(২য় পর্ব)
চীনামাটির পাহাড়
রাস্তা থেকে বামদিকে গ্রামের ভেতরে চীনামাটির পাহাড় এবং নীল পানির লেক। বেশ জমজমাট অবস্থা। অনেক মানুষ এসেছে বেড়াতে। পিকনিক বাস দেখলাম কয়েকটা। পর্যটন কর্পোরেশনের একটা ছোট্ট অফিস বিল্ডিং দেখা গেলো। সেখানে অবশ্য লোক ছিল না। সম্ভবত শুক্রবার ছুটির দিন বলে। তবে সেখানে পর্যটন কর্পোরেশনের কার্যক্রমের কোন প্রমাণও পেলাম না। তথ্য সংক্রান্ত বা নির্দেশনা বিষয়ক কোন সাইনবোর্ড দেখা গেলো না। পিকনিক দলের ফেলে যাওয়া ওয়ান টাইম প্লেট, খাবারের উচ্ছিষ্ট, প্যাকেট ইত্যাদির কারণে পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা হয়ে আছে।
যেহেতু পর্যটনস্থানে কোন তথ্য চোখে পড়ল না, তাই বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে চীনা মাটির পাহাড়ের ইতিহাস জেনে নিতে হলো। সংক্ষেপে উপস্থাপন করা যাক। চীনা মাটির পাহাড়কে সাদা মাটির পাহাড়ও বলা হয়। বাংলাদেশে চীনা মাটির অস্ত্বিত্ব বা খনি রয়েছে এমন জায়গার মধ্যে নেত্রকোনার বিজয়পুর ও গোপালপুর অন্যতম। এছাড়া শেরপুরের নালিতাবাড়ী, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, দিনাজপুরের মধ্যপাড়া ও বড়পুকুরিয়া, নওগাঁর পত্নীতলায় সাদা মাটির অস্ত্বিত্ব রয়েছে। সম্ভবতঃ নেত্রকোনার বিজয়পুরের চীনামাটির খনি সর্ববৃহৎ।
১৯৫৭ সালে বিজয়পুরের খনি থেকে সাদা বা চীনা মাটির উত্তোলন শুরু হয়। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন খনিজ সম্পদ ব্যুরো জানিয়েছিল, খনিতে যা সাদা মাটি মজুদ রয়েছে তার পরিমাণ ২৪ লক্ষ মেট্রিক টন যা দিয়ে ৩০০ বছরের চাহিদা মেটানো সম্ভব। প্রায় নয়টি কোম্পানী এখান থেকে চীনামাটি উত্তোলন করছে – এমন তথ্য একাধিক জায়গায় পেলেও সেরকম কোন কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
চীনা মাটি বা চায়না ক্লে বলা হয় কেন? এই প্রশ্ন আমার মাথায়ও এসেছে। স্পষ্ট উত্তর নেই। ধারণা করা হয়, চীন দেশের মানুষ প্রথম এই মাটি ব্যবহার শুরু করে। মূলত সিরামিকের জিনিসপত্র তৈরিতে এই মাটি ব্যবহার করা হয়।
বিজয়পুরের চীনা মাটির পাহাড়ের তুলনায় দর্শনীয় স্থান হলো নীল পানির লেক। পাহাড় কেটে সাদা মাটি উত্তোলনের কারণে সৃষ্ট গর্তে জমা পানিই এখনকার বিখ্যাত নীল পানির লেক। লেক এবং লেকের পার্শ্ববর্তী তীর ও পাহাড় দেখলেই বোঝা যাবে – এই পুকুর ও মাটি স্বাভাবিক নয় এবং, সম্ভবত, রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি ব্যাপক। পাহাড়ে গাছপালা বলতে তেমন কিছু নেই। কোন পাখি দেখা যায় না এবং, আমার ধারণা, পুকুরের পানি বিষাক্ত হওয়ায় কোন মাছ নেই।
জমে থাকা পানি মনে কোন ছাপ ফেলল না। আগেরবারও ফেলেনি। লেকের নাম নীল পানির লেক। ওয়েব দুনিয়ায় যা ছবি পাওয়া যায় তার সবই নীল৷ কিন্তু আমার সবুজ ছাড়া আর কোন রঙ চোখে পড়ল না। আমি বর্ণান্ধ নই, তবে খালি চোখে কেউ নীল পানি দেখেছে বলেও শুনিনি। ডিএসএলআর দিয়ে দেখার দুর্লভ ক্ষমতা আর কয়জনের থাকে!
