somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিক্ষা ও জ্ঞান

২৬ শে মে, ২০১৪ রাত ৯:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমরা ভুল করে প্রায়ই সমার্থে ব্যবহার করে ফেলি, আসলে শিক্ষা ও জ্ঞান এক জিনিস নয়। ‘খাবার’ ও ‘খাওয়া’য় যে-তফাত, ‘গন্তব্য’ ও ‘মাধ্যম’-এ যেমন ফারাক – ঠিক সেই পার্থক্য ‘জ্ঞান’ ও ‘শিক্ষা’য়। শিক্ষা মানে শিখন বা শেখা। শেখা একটা প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় যা শেখা হয়, সেটাই জ্ঞান। শিশু পানিতে নেমে হাত-পা ছুড়ে যতক্ষণ ভেসে থাকার কৌশল রপ্ত করতে চেষ্টা করে – ততক্ষণ সে শিক্ষার্থী, ততক্ষণ সে থাকে শিক্ষার মধ্যে। কৌশলটা যখন সে আয়ত্ত করে নেয় – তখনই অর্জিত হয় জ্ঞান, তখন সে জ্ঞানী। গাড়ি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয় – এখানে গাড়ি মাধ্যম আর বাড়ি গন্তব্য। একইভাবে শিক্ষা আপনাকে জ্ঞানে পৌঁছে দেয় – তাই জ্ঞান হলো লক্ষ্য আর শিক্ষা জ্ঞানলাভের স্রেফ প্রক্রিয়া বা উপায়।

শিক্ষার লক্ষ্য শিক্ষা নয়, জ্ঞানের লক্ষ্য শিক্ষা নয়, জীবনের লক্ষ্যও শিক্ষা নয় – প্রতিষ্ঠান ছাড়া, শিক্ষা আর কোনোকিছুরই লক্ষ্য নয়। শিক্ষা নিছকই প্রক্রিয়া। জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার লক্ষ্য জ্ঞান। জ্ঞানের লক্ষ্য জীবন – সুন্দর জীবন। আর জীবনের লক্ষ্য অনেক। কাজেই সেই শিক্ষা ব্যর্থ শিক্ষা যার লক্ষ্য জ্ঞান নয়, অথবা যা জ্ঞানার্জনে সমর্থ নয়। জ্ঞান অর্জিত হচ্ছে কি না, কিংবা তা কতখানি হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তরই শিক্ষার সাফল্য-ব্যর্থতার একমাত্র মাপকাঠি। কিন্তু জ্ঞানের বিচার শিক্ষা দিয়ে হয় না। কেননা শিক্ষা জ্ঞানলাভের একমাত্র পথ নয়। তাই জ্ঞানের লক্ষ্য ছাড়া শিক্ষা ব্যর্থ হলেও শিক্ষার সাহায্য ছাড়া অর্জিত জ্ঞান ব্যর্থ নয়।

প্রতিষ্ঠান শিক্ষার আশ্রয় এবং শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনে সহায়ক। শিক্ষার জন্যে যখন প্রতিষ্ঠান ছিল না, পণ্ডিত ব্যক্তিগণ তখন কাজ করে গিয়েছেন এখনকার প্রতিষ্ঠানের। সেই দিন আর নেই। এখন পণ্ডিতেরা বের হন প্রতিষ্ঠান থেকে, তারপর আবার ঢুকে পড়েন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে। এর ব্যতিক্রম কম, খুব কম। তবে সংখ্যায় কম হলেও প্রতিভায় এরা বেশি। এরা স্বশিক্ষিত, স্বজ্ঞানী। মহাপুরুষদের জীবনের শপথ – এঁদের একেকজন একাকী যা করেন, বহু বহু প্রতিষ্ঠান মিলেও তা পারে না। প্রতিষ্ঠান দরকার হয় না তাঁদের। কারণ তাঁদের মস্তিষ্ক জাগ্রত। তাঁরা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড়। যাঁর মস্তিষ্ক জেগে ওঠে – তাঁর প্রতিষ্ঠান দরকার হয় না, প্রতিষ্ঠান তাঁকে ধরে রাখতে পারে না।

