পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলা এবং পার্শ্ববর্তী কক্সবাজার জেলা মিলে নতুন একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে অতি সন্তর্পণে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যে একটি দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র চলছে তা অনেকেই বিশ্বাস করলেও তার সাথে যে কক্সবাজারকেও সংযুক্ত করার সম্ভাবনা আছে তা কিন্তু অনেকেই চিন্তা করছে না। কোনো দেশের সমুদ্রসীমা না থাকলে তা হবে পরনির্ভরশীল রাষ্ট্র, যা হবে অতি দুর্বল। চীনকে সাইজ করার জন্য তার নিকটবর্তী দুর্বল রাষ্ট্র বাংলাদেশের গোলযোগপূর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো বেইজক্যাম্প স্খাপিত হলে তার সাথে গভীর সমুদ্রবন্দর থাকবে না বা সেখানে আমেরিকার নৌবহর ভিড়তে পারবে না এমনটা হতেই পারে না। এ জন্য দরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজার সমুদ্রসীমা। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে যেমন পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব লাগিয়ে একটি অস্খিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তেমনি কক্সবাজারে বাংলাদেশী ও আরকানি মুসলিমদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে অরাজক পরিস্খিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। আবার মাঝে মধ্যে ডুলাহাজারা খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতাল ও অন্যান্য পশ্চিমা এনজিও কর্তৃক ধর্মান্তরিত ও নিয়ন্ত্রিত খ্রিষ্টানদের সাথে মুসলিমদের ধর্মীয় বিরোধ সৃষ্টি করা হয়, যাতে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সংবাদ শিরোনাম করা যায়, যাতে পশ্চিমা বিশ্বের সহানুভূতি ও সমর্থন নিয়ে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি করার উছিলা তৈরি হয়। এর সাথে আরকানি সংখ্যালঘুদের সম্পৃক্ত করতে ও তাদের সমর্থন পেতে তাদের শরণার্থী ক্যাম্পে লালন-পালন করা হচ্ছে এবং অল্প কয়েক শ’ শরণার্থীকে পশ্চিমা দেশে শ্রমিক হিসেবে স্খায়ীভাবে নিয়ে গিয়ে এক দিকে আরকানিদের বোঝাতে চায় যে, দেখো আমরা তোমাদের প্রতি তোমাদের বাঙালি মুসলিম ভাইবোনদের চেয়ে কত বেশি আন্তরিক, অন্য দিকে এ সবের আকর্ষণে আরো বেশি আরকানি এ দেশে চলে এসে এ এলাকায় যেন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়। এমন এক সময় আসতে পারে যে দিন কক্সবাজারে মুসলিমদের থাকতে হবে আরকানি পরিচয় দিয়ে। আরকানকে স্বাধীন করে দেয়ার লোভ দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের সহজেই হাত করা যায়। এভাবে যেকোনো দেশে সংখ্যালঘুদের শক্তিশালীকরণের মাধ্যমেই কেবল মানচিত্র পৃথক করা সম্ভব হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করলে ভারত, মিয়ানমার, চীন ও পশ্চিমা বিশ্ব থাকবে উপজাতিদের পক্ষে। কক্সবাজারে আরকানিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হলে আরব বিশ্ব ও পশ্চিমা বিশ্ব থাকবে আরকানিদের পক্ষে। আরকানে মুসলিমদের সাথে মিয়ানমার সরকারের সমস্যা হলে বাংলাদেশ থাকবে আরকানিদের পক্ষে, চীন থাকবে মিয়ানমারের পক্ষে। সুতরাং সংখ্যালঘু উপজাতি ও রোহিঙ্গাদের যেকোনো অপতৎপরতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যবস্খা নিতে গেলেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ ও বিশ্ববাসী বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্খান নেবে। তখন তাদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র করার দাবি জোরালো হবে এবং জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। যেমন পৃথক রাষ্ট্র করা হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও এ আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়। এ এলাকায় একটি পৃথক খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হলে ভারত, মিয়ানমার ও চীন কিন্তু ঝুঁকির মধ্যে পড়তে বাধ্য হবে। কারণ মিয়ানমার থেকে আরকান ও ভারত থেকে পূর্বাংশ বিচ্ছিন্ন হওয়ার এবং চীন চাপের মুখে পড়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। তবে লাভ হবে পশ্চিমা বিশ্বের। তারা এ এলাকার বাজার ও খনিজসম্পদ কব্জা করতে পারবে।
