somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাকস্বাধীনতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

১৬ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অকাল প্রয়াত গল্পকার মুহম্মদ যুবায়েরের বাবা অধ্যাপক এবারক হােসেন বগুড়া সরকারি আযিযুল হক কলেজে আমাদের বাংলা পড়াতেন। একদিন ক্লাসে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, এই গানটি অথবা রবীন্দ্রনাথের আরও অনেক গান যদি সঠিক সুরে যথাযথ আবেগ ও অভিনিবেশের সাথে গাওয়া হয় তবে তা যে কােনো প্রার্থনার চেয়ে উত্তম। অতএব কেউ যদি গভীর মনোযোগের সাথে একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত শােনেন তাহলে তার পূণ্য লাভ প্রাথনার চেয়ে বেশি বৈ কম হবে না। বলা নিষ্প্রোয়জন, ক্লাসের এই আলোচনা নিয়ে কােথাও কােনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি এবং দীর্ঘকাল একই কলেজে শিক্ষকতা করে অবসর গ্রহণের পরে তিনি স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছেন।

আমাদের শৈশবের একজন নাস্তিককে আমি খুব ভালো করে জানি। ফুল ও পাতা নামে দুই শিশু পুত্র কন্যাকে রেখে স্ত্রীর মৃত্যু হলে তিনি ঘােরতর ঈশ্বর বিদ্বেষী হয়ে পড়েন। তবে তিনি যে নেহায়েত স্ত্রীর শােকে কাতর হয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেননি তার স্বপক্ষে তিনি প্রকাশ্যেই নানা তথ্য প্রমাণ ও যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, যুক্তিবাদী এই চমৎকার মানুষটি শিশু কিশোরদের খুব পছন্দের মানুষ হলেও তাকে এড়িয়ে চলার পরামর্শ ছিল পাড়ার মুরুব্বিদের। বড়দের অনেকেই তাঁর সাথে তর্কে বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছেন কিন্তু তাঁকে কেউ প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছেন অথবা গােপনে অস্ত্র শান দিয়েছেন- এমন কথা আমাদের জানা নেই।

ঊনিশ ষাট এবং সত্তুরের দশকে আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে যে সামাজিক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় সহনশীলতা ছিল তা বােঝার জন্যে উপরের উদাহরণ দুটিই যথেষ্ট। সে সময় একজন কলেজ শিক্ষক কিংবা একজন মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবীকে হত্যা করে কেউ ইসলামের প্রচার বা প্রসারের কথা ভাবেনি। নাস্তিকদের প্রচারণা সত্ত্বেও দেশে ইসলামপন্থী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, শহরে নগরে গ্রামে গঞ্জে বৃদ্ধি পেয়েছে মসজিদের সংখ্যা। দেশের সর্বত্রই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মক্তব ও মাদ্রাসা। তবে এ সব প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করে চূড়ান্ত বিচারে তালেবে ইলিমরা ‘ইসলাম’ অর্থাৎ ‘শান্তি’র জীবনাদর্শে কতটা উদ্বুদ্ধ হয়েছে বা হচ্ছে তা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সমাজে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা ও শিশুহত্যা নারী নির্যাতনের মতো বিষয়গুলোর ব্যাপকহারে বেড়ে যাবার কারণ অনুসন্ধান করাও অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- আমরা কি বিচার বিবেচনার দিক থেকে, মানবিক মূল্যবোধ ও পরধর্ম পরমত সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল কিংবা পাকিস্তানের সামরিক শাসনকাল থেকে পিছিয়ে পড়েছি?

রােকেয়া সাখাওয়াৎ হােসেন কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সমসাময়িক যুগের সাধারণ মানুষের চেয়ে তাে বটেই, সেই সময়ের আধুনিক ও প্রগতিশীল মানুষের চেয়ে প্রাগসর ছিলেন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। রােকেয়া তাঁর সময়ে নারী শিক্ষা ও নারীর বন্ধন মুক্তির ক্ষেত্রে কী বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা বিবেচনায় নিয়ে শুধুমাত্র তাঁর লেখনির মাধ্যমে মুক্তবুদ্ধির চর্চায় স্বাধীন চিন্তা চেতনা প্রকাশের ক্ষেত্রে অবদান রেখে গেছেন তা এই বিভ্রান্ত ধর্মীয় উন্মাদনার যুগে চিন্তা করাও অসম্ভব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ধর্মব্যবসায়ী সুবিধাভোগীদের মুখোশ উন্মোচনের পাশাপাশি কুসংস্কারাচ্ছন্ন কুপম-ুক ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের েধাঁয়াশাগ্রস্ত চিন্তা চেতনার মর্মমূলে যেভাবে কুড়াল মেরেছেন আমাদের এই বৃত্তাবদ্ধ অসহিষ্ণু সমাজে বসে সে কথা ভেবে শিউরে উঠতে হয়।

