ক
আগামী ২৯ জুলাই '০৯ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠীত ১০ সদস্যের সংসদীয় কমিটি টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের প্রস্তাবিত এলাকা পরিদর্শণে যাবেন। ১০ সদ্যসের এই কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন পানি সম্পদ মন্ত্রানালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কিমিটির চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক এবং অপরাপর সদস্যদের মধ্য রেয়েছেন পানি সম্পদ মন্ত্রানালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কিমটির অপর পাঁচ সদস্য। এর বাইরে রয়েছেন যারা...................
১।পানি সম্পদ মন্ত্রানালয়ের সচিব ওয়াহিদুজ্জামান।
২।যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেন।
৩।পররাষ্ট্র মন্ত্রানালয় দক্ষিণ এমিয়া বিষয়ক মহাপরিচালক মোঃ ইমরান।
৪। বুয়েট সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশনের বর্তমান ডীন ডঃ মনোয়ার হোসেন।( যিনি এই কমিটির একমাত্র পানি বিশেষ্ঞ)
দুই
বেশ কিছু দিন আগের কথা ।আমার এক আরকিওলজিস্ট বন্ধুর বাবা ছেলের দী্র্ঘ দিন বাড়ি না যাওয়ার কারণে আমাদের মেসে এসে হাজির। আমার বন্ধুবর তখন ওয়ারী-বটশ্বেরের মাটি খুড়ে প্রচীন বাঙলার ইতিহাস কে তুলে আনার চেষ্টায় নিমগ্ন। আমরা বন্ধুর বাবাটিকে বুঝাবার চেষ্টা করলাম যে, তাঁর ছেলে কত বড় আবিষ্কারের সাথে যুক্ত। কিন্তু ছেলের চিন্তায় উদ্বিগ্ন পিতা নিজ চোখে ছেলের কীর্তি দেখার জন্য যখন বায়না ধরে বসলেন, তখন তাকে বটেশ্বরের খনন স্থলে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকলো না।
অকুস্থলের ছেলে ও তার সঙ্গীদের কর্মযজ্ঞ দেখে বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন।ফিরবার পথে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন,' মাটি খুড়ে পুরাতন ভাঙ্গা ইট বেড় করাই যদি তাঁর ছেলের শখ হয় ;তবে বাড়ি থেকে এতো দূরে পড়ে থাকবার কি প্রয়োজন। তাদের গায়ের আশেপাশে এমন অনেক জায়গাই তো মাটি খুড়লে এমন পুরাতন ইট বেড়িযে আসে। এতোই যখন শখ বাড়িতে থেকে আশে পাশের ঢিবিগুলো খুড়াখুড়িবি না হয় করুক !'
তিন
রাষ্ট্রীয় অর্থ ও সময় ব্যয় করে ১০ সদস্যের এই সংসদীয় কমিটির টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের প্রস্তাবিত স্থল পরিদর্শণে যেয়ে, কি স্বচ্ছ ধারণা পাবেন আমার বোধগম্য নয়। প্রথম কথা বর্তমানে অকুস্থলে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি দর্শণ ছাড়া দেখবার কিছুই দেখার নাই। ডঃ আইনুন নিশাত স্পষ্টই বলেছেন, সংসদীয় বা বিশেষ্ঞ কমিটির প্রকল্প স্থান পরিদর্শণ অর্থহীন।
সে কথা না হয় বাদই দিলাম।
প্রশ্ন হচ্ছে এ ধরণের একটি জল বিদ্যুত প্রকল্পের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয়, নিম্ন অববাহিকায় ভবিষ্যত বিরূপ ভাব বিশ্লেষণ করতে কোন কোন টেকনিকর ইনফরমেশন সংগ্রহ জরুরী এবং এগুলো বিশ্লেষন করে কিভাবে ভবিষ্যত প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া মত নুন্যতম জ্ঞান এই ১০ সদস্যের কমিটির ৯ জনেরই নাই। আমার ডাইরেক্ট শিক্ষক বুয়েট সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশনের বর্তমান ডীন ডঃ মনোয়ার হোসেন।( যিনি কমিটির একমাত্র পানি বিশেষ্ঞ) কে আমি তাদের কাতারে দাড়া করলাম না; তবে তার প্রসঙ্গে লেখার উপসংহারে আসব।
