somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মীনা কার্টুন বনাম ফেয়ারনেস ক্রিম এবং তার জাতিগত ও সামাজিক প্রভাব!

০২ রা নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আপাতত দৃষ্টিতে অনেকেই ভাবছেন মীনা কার্টুন ও ফেয়ারনেস ক্রিম কিভাবে একই বাক্যে জায়গা করে নিলো, দুটো বিষয় তো যোজন যোজন পার্থক্য। আসলে আজকে আলোচনা করবো নব্বই দশকে শুরু হওয়া জনপ্রিয় কার্টুন মীনা ও টেলিভিশনে দীর্ঘদিন ধরে ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হওয়ার সামাজিক প্রভাব নিয়ে।



মীনা কার্টুনঃ

আশির/নব্বই দশকে জন্ম নেয়া শিশুকিশোরদের শৈশবের আনন্দময় স্মৃতির অন্যতম একটি অংশ ছিল বিটিভিতে প্রচারিত হওয়া ধারাবাহিক কার্টুন মীনা। কিন্তু এই কার্টুনটি শুধু আনন্দ লাভেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। মেয়েদের সামাজিক অবস্থান উন্নয়নে এই শিশুতোষ কার্টুনটি বৈপ্লবিক অবদান রেখেছিল। বদলে দিয়েছিল সমাজে মেয়েদের প্রতি গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি।

আমাদের সমাজে মেয়েদের ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ছিলঃ মেয়ে শিশুদের শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহতা, মেয়েদের প্রয়োজনীয়তা শুধু ঘর সংসার-বাচ্চা-সামলানোতে, মেয়ে শিশুদের চেয়ে ছেলে শিশুদের মূল্যায়ন দেয়া, অল্প বয়সে বিবাহ দেয়া, অল্প বয়সে সন্তান জন্মদান ইত্যাদি বিষয়গুলো। অনেকের কাছে এই বিষয়গুলো বর্তমানে কোন ফিকশনাল গল্প মনে হলেও একটা সময় এগুলোই ছিল চরম বাস্তবতা ও স্বাভাবিক রীতিনীতি। তখন মেয়েদের জন্য কেবল পড়াশুনা করায় ছিল সবচেয়ে বড় চেলেঞ্জ, অন্যান্য অধিকার গুলো তো সেখানে বিলাসিতা। গ্রামে বড় হওয়ার সুবাদে ছোটবেলায় খুব কাছ থেকে এই বিষয়গুলো দেখেছি। যা মীনা কার্টুনের সূচনা সংগীতের কথা গুলো পড়লেই ধারনা পাওয়া যাবেঃ

আমি বাবা-মায়ের শত আদরের মেয়ে
আমি বড় হই সকলের ভালোবাসা নিয়ে
আমার দু চোখে অনেক স্বপ্ন থাকে
আমি পড়ালেখা শিখতে চাই
যদি চার দেয়ালের মাঝে কাটে সারা জীবন
তাহলে থাকবো শুধু বোঝা হয়ে
শিক্ষা আমায় মুক্তি দেবে, মুক্তি দেবে
আমিই তো কালকের খুশি আর আশা
আমারোতো সাধ আছে, আছে অভিলাষা
ঘরে বেঁধে রেখো না, নিয়ে যাও এগিয়ে।




মীনা কার্টুন জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে এর যুগান্তকারী প্রভাব পরেছিল গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারে, এমনকি শহরেও। মীনা চরিত্রটি প্রতিটি পরিবারের সদস্যের মনে মেয়ে শিশুদের প্রতি সহানুভূতি জাগিয়েছিল, নতুনভাবে মেয়ে শিশুদের মূল্যায়ন করা শুরু হয়েছিল। যদি ভুল না বলে থাকি, বঙ্গদেশে মেয়েদের সমধিকার ও নারীবাদী প্রচলনে গোঁড়ার দিকে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রভাবের পর সবচেয়ে কার্জকরি প্রভাব রেখেছিল এই সামান্য একটি কার্টুন। মেয়েদের অধিকার আদায়ে ও সচেতনেতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি রেভুলেশন এসেছিল বলা যায়। বাংলাদেশের প্রতিটি নারী-পুরুষ, বিশেষ করে নারীরা ইউনিসেফ, বিটিভি ও এই প্রজেক্টের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তির কাছে চির ঋণী থাকবে।

ফেয়ারনেস ক্রিমঃ
ক্যান্টনমেন্ট কলেজে অধ্যয়ন কালীন একবার আমাদের বাংলা সাবজেক্টের কাকলী ম্যাম খুব ইন্টারেস্টিং একটি প্রশ্ন করেছিলেন ক্লাসে।
আচ্ছা, মানুষ কালো পোশাক পছন্দ করে, কালো কলম পছন্দ করে, কালো ব্যাগ পছন্দ করে। কিন্তু কালো মানুষের ক্ষেত্রে বঙ্গদেশে এত অনিহা কেন?