পার্বত্য উপজাতিদের যেমনি একাধিক সশস্ত্র সংগঠন আছে তেমনি আরকানিদেরও একাধিক আছে। তবে উপজাতিদের কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ থেকে পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি করা অনেক সহজ হবে, আরকানিদের কাজে লাগিয়ে আরাকানকে স্বাধীন করার তুলনায়। কারণ বাংলাদেশ থেকে পৃথক করাটা ইন্দোনেশিয়া বা সুদান থেকে পৃথক করার চেয়ে কঠিন বিষয় নয়, কারণ তখন জন্ম হবে একটি খ্রিষ্টান দেশ। কিন্তু মিয়ানমার থেকে আরকানকে পৃথক করা ভারত থেকে কাশ্মীরকে পৃথক করার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন, কারণ তখন জন্ম হবে একটি মুসলিম দেশ। আরাকানিরা যদি মনে করে, পশ্চিমারা তাদের উপকার করবে, তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করে। আর আরব বিশ্ব অর্থ সাহায্য প্রদান ছাড়া তাদের জন্য আর কিছুই করতে পারবে না। তাদের যদি কেউ কার্যকর সাহায্য করতে পারে তবে তা পারবে কেবল বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের সাহায্য পেতে হলে বাংলাদেশের সেবা করতে হবে এবং সে সেবা হবে, তারা বিদেশ যাওয়ার আশায় কক্সবাজারে জড়ো হয়ে বসে না থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতি স্খাপন করা এবং সেখানে বাঙালি মুসলিম সংখ্যা বৃদ্ধি করা। কক্সবাজারে তাদের পরিচয় অপছন্দনীয় ‘আরকানি রোহিঙ্গা’ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের পরিচয় হবে ‘বাঙালি মুসলিম’। বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকা থেকে আরকানিদের নাগরিকত্ব ও বসতি বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের বসতি স্খাপনের সুযোগ দেয়া এবং সেখানেই তাদের নাগরিকত্ব প্রদানপূর্বক ভোটার করা। এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উভয় অংশেই বাংলাদেশ নিরাপদ থাকবে। প্রয়োজনে উপজাতি সশস্ত্র সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আরকানি সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা যেতে পারে, এতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিরাপদ থাকবে। তাই আরকানিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্খাপন ও ভোটার করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেই পালন করতে হবে। সেখানে জমি কেনা না গেলেও সরকারি খাস জমি বরাদ্দ দিতে বা সেখানকার বাঙালিদের নামে জমি কিনে রোহিঙ্গাদের ভোগদখল দিতে কোনো সমস্যা নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের সার্বিক সহায়তা দেয়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি করেও শান্তি না আসা, কক্সবাজারে আরকানিদের মানবিক সহায়তা প্রদান করা, ডুলাহাজারার মালুমঘাটে জনমানবহীন পর্বত ও সমুদ্রের সংযোগস্খলে খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতাল করা এবং দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা সহায়তার মাধ্যমে ধর্মান্তরিত করে সে এলাকায় খ্রিষ্টান বসতি স্খাপন করা ইত্যাদি একই সূত্রে গাঁথা। শান্তিচুক্তির জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার না দেয়ার কারণও কিন্তু একই, সে চুক্তিতে পৃথক রাষ্ট্র করার নিশ্চয়তা না থাকা। বাংলাদেশের জনগণ যতই পরস্পর বিপরীতমুখী থাক না কেন, অন্তত সবাই দেশের ঐক্য ও সংহতির ব্যাপারে একতাবদ্ধ। এ একতার প্রতীক হচ্ছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং এ দেশের আলেম সমাজ। কারণ এ দু’প্রকার লোকের জন্য ভারত বা মিয়ানমারে কোনো আশ্রয়স্খল নেই। তাই নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব লাগিয়ে এবং আলেম সমাজের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের অপবাদ দিয়ে উভয়কেই দুর্বল ও অকার্যকর করার অপচেষ্টা চলছে।
দেশের অখণ্ডতা নিশ্চিত করতে হলে এক দিকে সবার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, অন্য দিকে পশ্চিমাদের কথা শোনা যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, ইউরোপীয় কমিশন ইত্যাদি সংস্খা ও এনজিওর কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বìধ করতে হবে। তারা সাহায্য করতে চাইলে বাংলাদেশ সরকার বা সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই করতে পারে। তারা বাংলাদেশের যে সেনাবাহিনীকে বিশ্বের যেকোনো স্খানে শান্তি স্খাপনের জন্য বিশ্বাস করে নিয়োগ করতে পারে, তাদেরই নিজ দেশের শান্তি স্খাপনের জন্য বিশ্বাস করতে না পারাটাই হচ্ছে চক্রান্তের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। পশ্চিমাদের অবৈধ হস্তক্ষেপ বìধ করতে হলে তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকা চলবে না। আমাদের স্বনির্ভর হতে হবে। এ জন্য সর্বপ্রথম দুর্নীতিমুক্ত হওয়া চাই। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে যে দুর্নীতি হয়েছিল সে কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি শুরু। তাদের বাঙালি হয়ে যেতে বলে সে অশান্তিতে ঘৃতাহুতি দেয়া হয়।
শান্তিচুক্তি করে সে দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করা হয়। এখন সেখান থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে পৃথক রাষ্ট্র ঘোষণার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হচ্ছে মাত্র। তাই সময় থাকতেই হুঁশিয়ার না হলে পরে আফসোস করার জন্যও সময় পাওয়া যাবে না। তাই আসুন আজ থেকেই আমরা ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা শুরু করি এবং অন্তত এ ব্যাপারে যেন কোনো দলাদলি না করি।
লেখক: ফারহান সাদিক
সুত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত, মে ১৭, ২০১১