যে বিষয়টি নিয়ে লিখছি এ বিষয়টি নিয়ে এর আগেও লিখতে চেয়েছি কিন্তু দুটো বিষয় আমাকে বাধা দিয়েছে। তার একটি হলো সময় আরেকটি হলো ভয়। সময় হয়ে উঠেনি বলে লিখতে বসতে পারিনি। তার চেয়েও বড় সত্য হলো ভয়। এই বাংলাদেশে আইন বিভাগ বিচার বিভাগ নিয়ে লিগ্যাল কথা বললেও নাকি মামলা গ্রেফতারের ভয় থাকে। তবে এই অবিচার আর কত মেনে নেয়া যায়? তাই আজ মনস্থির করলাম লিখেই ফেলবো। আমার মত চুনোপুটি এই বিষয়টি লিখলে উপর মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ কোনদিন হবে না সে আমি জানি। তাই সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীরা যদি মানবিক দিক বিবেচনা করে বিষয়টি নিয়ে একটু লেখালেখি করতেন তবে বিচার বিভাগের প্রায় পনের হাজার কর্মচারীর উপকার হতো। তাই কথাগুলো বিস্তারিত লিখছি, এখন পড়ার সময় না থাকলে পরে পড়ে নিলেও হবে।
প্রথমেই আমি বিচার বিভাগের নেতিবাচক দিকটি তুলে ধরি। কেউ যদি প্রশ্ন করে বাংলাদেশের কোন দুইটি জায়গায় ঘুষের আদান প্রদান সবচেয়ে বেশি হয় তবে থানার পরেই যে নামটি চলে আসবে তা হলো আদালত। কথাটা সত্য না হলেও একটা রিউমার আছে, আদালতের ঘাসগুলোও নাকি ঘুষ খায়। যদিও আদালত অঙ্গনেও অনেক সৎ মানুষকে দেখেছি। এই নেতিবাচক দিকটি বাদ দিলে আদালত সম্পর্কে আরো অনেক ইতিবাচক আর বঞ্চনার কথা থেকে যায়। এরপর যদি প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশের কোন দুইটি অফিসে সবচেয়ে বেশি কাজ করা হয় অর্থাৎ ফাকি দেয়ার জায়গা নেই, তবে ব্যাংকের পরেই যে নামটি চলে আসবে তা হলো আদালত। আদালতের কর্মকর্তাদের কথা বাদ দিলে কর্মচারীদের কেউ বিকেল পাচটার আগে বাড়িতে যেতে পারে না। তাছাড়া সেরেস্তাদার, পেশকার (বেঞ্চ সহকারী), নাজির, স্টোনোগ্রাফাররা তো রাত ৮ টার আগে কোনদিন বাসায় যেতে পারে না। এই যে এত এত কাজ এটুকু সান্ত্বনা হয়তো মেনে নেয়া যেতো যদি তাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মানে জজ সাহেবগণ তাদের মানুষ বলে মনে করতো। বাংলাদেশের জজ সাহেবরা তাদের নিজেদের দেবতা বলে মনে করেন আর কর্মচারীদের ক্রীতদাস মনে করেন। হাতে গোনা দু একজন জজ বাদ দিলে সবাই নিম্নস্থ কর্মচারীদের সাথে এমন ব্যবহার করেন যেন তারা ক্রীতদাস। রাত পর্যন্ত কাজ করার পরেও কোন প্রকার ধন্যবাদ পাওয়া তো দূরে থাক সব সময় ধমকের উপর রাখা হয়। আমার এক আত্মীয় পেশকারকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখেছি কোনদিন রাত ৮টার আগে বাসায় ফিরতে পারে না। তাছাড়া প্রায়ই শুক্রবারেও অফিসে গিয়ে কাজ করতে হয়। হ্যা, এটা সত্য যে তার ইনকাম অনেক, সে আমাদের শহরে একটি তিনতলা বাড়ির মালিক। কিন্তু সে জীবনে তার পরিবারকে সময় দিতে পারেনি কোনদিন। সৃষ্টি হয়নি সন্তানদের সাথে সুসম্পর্ক। তার কাছ থেকেই শুনেছি এত পরিশ্রম করার পরেও ছোটখাট ভুলের জন্য জজ সাহেবদের কাছ থেকে কতটা নিগৃহের শিকার হয়েছেন। একবার নিজের ভাইয়ের জন্য একটা ছোট তদবীর করলেও জজ সাহেব তা শোনেননি, বরং জামিনযোগ্য ধারা হবার পরেও জামিন না মঞ্জুর করেছেন। আমি মনে মনে ভাবলাম এটা তো জজ সাহেব ভালই করেছেন, তদবীর না শুনে নিজের নীতির উপর অটুট থেকে আইনানুযায়ী কাজ করেছেন। কিন্তু পেশকার সাহেব আরো জানালেন তার তদবীর না শুনলেও ঐ বিচারক একজন রাজনৈতিক নেতার তদবীর ঠিকই শুনেছেন এবং মাঝে মাঝেই পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) তাকে বিভিন্ন মামলার জন্য তদবীর করেন। আরেক কর্মচারী একদিন বললেন কোন এক কাজের পর জজ সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে আসার সময় জজ সাহেব তাকে পুনরায় রুমে ডেকে নিয়ে বললেন, “জজ সাহেবরা হলো অনেক উপরের স্তরের মানুষ। তাদের ধন্যবাদ দিতে হয় না। আর কখনো আমাকে ধন্যবাদ দিবেন না।” লোকটি তো বেআক্কেল হয়ে গেলেন। ধন্যবাদ দিবো না তাহলে কি দেবো, অবশ্য এমন প্রশ্ন করার সাহস পাননি।
জজ সাহেবরা যে নিম্নস্থ কর্মচারীদের মানুষ মনে করেন না তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে তারা বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন করেছেন, সেই সংগঠনে কোন কর্মচারী সদস্যভুক্ত হতে পারেন না। সেটা শুধুমাত্র জজ সাহেবদের গঠিত সংগঠন। আমি কর্মচারীদের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছি। তারা এতে তেমন মনক্ষুন্ন নন। তবে মনক্ষুন্ন অন্য কারণে- এই সংগঠনের দ্বারা সরকার থেকে যেসব সুযোগ সুবিধা আদায় করা হয় তা শুধু জজ সাহেবরা ভোগ করেন। আর তাদের অধীনস্তরা আজীবন থাকেন সুযোগ বঞ্চিতদের্ কাতারে। এই কিছুদিন আগে জজ সাহেবরা তাদের বেতনের সাথে ৩০% বিচারিক ভাতা দাবী করলেন এবং সরকার সে দাবী মেনে নিয়ে এখন তাদের বেতনের সাথে এক্সট্রা ৩০% বিচারিক ভাতা প্রদান করেন। আরেকটা সুবিধা আছে জজ সাহেবদের জন্য। জজকোর্টের বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য বছরে একমাস (ডিসেম্বর মাস) অবকাশ রয়েছে। যে সকল জজ সাহেব এই অবকাশকালীন ছুটি ভোগ না করে বিচারকাজ করবেন তাদের জন্য ডিসেম্বর মাসের বেতনের সাথে আরো একটি বোনাস বেতন দেয়া হয়। আমার এক শিক্ষক বন্ধু আমাকে বললেন, “আমার মাথায় ধরে না কেন তারা বিচারিক ভাতা পাবেন। তাদের তো চাকুরীই দেয়া হয়েছে বিচার করার জন্য এবং বিচার করার জন্যই তাদের মাসে মাসে বেতন দেয়া হয়। তাহলে আবার বিচারিক ভাতা কি? তারা যদি বিচারের বাইরে আরো কিছু কাজ করতেন তাহলে সেটার জন্য তারা একটা ভাতা পেতে পারতেন।” এবার আরেকটি তথ্য দেই। এই সুবিধাগুলো শুধুমাত্র জজ সাহেবরা পেয়ে থাকেন। তাদের অধীনস্ত কোন কর্মচারী এই বিচারিক ভাতা পান না। হাস্যকরভাবে সরকার সেই ভাতা দিয়ে যাচ্ছেন। ধরে নিলাম এই ভাতা পাওয়া তাদের যৌক্তিক অধিকার। এখানেই কথা থেকে যায়। যারা বিচারকার্য সম্পর্কে জানেন তারা আমার সাথে একমত হবেন যে, একটি বিচার শুধু জজ সাহেব একাই সম্পাদন করতে পারেন না। আমার দেখামতে একটি বিচারকার্যের প্রায় আশিভাগ কাজ করেন পেশকার, সেরেস্তাদার, নাজির, স্টেনোগ্রাফার সহ অনেকেই এমনকি এম.