এই ঝুম বৃষ্টি বুঝি আর থামবে না।
এখন রাত ২ টা। না না , ২ টা ১০ । দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঢাকার বর্ষা দেখছি। যদিও এটা মোটেও উপভোগ্য না, এখানে বৃষ্টির শব্দ শোনা যায় কিন্তু বৃষ্টি পড়ে যে শব্দ হয় সেটা শোনা যায় না। হয়তো যায়। আমি শুনতে পাই না হয়তো। আমি সাধারণত মাটিতে কিংবা টিনের চালের উপর বৃষ্টির শব্দ শুনে অভ্যস্ত।
আজ রাতটা খুবই দীর্ঘ মনে হচ্ছে। মেসের সবাই চলে গেছে যার যার বাড়ি। ঈদের ছুটি। কিন্তু আমি যাইনি। আসলে যেতে পারিনি। লিয়া বলেছে তার সাথে যেতে। যদিও তার বাড়ি আমার বাড়ির সাথে নয়, একই জেলায় ও নয়। তবুও। ওর সাথে অর্ধেক পথ তো যেতে পারবো !
৪ তলা বিল্ডিঙের পুরাটা খালি। এমনকি বাড়ির মালিক ও চলে গেছে। হঠাৎ কিছু শব্দ শুনে বুঝলাম আমি একা না, কেউ আছে।
বারান্দা থেকে দরজায় এলাম। খুলে উঁকিঝুঁকি মেরে বুঝার চেষ্টা চালালাম শব্দের উৎপত্তিস্থল কোনটা। পেলাম না। তবে মনে হল মারুফ ভাইয়ের ফ্ল্যাট থেকেই শব্দ আসছে।
মারুফ ভাই আমাদের বিল্ডিঙেই থাকেন। আমার থেকে বয়সে কিছুটা বড়। জব করেন এক ফার্মে। আমি আগে ভাবতাম ফারম মানেই মুরগির ফার্ম। এখন কিছুটা বুঝি যে সেটা মুরগির না। তবে মারুফ ভাইয়ের ভাষ্যমতে উনি মুরগির ফার্মেই জব করেন। কারন সেখান থেকে উনি সুন্দরী জোগাড় করতে পারেন। আমি বলছি না। উনি নিজেই বলেন বেশ গর্ব করে। এসব মেয়েদের উনি মুরগি বলেই ডাকেন।
আবার বারান্দায় চলে এলাম। মনে হল কান্নার শব্দ?? এবার তো দেখতে হয়। ছাতা মাথায় নিয়ে নিচে নেমে এলাম। গেটের সামনে কে যেন দাঁড়িয়ে।
আরেহ ! এদেখি একটা মেয়ে। যা বুঝার বুঝে ফেললাম। মারুফ ভাইয়ের মুরগি নিশ্চয়ই। উনি যা মেজাজি। কিন্তু এই মেয়েকে রাত দুপুরে বের করে দিয়েছেন কেন ? আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে “মুরগির” দিকে তাকালাম। কোনও উত্তর পেলাম না।
বাধ্য হয়েই মুখ খুললাম,“ সমস্যা কি?”
দিনের বেলা হলে এমন সুন্দরী মেয়ে আমার মুখের উপর ঝামটা দিয়ে চলে যেত। সাথে ফ্রি পেতাম কিছু অপমান আর গালি। কিন্তু এখন কিছু বলল না মেয়েটা।
“আমি মারুফের বাসায় এসেছিলাম”
“বের করে দিয়েছে” আমার মুখটা একটু হাসি হাসি হয়ে গেলো।
মেয়েটি মাথা নিচু করে থাকলো।
“আচ্চা, যাবেন কথায়?”
মেয়েটি হতভম্বের মতো চেয়ে থাকলো। আজ রাতে তার থাকার ব্যাবস্থা ছিলই শুধু মারুফ ভাইয়ের বাসা।
“ঠিক আছে, বুঝতে পারেছি, আপাতত আমার বাসায় আসেন, ভাইয়ের রাগ কমলে চলে যাবেন।”
“ওর রাগ কমবে না আজ”
অস্বস্তি বোধ করলাম। কি মুসিবতে পড়লাম রে বাবা। শেষে না বিপদে পড়ি।
খুবই ভয়ে ভয়ে মেয়েটাকে রুমে নিয়ে আসলাম। কেউ টের পেলে খবর হয়ে যাবে। রুমে এসে মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকলো। বসতে দ্বিধা। কেউ হয়তো বসতে বলে না কখনও। সবারই খুব তাড়া।
“এই ঝড় বৃষ্টির রাতে বের হলেন কেন?” জিজ্ঞাসা করলাম।
নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো মেয়েটি।
“টাকার খুব দরকার” বিড়বিড় করে উত্তর দিল।
কিছু না বলে উঠে গেলাম কফি বানাতে। যত হোক, মানুষ তো। ফিরে এসে দেখলাম নেই। বারান্দায় চলে গেছে।
“সরি, বাসায় কিছু নেই। শুধু কফি”
মেয়েটি আজব দৃষ্টিতে তাকাল। বুঝলাম এমন ব্যাবহার পেয়ে সে অভ্যস্ত না।
যখন মেয়েটি কান্না শুরু করলো, আমি বেকুব হয়ে গেলাম। কি করবো বুঝতে পারলাম না।মাথায় হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেব ? কেমন জানি বাঁধা পেলাম মনে। হয়তো অন্য মেয়ে হলে ঠিকই সান্ত্বনা দিতে পারতাম। নিজের কাছেই নিজেকে কেমন ছোট ছোট লাগলো।
সকাল হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি বারান্দায় সারা রাত দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তাই। দুজনই সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়। কারো সূর্যোদয় আনন্দের। আর কারো সূর্যোদয় শুধুই আরেকটা নতুন কষ্টের সূচনা। সে কষ্টের ভাগ তারা কাউকে দিতে পারেনা। কেউ নিতেও পারেনা।