ভিন্ন মতাবলম্বী অথবা মুক্তবুদ্ধিও চর্চায় নিয়োজিত লেখক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীগণ তাদের কথায় ও কাজে, লেখায় ও মন্তব্যে সকল সময়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দেবেন তা নিশ্চয়ই নয়। তবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে, একটি গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায়, একটি আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক সমাজে মুক্তবুদ্ধির চর্চার মধ্য দিয়ে ভিন্নমত প্রকাশিত হবে না, এ কথা মেনে নেয়া যায় না। নানা বিরুদ্ধ মতামতের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই সত্য প্রকাশিত হবে এবং জাতি সঠিক দিক নির্দেশনা লাভ করবে। সমাজ প্রগতির ধারাকে প্রবহমান রাখতে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে একটি বুদ্ধিবৃত্তি ভিত্তিক সমাজগঠনে এর কােনো বিকল্প নেই।

সামাজিক যােগাযোগ মাধ্যম ও ব্লগে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত চিন্তা চেতনা প্রকাশের ‘অপরাধে’ সম্প্রতি আরও একজন মুক্তিবুদ্ধির মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডটিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা না করে অনেকেই জিকির তুলেছেন, লেখক তাঁর ব্লগে মত প্রকাশের স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছেন। নীলাদ্রি নিলয়ের লেখা কিংবা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত তাঁর মতামত না পড়েই ধর্ম সম্পর্কে তাঁর কথিত কটুক্তির বয়ান দিয়েছেন। যাঁরা এইসব মন্তব্য করেছেন তাঁরা কি জানেন, মসজিদে বােমা হামলা চালিয়ে ইসলামি জঙ্গীরা যে নিরিহ মানুষ হত্যা করেছে তার বিরুদ্ধে তিনি সােচ্চার ছিলেন? তাঁরা কি জানেন সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, নারী প্রগতি এবং সব ধরণের জঙ্গী তৎপরতার বিরদ্ধে নীলাদ্রি নীল ছিলেন একজন উচ্চকণ্ঠ মানুষ?

তারপরেও এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একজন পরমর্শদাতা যখন বলেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার মাধ্যমে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া যাবে না’ তখন বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। ‘কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া যাবে না’ বিষয়টি তিনি যেমন জানেন, তেমনটা দেশের অধিকাংশ মানুষই জানে। আর না জানলেও দেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার লােকেরা নিশ্চয়ই জানে। তাহলে এ ধরণের একজন ‘নাস্তিক ব্লগার’ যখন থানায় একটি সাধারণ ডাইরি করতে যান তখনই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়নি কেন? ‘অপরাধী’কে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হলে ধর্মান্ধ জঙ্গীরা নিজেরাই আইন ও বিচার হাতে তুলে নিয়ে এই জঘন্য ঘটনাটি ঘটাতে সচেষ্ট হতো না। তাহলে ধরে নেয়া যায়, দেশের প্রচলিত আইনে বিচারের সম্মুখিন হতে হয় এমন কােনো অপরাধ নীলাদ্রি নীল করেননি । স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এই নিরাপরাধ মানুষটি যখন জীবন নাশের হুমকি মাথায় নিয়ে এক থানা থেকে আরেক থানায় ছুটে বেড়াচ্ছেন তখন আইনের রক্ষাকর্তারা তাঁকে কী সহায়তা দিয়েছেন?

জনগণের অর্থে প্রতিপালিত পুলিশ একজন সাধারণ কর্মজীবী স্বামী, একজন মায়ের আদরের সন্তান, একজন প্রগতিশীল লেখকের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের কােনো চেষ্টা না করে, কােনো আশার বাণী না শুনিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাবার পরামর্শ দিয়েছে। এখন- আমরা যারা পত্র পত্রিকায় অল্প বিস্তর লেখালিখি করি, তারা সকলেই কি দেশান্তরী হবো?


সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:১০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×