোয় থাকতো না। এবার দেখলাম বিরিশিরিতে বেশ কতগুল থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কয়েকটি কৃষি খামারেও থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ক্যাম্পিং করা এবং তাঁবু খাটিয়ে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে কারও কারও। মজার ব্যাপার হলো – নদী বাংলা গেস্ট হাউজ নামে নতুন একটি হোটেল হয়েছে যাদের এসি ও নন এসি রুম আছে। তাদের পক্ষ থেকে জোর দিয়ে বলা হলো – এডাল্টদের জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া রুম ভাড়া দেয়া হবে না। অবাক তো হয়েছিই, বিরক্তও হয়েছি।
ঘন্টা খানেকের চেষ্টার পরেও যখন কোন ব্যবস্থা হলো না তখন মৌসুমী গেস্ট হাউজ থেকে ফোন করে জানালো – দুটি রুম ফাঁকা হবে, ভাড়া আটশ টাকা। এক কথায় রাজী হয়ে গেলাম।
ওয়াইএমসিএ এবং ওয়াইডব্লিউসিএ এর মাঝখানে মাত্র চারটা রুম নিয়ে মৌসুমী গেস্ট হাউজ। পাকা ঘর। লাগোয়া টিনের ঘরে বাচ্চাদের নিয়ে যে গারো ভদ্রমহিলা থাকেন তিনিই গেস্ট হাউজ পরিচালনা করেন। ছোট্ট জায়গা, ঘর ছাড়া আর জায়গা নেই। রুমগুলো বড়। একটা ডাবল আর একটা সিঙ্গল খাট প্রতি রুমে। আহামরি কিছু নয়, তবে পরিচ্ছন্নতা আর আতিথেয়তার কারণে পছন্দ হয়ে গেল।
ছোট্ট একটু সমস্যা আছে – টয়লেটে বদনা নেই, মগ দিয়ে কাজ সারতে হয়। অন্ততঃ একটি রুমের খাটের অবস্থান এমন যে পশ্চিমদিকে পা দিয়ে শুতে হয়। বদনা না থাকা আর পশ্চিমমুখী খাটের কথা ওয়াহিদ সুজন ভাই আগেই বলে রেখেছিলেন। উনি উকিল মুন্সীকে নিয়ে গবেষণার সূত্রে নেত্রকোনায় বেশ কয়েকবার এসেছেন। উকিল মুন্সীর বাড়ি এই নেত্রকোনাতেই। (১ম পর্ব সমাপ্ত)
(প্রায় তিন হাজার শব্দের হওয়ায় মোট চারটি কিস্তিতে প্রকাশ করবো। একসাথে পড়তে চাইলে আমার ব্লগ ঘুরে আসতে পারেন। ধন্যবাদ।)
((২য় পর্ব))
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ১২:১৯