পথ হচ্ছে চলবার উপায়, বসবাসের ঠাঁই নয়। ঠাঁই হলো বাড়ি। আমরা পথে থাকি দরকারমতো, আর বাড়িতে ইচ্ছেমতো। শিক্ষাও তেমনি পথ – জ্ঞানের পথ। শিক্ষা তাই সাময়িক। কিন্তু জ্ঞান জৈবনিক। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা মেয়াদি, বয়সাবদ্ধ। কিন্তু জ্ঞান স্থান-কালের ছকে আবদ্ধ নয়, অবারিত। শিক্ষার পরিসর সীমিত। কিন্তু জ্ঞানতৃষ্ণার সীমা নেই।

বই শিক্ষার উপকরণ। বই পড়া শিক্ষাপ্রক্রিয়ারই অংশ। বই জ্ঞানের আধারও বটে, তবে জ্ঞানপ্রক্রিয়ার অংশ নয়। জ্ঞানপ্রক্রিয়া মানে চিন্তন। চিন্তন মানে ইন্দ্রিয়লব্ধ সংবেদনরাশি বিশ্লেষণ। এভাবে আমরা কিছু স্থির বোধ সঞ্চয় করি এবং সিদ্ধান্ত নির্মাণ করি। সেই বোধ ও সিদ্ধান্তগুলোকেই বলি জ্ঞান। বই জ্ঞান ধারণ করে এবং বহন করে ঠিক, তবু বই প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের উৎস নয়। উৎস ও আধার দুই আলাদা জিনিস। আধারে রাখা হয়, উৎস থেকে আসে। বস্তুত জ্ঞানের হাতিয়ার ইন্দ্রিয় আর তার উৎস হলো অভিজ্ঞতা।

জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পারস্পরিক কার্যসম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। তাই অভিজ্ঞতা কী, তারও ব্যাখ্যা দরকার। নয়া চুন দিয়ে পান খেতে গিয়ে যখন আপনার জিভ পুড়ল, তখন আপনি সরাসরি জানলেন যে, সদ্য-ভেজানো চুন খেতে মানা এবং এই মানা না-মানার ফল কষ্টকর। এখানে নয়া চুন যে খেতে নেই এ কথা জানার নাম জ্ঞান এবং জানার আগে তা খেয়ে জিভ পোড়ানোর ঘটনা হলো অভিজ্ঞতা। হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা ঘটনাই। তবে সব ঘটনা নয়। যে-ঘটনা বিশেষ কিছু জ্ঞান যোগায়, শুধু সেই বিশেষ ঘটনা। প্রসারিত অর্থে সেই বিশেষ জ্ঞানও অভিজ্ঞতা, যা বিশেষ ঘটনা থেকে আসে। এই যে অর্থের প্রসার, এ এক প্রথাগত ঘটনা। দোকানে লেখা দেখি: ‘এখানে ঠাণ্ডা পাওয়া যায়’। উদ্দেশ্য, ‘এখানে এমন জিনিস পাওয়া যায় যা থেকে ঠাণ্ডা পাওয়া যায়’। এভাবেই, জ্ঞানের উৎস যে-ঘটনা তাকে যেমন অভিজ্ঞতা বলা হয়, তেমনি সেই ঘটনা থেকে পাওয়া জ্ঞানকেও অভিজ্ঞতা বলা হয়। ফল, অভিজ্ঞতামাত্রই জ্ঞানবিশেষ বা জ্ঞানবিশেষের উৎস, কিন্তু জ্ঞানমাত্রই অভিজ্ঞতাবিশেষ বা অভিজ্ঞতাবিশেষের উৎস নয়। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ, তেমনি পার্থক্যও স্পষ্ট। এ কারণেই চাকরির আবেদনপত্রে ‘অভিজ্ঞতা’-স্থানে জ্ঞানের বয়ান চলে না, কর্মগত অতীতীয় ঘটনা উল্লেখ করতে হয়।