আমি দাঁড়িয়ে জবাব দিয়েছিলাম, "ম্যম, সাদা চামড়ার মানুষরা অথাৎ ব্রিটিশরা আমাদেরকে ২০০ বছর শাসন-শোষণ করে গিয়েছে। সুতরাং প্রথম থেকেই সাদা চামড়ার মানুষরা আমাদের চেয়ে এলিট বা উঁচু ও ওরা প্রভু গোছের টাইপ একটি মাইন্ডসেট তৈরি হয়েছে। তাই সাদা চামড়া নিয়ে আমাদের এত ফেসিনেশন"। তো ম্যাম আমার সাথে একমত পোষণ করে বললেন যে সমস্যাটা আসলে বেশ পুরনো, তবে বর্তমানে যে বিষয়টিকে তিনি জোরালো দায়ী করেছিলেন তা হচ্ছে ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন।

একদিকে যখন মীনা কার্টুনের মত অনুষ্ঠান গুলো মেয়েদের অধিকার আদায়ে সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির লড়াই করছিল, অন্যদিকে এই ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন গুলো পুরো জেনারেশনের ব্রেইন ওয়াশ করে রেখেছে, যা বর্তমানেও চলছে।
বিজ্ঞাপন গুলোর ফোকাস পয়েন্ট গুলো হল, ফর্সা হলে সহজে চাকরী পাওয়া যাবে, ফর্সা হলে বন্ধুদের সাথে কনফিডেন্স রেখে কথা বলা যায়, পাত্র পক্ষ মেয়ে ফর্সা হলেই রাজী হয়ে যাবে, পছন্দের মানুষ দীর্ঘদিন নোটিস করছেনা কিন্তু ক্রিম মেখে ফর্সা হয়ে যাওয়ার নোটিস করা শুরু করেছে ইত্যাদি। এক কথায় সৌন্দর্য ও সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে ফর্সা বা সাদা হওয়াটা মাপকাঠি হিসেবে ধরা হচ্ছে। ইন্টারেস্টিং কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এ দেশের অধিকাংশ মানুষই "সুন্দর" ও "ফর্সা" এর পার্থক্য জানেনা, তারা ভাবে দুটোই সমার্থক শব্দ। অথচ অর্থগতভাবে দুটো শব্দ ভিন্ন।



মূল সমস্যাটা আসলে গোড়ায় বা একদিনের তৈরি নয়। বিস্তারিত আলোচনা করছি। আমাদের পূর্বের জেনারেশনের মধ্যে ইতিমধ্যেই ব্রিটিশদের কল্যাণে যুগ যুগ ধরে সাদা চামড়ার ফেসিনেশন কাজ করে আসছে। পাশাপাশি ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনের জঘন্য প্রভাব যুক্ত হয়েছে বয়স্কদের মাইন্ডসেটে। যার দরুন বিজ্ঞাপন থেকে প্রভাবিত হয়ে মা-বাবারা কালো বর্ণের সন্তান জন্ম নিলে চিন্তায় পরে যেত, আর মেয়ে হলে তো চিন্তা দ্বিগুণ। এভাবেই ভাবনা গুলো পরিবার থেকে পরিবার, সমাজ থেকে আরেক সমাজে ছড়িয়ে গিয়েছে।
মাইন্ডসেট প্রভাবিত হবেই বা না কেন? সেই শুরু থেকে শোবিজ জগতের নজর কারা আকর্ষণীয় ও আবেদনময়ী সেলিব্রেটিদের মডেল হিসেবে রেখে এমন মুখরোচক, অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা বিজ্ঞাপনে অশিক্ষিত কিংবা অর্ধ শিক্ষিতদের দেশে প্রভাব রাখাটা স্বাভাবিক। তাছাড়া বিনোদন জগতের সেলিব্রেটিদের আইডল হিসেবে মানা হয়, যার সুযোগ নিয়ে নামীদামী তারকারা নিলজ্জের মত এমন মিসলিডিং পণ্যের বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ করছেন। যার প্রভাব আমাদের জেনারেশনেও পরেছে।

কালো চামড়ার হলে সেই ছোটবেলা থেকেই সমাজে আশেপাশের মানুষদের ভাবনা, বিজ্ঞাপন দেখে নিজেকে অসুন্দর ভাবা, হীনমন্যতায় ভুগা, মানসিক চাপ, সমাজে নানাবিদ ঠাট্টা বিদ্রূপের সম্মুখীন হওয়া ইত্যাদি ব্যপার গুলো ঘটছে। আমাদের সমাজে রেসিজম বা বর্ণ বৈষম্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে এই ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন গুলোর সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে, বর্তমানেও রাখছে। অথচ বিজ্ঞাপন গুলোর ফোকাস পয়েন্ট হতে পারতো ত্বকের যত্ন বিষয়ক। তবে এমন বর্ণ বৈষম্য মূলক বিজ্ঞাপন গুলোর প্রচার বন্ধ হলে অন্ততপক্ষে আমাদের পরের জেনারেশন গুলো বেচে যেত। বর্তমানে শুধু একটায় ইচ্ছে, মরার আগে যেন এসব বর্ণ বৈষম্য মূলক ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে একটা বড়সড় মুভমেন্ট দেখে যেতে পারি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ১১:২৯
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×