রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে'। ক্রিকেটের রেকর্ড বইয়ে কিন্তু মুত্তিয়া মুরালিধরনের অবস্থানটা সেই তালগাছটার মতোই আকাশছোঁয়া! ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির এই লঙ্কান কিংবদন্তি বোলিং কৃতিত্বে ছাড়িয়ে গেছেন সবাইকে।
ক্যান্ডির কাছের ছোট্ট একটি গ্রাম কুন্দাসালে থেকে সেন্ট অ্যান্থনি'জ কলেজে পড়তে এসেছিলেন চিন্নাস্বামী মুত্তিয়ার বড় ছেলে মুত্তিয়া। খ্রিস্টান মিশনারিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ক্রিকেটের চলটা ছিল সেখানে। সেখানেই ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয়। শুরুতে মিডিয়াম পেস বল করতেন। কিন্তু স্কুল দলের কোচ সুনীল ফার্নান্দো তাঁকে বদলে দিলেন অফ-স্পিনে। স্কুল ক্রিকেটে বর্ষসেরা হওয়ার পর শ্রীলঙ্কা সফরে আসা অস্ট্রেলিয়া দলের বিপক্ষে একটি প্রস্তুতি ম্যাচে দলে ঠাঁই হলো। সেখানেই কবজির ভেলকিতে বাজিমাত আর সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টেই রানাসিংহে প্রেমাদাসায় অভিষেক। সেই থেকে ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদদের ব্যস্ত রেখেছেন 'দ্য উইজার্ড'। রেকর্ড বুকের পরতে পরতে কতভাবেই না ছড়িয়ে আছে মুরালিধরনের নাম! 'বোল্ড মুরালিধরন'_এই শব্দ দুটি স্কোরবোর্ডে লেখা হয়েছে ১৬৭ বার। সিকি শতাব্দীর বেশি পুরনো টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এই 'শব্দজোড়ের' চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে কেবল 'রান আউট'। বোল্ড ছাড়াও সবচেয়ে বেশি বার স্টাম্পড (৪৭) এবং কট অ্যান্ড বোল্ড (৩৫) ডিসমিসালের রেকর্ডও মুরালিধরনের।
জুটি নাকি দুই ব্যাটসম্যানের মধ্যে হয় কিংবা বোলার-উইকেট কিপার। যেমন, গর্ডন গ্রিনিজ-ডেসমন্ড হেইন্স অথবা শেন ওয়ার্ন-ইয়ান হিলি। কিন্তু মুরালিধরনের জুটিটা সবচেয়ে দারুণ জমেছে 'ফিল্ডার' মাহেলা জয়াবর্ধনের সঙ্গে। মুরালির বলে মাহেলার হাতে ক্যাচ দিয়ে ব্যাটসম্যানের বিদায়_এমন ঘটনা ক্রিকেট বিশ্ব দেখেছে ৭৫ বার। উইকেটরক্ষক বাদে কোনো ফিল্ডারের সঙ্গে একজন বোলারের এমন সফল জুটির 'নজির' আর নেই। জীবনের শেষ এবং ৮০০তম টেস্ট উইকেটেও মুরালির সঙ্গে ছিল মাহেলারই যুগলবন্দি।
'অ্যান্ড আওয়ার ম্যান অব দ্য ম্যাচ ইজ মুত্তিয়া মুরালিধরন'_ম্যাচ শেষের পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে এই বাক্যটাই উচ্চারিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি ১৮ বার। এখানে অবশ্য একজন সঙ্গী আছেন তাঁর_জ্যাক ক্যালিস। প্রোটিয়া অলরাউন্ডার এখনো টেস্টকে বিদায় জানাননি, আরো ম্যাচসেরার পুরস্কারও হয়তো উঠবে তাঁর হাতে। কিন্তু বিদায়বেলায় শীর্ষেই ছিলেন লঙ্কান স্পিন জাদুকর।
বরাবরই পরিসংখ্যানবিদদের ব্যস্ত রাখা মুরালিধরন ৩৫০, ৪০০, ৪৫০, ৫০০, ৫৫০, ৬০০, ৬৫০ ও ৭০০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছেন সবচেয়ে দ্রুত। আর প্রজ্ঞান ওঝার উইকেট নিয়ে পৃথিবীর বুকে ৮০০ টেস্ট উইকেট শিকারি একমাত্র বোলার হিসেবে নাম লিখিয়েছেন মুরালি। টেস্ট এবং ওয়ানডে মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যাটসম্যানকে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠানোর কৃতিত্বটাও এই ডানহাতি অফ-স্পিনারের।
এখানেই থেমে যাচ্ছে না 'মুরালি-কাব্য'। টেস্টে সবচেয়ে বেশিবার ১০ উইকেট (২২ বার) নেওয়া মুরালিধরন সব কটি টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষেই ম্যাচে ১০ উইকেট করে পেয়েছেন। ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্বেও তিনি সবার শীর্ষে_৬৭ বার স্কোরকার্ডে তাঁর নামের পাশে লেখা আছে ৫ কিংবা তার বেশি উইকেট। টানা ৪ টেস্ট ম্যাচে ১০ উইকেট নেওয়া একমাত্র বোলারও তিনি; এবং এ কাজ তিনি করে দেখিয়েছেন দুইবার! টেস্ট আঙিনার ৯ প্রতিপক্ষের মধ্যে ৫ দেশের বিপক্ষেই অন্তত একবার ইনিংসে ৭ কিংবা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন মুরালিধরন। এ ছাড়া সব দেশের বিপক্ষেই অন্তত ৫০ উইকেট নেওয়া একমাত্র বোলারও তিনিই। টেস্টে ৮০০ উইকেট শিকারি এই একমাত্র বোলারের নামের পাশেই লেখা দেশের মাটিতে সবচেয়ে বেশি (৪৯৩) উইকেট শিকার কিংবা একই মাঠে সবচেয়ে বেশি (১৬৬) উইকেট শিকারের মতো বিচিত্র কিছু রেকর্ডও। তাই বিরুদ্ধবাদীরা তাঁকে যতই 'চাকার–', 'জ্যাভেলিন থ্রোয়ার' বলুক না কেন, পরিসংখ্যান কিন্তু মুরালির শ্রেষ্ঠত্বকেই স্বীকার করবে।
লেখক: সৌমিত চন্দ জয়দ্বীপ
সূত্রঃ বিডিস্পোর্টসনিউজডটকম

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