এল.এস.এস এরও একটা ন্যুনতম অবদান থাকে। একজন এম.এল.এস.এস জজ সাহেবের বাসার বাজার করা থেকে শুরু করে তার কাজের বোয়ার কাজ পর্যন্ত করে দেন এবং তার ডিউটীর কোন রাত-দিন নেই, যখন জজ সাহেব ডাকেন তখনই বাসা থেকে ছুটে আসতে হয়। একজন পেশকার কোন মামলার তারিখ কবে, কোন মামলার সাক্ষীগ্রহণ কখন, কি কি সাক্ষী হলো, মামলার পরবর্তী তারিখ কবে, কোন মামলা তদন্তে গেল না গেল, তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ এবং সবকিছু ঠিকঠাক আপটুডেট সহ এজলাসে জজ সাহেবের সামনে উপস্থাপন করেন ও নথি সংরক্ষণ করেন। এ কাজগুলো আপটুডেট রাখতে পেশকারদের রাত হয়ে যায়। একজন স্টেনোগ্রাফার জজ সাহেবের ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী মামলার নথির এ টু জেড সবকিছু কম্পিউটার টাইপ ও সংরক্ষন করেন। মামলার সাক্ষীর জবানবন্দী থেকে শুরু করে এমন কোন বিষয় নেই যা স্টেনোগ্রাফারের টাইপ করতে না হয়। অনেক সময় জজ সাহেব শুধু বলে দেন যে অমুক মামলায় আসামীর জামিন মঞ্জুর করা হলো বা নামঞ্জুর করা হলো। কি কারণে করা হলো বা হলোনা তা আর ব্যাখ্যা করে বলেন না, শুধু দুএকটি কারণ বলে দিয়ে বাকিটুকু নথি ঘেটে বের করতে বলে বাসায় চলে যান। তারপর স্টেনোগ্রাফার মামলার চার্জশীট, এফআইআর, তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষ্য গ্রহণ, এভিডেন্স ইত্যাদি ঘেটে ঘেটে যৌক্তিক কারণগুলো উদঘাটন করে জামিনের অর্ডার লিপিবদ্ধ করেন যে অমুক কারণবশত: আসামীর জামিন মঞ্জুর/নামঞ্জুর করা হলো। একজন নাজির অফিসের কোন স্টাফের কোন সমস্যা, কার ডিউটী কোথায় দিতে হবে, আদালতের সমন দিয়ে কোথায় কাকে পাঠাতে হবে এসব তো দেখতেই হয়, উপরন্তু কোন্ জজ সাহেবের কি প্রয়োজন কলম পেন্সিল থেকে শুরু করে হারপিক পর্যন্ত নাজিরকে টেক কেয়ার করতে হয়। এমনিভাবে ডেসপাস, এ্যাকাউন্টেন্ট, ক্যাশিয়ার, কম্পিউটার অপারেটর, স্টোর কীপার সবাইকেই কোনপ্রকার সরকারী ফাকিঝুকি ছাড়া কাজ পরিচালনা করতে হয় আর এভাবেই একটি বিচারকাজ সম্পন্ন সম্ভব হয়। অথচ যারা সকাল থেকে জজ সাহেবদের সাথে সার্বিক সহযোগিতা করে বিচারকার্যের ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করে দেন তারা বিচারিক ভাতার ১ শতাংশও পান না। শুধু রায় দিয়ে বিচারক সাহেব পেয়ে যাচ্ছেন ৩০ শতাংশ এক্সট্রা টাকা। অবকাশকালীন ডিউটীর জন্য বোনাস পান জজ সাহেবরা, একই সাথে অবকাশকালীন ডিউটীতে শামিল হয়েও কর্মচারীরা কিছুই পান না। এখানেই বঞ্চিতদের হতাশার নি:শ্বাস। বিচারকগণ বিকেল ৫টা বাজতেই বাসায় গিয়ে পরিবারকে সময় দিতে পারছেন, যাবার আগে কর্মচারীদের ঘাড়ে কাজ জমিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। আজকে যদি ১২টি মামলার রায় থাকে তাহলে সেই সবগুলো মামলার সব কার্যক্রম শেষ করেই কর্মচারীরা বাসায় যেতে পারে, নাহলে পরের দিনের কাজের চাপে আগের দিনের জমে থাকা কাজগুলো করা সম্ভব হবে না। তাই কর্মচারীদের বাসায় ফিরতে হয় রাত করে। আমার বাসার একপাশে একজন সেনিটেশন ইন্সপেক্টর অফিসের দিকে পা বাড়ান সকাল সাড়ে ৯টার পর আর অপরপাশের প্রতিবেশী জজ কোর্টের সেই পেশকার অফিসের দিকে বেরিয়ে যান সকাল ৮টার সময়। তাহলে বিচারিক কাজের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থেকে এবং অন্যান্যদের চাইতে বেশি ডিউটী করে কেন তারা বিচারিক সকল ভাতা থেকে বঞ্চিত হবেন? যখন পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কোন সুযোগ সুবিধা যেমন- বেতনবৃদ্ধি, ঝুকিভাতা প্রদান, রেশন প্রদান ইত্যাদি ঘোষণা করা হয় তখন আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টবল পর্যন্ত সবাই সেই সুবিধাভোগী হন। যখন আর্মি ডিপার্টমেন্টে কোন সুযোগ প্রদান করা হয় তখন সেনাপ্রধান থেকে যার যার পজিশন অনুযায়ী সৈনিক পর্যন্ত সবাই সে সুবিধা পান। কিন্তু এই বিচার বিভাগেই চরম একটি বৈষম্য, এখানে কোন সুবিধা ঘোষণা হলে তা শুধু জজ সাহেবগণ পেয়ে থাকেন। নিম্নপদস্থ কোন কর্মচারীর ভাগ্যে জোটে না সেই সুবিধা। বিচার বিভাগেই কেন এত বড় অবিচার?
একজন কর্মচারী কত বেতন পান? ৫২০০ টাকা মূল বেতনে কোন কর্মচারীর মাসিক বেতন দাড়ায় মাত্র ৮৫০০ টাকা। এ দিয়ে কি ৩০টাকা কেজি চাল কিনে পড়ুয়া সন্তানসহ ৫ সদস্যের একটি পরিবার এই শহরে চালানো সম্ভব? ব্যাংকে যারা চাকুরী করেন তাদের পরিশ্রমের জন্য মূল্য রয়েছে, রয়েছে স্বতন্ত্র্য বেতন স্কেল, বছরে এক্সট্রা বোনাস, লাঞ্চ প্রতিদিন ১৫০ টাকা ইত্যাদি। কিন্তু বিচার বিভাগের এই হাজারো কর্মচারীর তেমন কোন সুবিধা নেই। এ কারণেই কি তারা আরো বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে? এই মানবিক বিষয়টি নিয়ে কারো ভাবার অবকাশ নেই। প্রান্তিক শ্রেণী বলে তাদের দিকে দৃষ্টি দেয় না সরকারও। আন্দোলন করতে গেলে চাকুরী চলে যাবে এই ভয়ে অল্প আয়ের মানুষগুলো আন্দোলন করতেও ভয় পায়। তাই সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মী ভাই/বোনদের কাছে অনুরোধ, যদি মনে করেন বিষয়টি মানবিক বিবেচনার দাবী রাখে তাহলে একটু এদের জন্য কলম ধরুন। আপনাদের কলমে যদি উপরওয়ালাদের সম্বিত ফিরে তবে প্রায় পনের হাজার পরিবারের রিযিক বৃদ্ধি পাবে। আমি বিচার বিভাগের কেউ না হয়েও নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে লিখে দিলাম। জানিনা এর জন্য আবার আইনগত জটিলতায় পড়তে হয় কিনা। আপনাদেরকেও অনুরোধ রইল। #
আমার লেখাটি যে কেউ কপি পেস্ট করে যে কোন ব্লগে প্রকাশ করতে পারেন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




