তখন সম্ভবতঃ দ্বিতীয় শ্রেণীতে যাওয়া আসা করতাম। ছোট ভাইটিও পড়াশোনা শুরু করেছে সবে। খেলাধুলা আর খেলনার আমাদের পিস্কিদের বাজারে নতুন এসেছে 'বাঁশের বন্দুক'! খুবই সহজলভ্য, আন্ডার ওয়ার্ল্ডে ধর্না দেয়ার কোনই প্রয়োজন হতো না। চানাবুট প্রবেশ করতে পারবে এমন সুড়ঙ্গবিশিষ্ট বাঁশের কঞ্চিকে পাইপের মত কেটে নিতে হতো আর আরেক খণ্ডকে ছেঁচে-ছিলে হাতের কাছে গিরাটা রেখে দিয়ে সেই সুড়ঙ্গে প্রবেশ করানো যায় মতো করে বানিয়ে নিতে হয়, ব্যস হয়ে গেল বৈকালী হিটলারী লড়াইয়ের সমরাস্ত্র- 'বাঁশের বন্দুক'।
বুলেট পাই কোথায়, খুব একটা ভাবতে হতো না, একদার বনাঞ্চল হিসেবে পরিচিত আমাদের গ্রামটিতে এখনো জন্মে অদ্ভুত সব গাছ-গাছালী, তার মধ্যে পাওয়া যেত অনেকটা লেবু কিংবা জাম্বুরা পাতার চেয়ে বড় পাতাবিশিষ্ট একধরনের ফুল গাছ, যার উচ্চতা এক থেকে দেড় মিটারের মত হতো, যার ফুলগুলো ছিল ঠিক চানাবুটের আকারের এবং সেরকমই শক্ত। আমরা ডাকতাম 'আঙিলা গাছ' আর ফুলকে 'আঙিলা ফুল', আর সেই আঙিলা ফুলই ছিল আমাদের বাঁশের বন্দুকের বুলেট; অবশ্য ক'দিন আগেও এই বুলেট দিয়েই চমৎকার মালা বানিয়ে গলায় পরতাম আর পরাতাম রাজা-রানী খেলায়। কিন্তু আধুনিকতা যেন সেই ভালবাসার মালার দানাগুলোকেই করে দিল আমাদের জন্য হন্তারকের প্রতীক 'বুলেট' আর বাঁধিয়ে দিল ট্রয়ের লড়াই।
সেদিন ছিল শুক্রবার, দুপুরের ঘুম আজকের জন্য মাফ, আম্মু গোসল করিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে কপালে ইয়াবড় একটা ফোটাও লাগিয়ে খাইয়ে দাইয়ে দিলেন। বায়না ধরলাম আঙিলা ফুল আনতে যাব, গ্রামের সবচেয়ে বড় আর ঐতিহ্যের নিদর্শনে ভরা ছিল মজুমদারদের বাড়ী, সেখানেই সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায়। বিকেলে তখনো পুরোপুরি আসেনি, দুপুরও চলে যায়নি, এসময়টা গ্রামের জন্য নিঝুম রাতের মতই জনশূন্য। দু'ভাই হৈ রৈ করে ঢুকে পড়লাম বনের একটা অংশে, তুলতে লাগলাম হালকা-গাঢ় মিলিয়ে গোলাপী রঙের আঙিলা ফুলগুলো। কিছুক্ষণ পর, হঠাৎ মনে হলো সুপারি গাছের মাথায় কিছু শব্দ হলো, যেই না তাকালাম উপরের দিকে দেখি একি! ইয়া বড় একখণ্ড পুরোনো ইটের টুকরো নেমে আসছে ঠিক আমার বরাবর, গলা শুকিয়ে কাঠ, কি আর করা নড়ার সময়টুকুও পেলাম না। পড়লো তো পড়লো এক্কেবারে ঘাড়ের উপর। ভাবলাম, কেউ যদি ছুঁড়ে মারতো তাহলে টুকরোটি আসতো কোন পাশ থেকে, একেবারে গাছ থেকে পাকা সুপারির মত ঝরে পড়তো না; ভুতের ভয়টাই তখন গায়ে কাঁটা দিতে শুরু করলো। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠতেই ছোটভাই সহ আর দেরী নয়, দিলাম ছুট্, এক ছুটে মায়ের অাঁচলে।
তখন থেকে এখনো ভাবি, যদি ইটের টুকরোটি মাথায় পড়তো, তাহলে সেই কচিকালের মাথাটিকে হয়তো আজকের মত করে পেতাম না, কি জানি অসহনীয় আঘাত হলে মাথাটিকে প্রিয়জনেরা হয়তো মাটি চাপাও দিতেন।
ছবির জন্য [link|http://www.wozoproductions.org/images/bambo.jpg|K
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