এবারে চীনা মাটির পাহাড়ে আরও একটি পার্থক্য চোখে পড়ল। এখানে বেশ কিছু দোকান বসেছে। বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্পের পাশে পাহাড়ের পাদদেশেও দোকান বসেছে। এসব দোকানে দেশে তৈরি প্লাস্টিকের বিভিন্ন দ্রব্যের পাশাপাশি নানা রকমের কসমেটিক্স, চকলেট ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। ভারত থেকে আনা হয়েছে – এমনটাই জানালো দোকানদাররা। সত্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে কিছু কেনার সাহস হলো না। তবে কিছু চকলেট আচার কিনতে হলো এবং মুখে দেয়ার পর বুঝতে পারলাম – ঝুঁকি না নেয়াই উচিত কাজ হয়েছে, ঢাকায়ও এত নিম্নমানের জিনিস পাওয়া যায় না।
বিজয়পুর পাহাড়
আমাদেরকে চীনামাটির পাহাড় থেকে বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যেতে যেতে অটো ড্রাইভার জানালো, ওখানে আরও বেশি দোকান আছে, মালও ভালো। তার পাশে বসে টুকটাক কিছু আলাপ করতে চেষ্টা করলাম। কথা বেশিদূর এগুলো না। তার ভাষা পুরোটাই নেত্রকোনার আঞ্চলিক, সব কথা বুঝতে কষ্ট হয়। যা কিছু বুঝতে পারলাম তা থেকে বুঝলাম সে সরকারদলের কঠোর সমর্থক এবং দুর্গাপূরের সাবেক চেয়ারম্যান সুব্রত সাংমার অনুসারী। সুব্রত সাংমা চেয়ারম্যান থাকাকালেই বিজয়পুর পর্যন্ত এই রাস্তা পাকা হয়েছে। চেয়ারম্যান গারো হলেও অনেক ক্ষমতাবান ছিল। বর্ডারের দিকে বাড়ি হওয়ায় বর্ডারের ওপার থেকে মালামাল আনতে কোন সমস্যা হয় নাই। চেয়ারম্যানকে কিছুদিন আগে মেরে ফেলেছে বিএনপি সমর্থক বর্তমান চেয়ারম্যান। পত্রিকা ঘেঁটে দেখলাম – ঘটনা সত্য – গত ৮ অক্টোবর সুব্রত সাংমা মারা গেছেন।
বিজয়পুর সীমান্তে বিজিবির ক্যাম্প। তার একদিকে সোমেশ্বরী নদী, অন্যদিকে বিজয়পুর পাহাড়। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল – আমরা নদীর দিকেই গেলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে বলেই কিনা জানি না, নদী থেকে ড্রেজারের বিকট শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। নদীর ঘাটে গিয়ে মন জুড়িয়ে গেলো। দেশের সীমানার সাথেই হওয়ায় এখানে বালু উত্তোলনের কার্যক্রম নেই। প্রায় এক যুগ আগে সোমেশ্বরীর যে রূপ দেখে আমি বিমোহিত হয়েছিলাম, সেই রূপ যেন এখানে পাওয়া গেলো – শান্ত, স্থির। একটু দূরে বালুচর। আরও দূরে, নদীর ওপারে, ভারতের সীমানা।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। নদীতে পা ডুবানোর ইচ্ছা পূরণ করা হলো না।
দূর্গাপুরের গারোরা
কোথাও বেড়াতে গেলে ভোরে সূর্য উঠার আগেই ঘুম থেকে উঠতে হয়। এর ফলে সময়ে বরকত পাওয়া যায়, মনটাও চনমনে থাকে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার – এই সময়ে পৃথিবীর যে সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায় তা দিনের বাকী সময়ে সম্ভব হয় না।
পরদিন ভোরে বাচ্চাদেরকে ঘুমে রেখে আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। রুহুল কাদের তখনও ঘুমে, ডেকে সাড়া পেলাম না। মূল রাস্তায় না উঠে আমরা বরং গ্রামের ভেতরের দিকে এবং রিকশা চলাচলের রাস্তা ছেড়ে মেঠোপথ ধরলাম।
এই অঞ্চলে গারোদের সংখ্যা অনেক। বইপত্র অনুসারে গারোদের পাশাপাশি হাজংরাও থাকে এখানে, আমি পার্থক্য করতে পারি না, তাই হাজং গোত্রের কারও সাথে দেখা হয়েছে কিনা নিশ্চিত করে বলতেও পারি না।
উইকিপিডিয়া থেকে জানা গেলো, কয়েক শতাব্দী পূর্বে এই অঞ্চলে গারো সহ বিভিন্ন উপজাতির লোকেরা বাস করতো যাদের মধ্যে গারোরা ছিল সংখ্যায় বেশি এবং এই অঞ্চলের রাজাও ছিল গারো। কামরূপ কামাখ্যা থেকে সোমেশ্বরী পাঠক নামে একজন ব্রাহ্মণ এ অঞ্চলে এসেছিলেন পাঁচশ বা সাতশ বছর আগে। তারপর এই অঞ্চলের রূপে মুগ্ধ হয়ে এবং তৎকালীন গারো রাজা বৈশ্যকে পরাজিত ও নিহত করে তিনি এই অঞ্চল দখল করে নেন যা পরবর্তীতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয়শ বছর তার বংশধরদের দ্বারা শাসিত হয়েছে।
মুঘল সম্রাট আকবর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সোমেশ্বরী পাঠকের বংশধর তৎকালীন রাজা রঘুনাথ সিংহ সম্রাট আকবরের সাথে একটি চুক্তি করেন এবং চুক্তি মোতাবেক রাজা মানসিংহের পক্ষে বিক্রমপুরের চাঁদ রায়, কেদার রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন। সে সময় রঘুনাথ অষ্টধাতুর এক দূর্গামূর্তি নিয়ে এসে রাজমন্দিরে স্থাপন করেন। আর এভাবেই সু-সঙ্গের সাথে দূর্গাপুর যোগ করে এর নামকরণ করা হয় সুসং দূর্গাপুর।
(৩য় পর্ব সমাপ্ত)
(প্রায় তিন হাজার শব্দের হওয়ায় মোট চারটি কিস্তিতে প্রকাশ করবো। একসাথে পড়তে চাইলে আমার ব্লগ ঘুরে আসতে পারেন। এক দশক আগে পরের নেত্রকোনা ভ্রমণের একটি পিডিএফ-ও রয়েছে সেখানে, চাইলে ডাউনলোড করে নিতে পারেন। ধন্যবাদ।)
(শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:২১