আমি সুনিশ্চিত যে , আরকিওলজিস্ট ছেলের কর্মকান্ড নিয়ে স্বল্প শিক্ষিত পিতা যে রকম উপলব্দি হযেছে ; সেরকমই একটি দৃস্টি ভঙ্গি নিয়ে বারত সফর শেষে আমাদের সংসদীয় কমিটি ফিরে আসবেন।
চার
গত ১৮ জুলাই '০৯ বিএনপির পক্ষ হতে যে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হযেছে সে বিষয়ে গত কাল ১৯ জুলাই '০৯ জনাব আব্দুর রাজ্জাক সংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন। তাদের তিনি বলেন,
"বিএনপির পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রতিবেদনে যে তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হযেছে, তার কোন সুস্পষ্ট ভিত্তি নেই।ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা তথ্য উপাত্ত নিযে জনগণ কে টিপাইমুখ সম্পর্কে ধারনা দেওয়ার অপপ্রয়াস চালাছে।"
জনাব আব্দুর রাজ্জাকের ইন্টারনেট তথা 'তথ্য প্রযুক্তি'র উপর এতো বড় অনাস্থা বর্তমান সরকারের 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' শ্রোগান সম্পর্ক তাদের নিজেদের প্রকৃত উপলব্দ্ধি কে প্রশ্ন সম্মুখীন করে। তারা মনে হয় , 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' বলতে সরকারী দপ্তরের ' টাইপ রাইটার' হিসাবে কম্পিউটারের বিপুল ব্যবহার কেই শুধু বুঝেন। তথ্য প্রযুক্তির সুফল কে ব্যবহার করে বিশ্বজ্ঞান জগতে অবাধ বিচরণ এবং সেই জ্ঞানকে দেশ ও জাতীর কল্যাণে ব্যহার করার উপর বর্তমান সরকারের আস্থাহীনতাই জনাব আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে।
পাঁচ
আজ হতে ৪০০ শত বছর আগে সমুদ্র অভিযাত্রী Ferdinand Magellan নিজের জীবনে বিনিময়ে প্রমান করেছিলেন ' পৃথিবী একটি গোলাক'। আজ যদি প্রতিটি মানুষ পৃথিবীর গোলক আকৃতির বিষয়ে আস্থবান হওয়া আগে পৃথিবী চারপাশে পরিভ্রমণ করার সংকল্প করেন , তবে তা নিতান্ত্যই হাস্য কর।
বিগত একশত বছরের সারা বিশ্বে নদীর চলমার প্রবাহের বাঁধ নির্মাণ করে অসংখ্য জল বিদ্যুত প্রকল্প হয়েছে। এ সকল জল বিদ্যুত প্রকল্পে প্রকৃতির উপর বিবূপ প্রভাব সম্পর্কে অসংখ্য গবেষনা রিপোর্ট রযেছে। দক্ষিণ আমেরিকা সহ বিশ্বের নানা স্থলে ইতিমধ্যে পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর হাইড্রোইলেকট্রিক ড্যাম ভেঙ্গে ফেলার শুরু হযেছে।
যা হোক, টিপাইমুখ জল বিদ্যুত প্রকল্প সম্পর্ক আমাদের কাছে বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত নেই ;এ কথা সত্য। তবে একটি জলবিদ্যুত প্রকল্প পরিবেশের কি কি অপুরণীয় ক্ষতি করতে পারেই , সে বিষয়ে সঠিক দৃষ্টী ভঙ্গি গঠনে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অপ্রতুল নয়।
ছয়
প্রশ্ন হতে পারে ' টিপাইমুখ জল বিদ্যুত প্রকল্প' বিষয়ে আমাদের করণীয় কি?এর সমাধান কি? নিঃসন্দেহে সমাধানটি একমাত্র পথ.. রাজনৈতিক সমাধান।আমাদের সরকারকে ভারত সরকারের সাথে আলেচনায় বসে রাজনৈতিক সমাধানে আসতে হবে।
কিন্তু, যে কোন দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনার প্রাথিমক শর্ত হচ্ছে যে জাতীয় স্বার্থ কি ভাবে সুরক্ষিত হবে সে বিষয়ে নিজেদের সুস্পষ্ট অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তার পর আলোচনায় বসা।
টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থ কিসে রক্ষিত হবে, আমরা কি সে বিষযে নিশ্চিত? সরকার যদি ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়, তবে তাদের বক্তব্য জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে হবে।
সাত
কিন্তু সরকারে নিজস্ব কোন বিচার বিশ্রেষণ যে চলছে; সে উদ্যোগ চোখ পরছে না? পররাষ্ট্র মন্ত্রী কিছু দিন আগে বলেছেন, ভারত সরকারের পক্ষ হতে টিপাইমুখ বাঁধ সংক্রান্ত তথ্য তাদের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে। কি তথ্য দেওয়া হয়েছে জনগণ তা জানে না।সরকারে তরফ থেকে জনগণ কে জানানোর কোন ইচ্ছাও নেই।
তথ্য প্রাপ্তির বিষয়টা না শেষ পর্যন্ত না , 'নাপিতের ঝোলায় ৯৯ টি বাঘের মাথার মত হয়'।শেষে প্রাপ্ত তথ্যের ঝুলি খুলে হয়তো দেখা যাবে ওটা নিছক একটা 'আযনা', যাতে শুধু মাত্র ভারতীয় অগ্রাসি পুজির প্রতিবিম্ব ফুটে উঠে।'
আট
ভারত সরকার যে তথ্য উপাত্ত দিয়েছে এবং আমাদের বিভিন্ন বিশেষ্ঞের ও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট যে তথ্য আছে , তা নিয়ে গঠন করা হোক উচ্চ ক্ষমতার বিশেষ্ঞ কমিটি।
বিষয় টি শুধু নদী-পানি সংশ্লিষ্ঠ নয়। এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ, স্থল-জল বাস্তুসংস্থান, এতদ্ অঞ্চলের কৃষি-সেচ প্রনালী , মৃত্তিকার গঠন প্রনালী এবং সর্বোপরী সমাজ জীবন। তাই টিপাইমুখ প্রকল্পের প্রভাব বিশ্লেষণে পানি প্রযুক্তিবিদের ( পানি বিশেষ্ঞ শব্দ টি আরো ব্যাপক) উপর ভরসা কোন সঠিক চিত্র নিয়ে আসতে পারে না। তাই একটি সামগ্রিক টেকনিকাল কমিটি ( বিসয় ভিত্তিক একাধিক সাব-কমিটিও থাকতে পারে) গঠন করে জাতীয় দৃষ্টি ভঙ্গি গড়ে তোলা জরুরী। এবং তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার ভারত সরকারের সাথে ফলপ্রসু আলোচনায় য়েতে পারে ।
নয়
প্রস্তাবিত ১০ সদস্যের কমিটির এক মাত্র পানি বিশেষ্ঞ বুয়েট সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশনের বর্তমান ডীন ডঃ মনোয়ার হোসেন কে নিয়ে একটি কথা বলে শেষ করব। তিনি আমরা প্রত্যক্ষ শিক্সক, তার জ্হান সম্পর্কে আমার বিন্দু মাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু , টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক ২০০০ এর ১২ জুন ২০০৯ সম্পর্কে তার বক্তব্যে আমার নিকট অন্তত তার অবস্থান সুস্পষ্ট হযেছে।
"ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে বাংরাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চরের যে প্রভাব পড়েছে সিলেট অঞ্চলে টিপাইমুখ বাঁধের কারণে একই রকম ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে বলে যে আশঙ্কা
করা হচ্ছে তার সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত নই।"'
"য়েহেতু জলাধারে পানি সংরক্ষণ করা হবে তাই এর কিছু প্রভাব ভাটিতে পড়বে। তবে সেই প্রভাব টিপাইমুখ পানি বিদ্যুত প্রকল্পের সারপ্লাস বিদ্যুত বাংলাদেশ ব্যবহারের মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে।"
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০০৯ দুপুর ১:৩১