শিক্ষাকে আমরা বলেছি মাধ্যম, জ্ঞানকে গন্তব্য। আবার, এনেছি আরো মূর্ত উদাহরণ, বলেছি শিক্ষা গাড়ি আর জ্ঞান বাড়ি। উদাহরণের পার্থক্য দিব্যি দেখতে পাই, কিন্তু যার জন্যে উদাহরণ সেই শিক্ষা ও জ্ঞানের ভেদরেখাটি আমরা অনেকেই ঠিক ঠাহর করতে পারি না। তাই ভুল করি, ভুলে থাকি, ভুল হয়ে যাই। শ্রেণী পেরনোকে ভাবি সাফল্য, শ্রেণী শেষ করাকে মনে করি লক্ষ্যপূরণ। শেষ পর্যন্ত দেয়ালে সনদ ও নামের সঙ্গে পদক ঝুলিয়ে তৃপ্ত হই, থলের সঞ্চয় কী ও কত সে কখনো পরখ করে দেখা হয় না। এই আত্মভ্রমের স্বাভাবিক পরিণাম ─ আমরা বিষয়ের উপরে ফড়িঙের মতো উড়ি, ডুব দিয়ে তলে নামতে পারি না; ভক্তি করতে পারি, বিশ্লেষণ করতে পারি না; নিন্দা করতে পারি, চিন্তা করতে জানি না; প্রথার চাকর হয়ে খাটতে পারি, সম্ভাবনার বীজ থেকে প্রতিভার বৃক্ষ জাগিয়ে তুলতে পারি না।

বৈষয়িক বৃদ্ধি ও মানসিক ঋদ্ধি – সুন্দর জীবনের জন্যে একসঙ্গে দুটিই দরকার। বস্তু বিনে মানুষের চলে না, ভাব ছাড়া সে মানুষ হয় না। তাই বস্তুবাদ ও ভাববাদ দুই-ই জরুরি দর্শন। এর কোনো একটি যথেষ্ট নয়, এমনকি কল্যাণকরও নয়। একপেশে মার্কসীয় অর্থবাদ যেমন মানুষের জীবনকে অর্থবান করতে পারে নি, তেমনি অর্থবিমুখ গৌতমীয় কৃচ্ছ্রবাদও ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দরকার সমন্বয়বাদ – নৈতিকতার সঙ্গে দক্ষতার সমন্বয়সাধন, শিক্ষার সঙ্গে তার লক্ষ্য জ্ঞানের অব্যবহিত যোগসাধন। প্রয়োজন দেহ-মনের সমন্বিত বিকাশ, আত্মিক-বৈষয়িক দ্বিবিধ উন্নতি। এই সমন্বয় যত সুন্দর হবে, জীবন ততটাই সার্থক হবে। ইসলামী জীবনদর্শন এ সমন্বয়টি সাধন করেছে নিখুঁতভাবে। সে কারণেই ইসলামকে বলা হয় পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। প্রকৃত ইসলামী শিক্ষাদর্শন হলো ঐশিক অধ্যাত্মবাদ ও ঐহিক প্রয়োজনবাদে সুসমন্বিত জ্ঞানমুখী ও কর্মপ্রবণ শিক্ষাদর্শন। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এই শিক্ষাদর্শন ধারণ করে নি। ফলে আমাদের প্রধান তিন ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করছে প্রধানত তিন প্রকার অপূর্ণ মানুষ: বেঈমান পণ্ডিত ও নীতিহীন চাকর, দক্ষতাহীন মোল্লা ও ক্ষমতাহীন মুফতী এবং শেকড়হীন সনদশিকারী সঙ্করমানব।

———————————————————
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক। শাহবাগ, জকিগঞ্জ, সিলেট। [email protected] ০১৭৩৫-৫৩০০০০।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৪ রাত ৯:৫৯
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×