
জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আগে সুন্দরবন এবং তত্সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে সাতটি বনদস্যু ও জলদস্যু বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। সুন্দরবন ও তত্সংলগ্ন সাগরে ত্রাস সৃষ্টিকারী বাহিনীগুলো হচ্ছে— রাজু, বাঘা, নাছির, সোহাগ গামা, আলামিন ও রুস্তুম নামে পরিচিত। বাহিনীপ্রধান জুলফিকার ও মোতালেব সম্প্রতি র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর বাহিনী দুটির দায়িত্ব নেয় যথাক্রমে গামা এবং আলামিন। এদের কাছে রয়েছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। এসব দস্যু বাহিনীকে গডফাদাররা লোকালয় থেকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যার কারণে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দস্যু সর্দাররা মারা পড়লেও গডফাদাররা ফের তাদের দল সক্রিয় করে দস্যুতায় নামিয়ে দেয়। উপকূলীয় এলাকা বাগেরহাটের শরণখোলা, বরগুনার পাথরঘাটা, পিরোজপুরের পাড়েরহাট, বাগেরহাট সদর ও খুলনায় গডফাদারদের প্রতিনিধি রয়েছে। এসব প্রতিনিধি দস্যুদের কুপন বিক্রি করে থাকে জেলেদের কাছে। অপহৃত জেলেদের মুক্তিপণের টাকা অনেক সময় প্রতিনিধিদের কাছে পরিশোধ করলেই জেলেরা দস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পায় বলে জেলেরা জানায়।
শরণখোলা জাতীয় মত্স্যজীবী সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন ও বরগুনা জেলা ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, গত জুলাই মাসে দস্যুরা জেলেদের ওপর সাত দফায় হামলা চালিয়ে দেড়শ’ জেলেকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ ও কোটি টাকার জাল, মাছ, ডিজেল ও ট্রলারের যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। এ সময় দস্যুদের হাতে এক জেলে নিহত ও কমপক্ষে ২৫ জন গুরুতর আহত হয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে, গত ২৭ জুলাই রাত ৯টায় বনদস্যু গামা বাহিনী সুন্দরবনের নাড়িকেলবাড়িয়া এলাকায় এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারে হামলা চালিয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন নামের এক জেলেকে কুপিয়ে তিন টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দেয়। এ সময় দস্যুদের রামদায়ের এলোপাতাড়ি কোপে ১২ জেলে গুরুতর আহত হয়। আহতদের বরিশাল মেডিকেল কলেজ ও পাথরঘাটা হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিত্সা দেয়া হয়। এদের বাড়ি পিরোজপুরের জিয়ানগর ও মোরেলগঞ্জ উপজেলায় বলে জানান তারা। ২৬ জুলাই সন্ধ্যায় বঙ্গোপসাগরের ফেয়ারওয়ে বয়ার অদূরে ১২-১৪ জনের একদল জলদস্যু সশস্ত্র অবস্থায় ভারতীয় একটি ট্রলারে এসে এফবি রাজিয়া ট্রলারে হামলা চালায়। এ সময় তারা ১৩ জেলেকে মারধর করে তিন লাখ টাকার ইলিশ মাছ, ট্রলারের ব্যাটারি, ডিজেল, সার্চলাইট, মোবাইল ফোন, ঘড়িসহ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করে নেয়। হামলার ঘটনাটি ওই ট্রলারের মালিক শরণখোলার রাজৈর এলাকার আবদুর রহিম আড়তদার সত্যতা স্বীকার করেছেন। ২৫ জুলাই রাতে বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবন সংলগ্ন পক্ষিরদিয়াচর এলাকায় বনদস্যু বাঘা বাহিনী মাছ ধরা অবস্থায় ১২টি ট্রলারে হামলা চালিয়ে ১৭ জেলেকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এ সময় ট্রলারের যন্ত্রাংশ, জাল, মাছসহ প্রায় ৫০ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে যায়। দস্যুদের হামলায় ৪ জেলে আহত হয়। এদের মধ্যে মামুন নামের এক জেলেকে হাত-পা ভাঙা অবস্থায় পাথরঘাটা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
বনদস্যু ও জলদস্যু বাহিনীগুলোর কাছে সুন্দরবন রক্ষায় নিয়োজিত বনবিভাগও জিম্মি হয়ে পড়েছে। দস্যুদের হামলার ভয়ে বন পাহারায় নিয়োজিত অনেক টহল ফাঁড়ি গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে বনবিভাগ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, তাদের ফাঁড়িতে মাত্র চারজন বনরক্ষী রয়েছে। তাই দস্যুদের ভয়ে তাদের নামে ইস্যু করা অস্ত্র রেঞ্জ কার্যালয়ে জমা রেখে আসতে হয়েছে। তাছাড়া বনরক্ষীদের গুলিতে দস্যুরা মারা পড়লে পুলিশি হয়রানির ভয়ে সাধারণত তারা বনদস্যুদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলেন। বনবিভাগ সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের ১ জুন বনদস্যু জুলফিকার বাহিনী শরণখোলা রেঞ্জের মরাভোলা টহল ফাঁড়িতে হামলা চালায়। এ সময় দস্যুদের এলোপাতাড়ি গুলিতে বনরক্ষী আফছার আলী (৫০) ঘটনাস্থলেই নিহত এবং ফাঁড়ি ইনচার্জ শাহআলম চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। একই বছরের ৩১ মার্চ খুলনা রেঞ্জের দোবেকি টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীদের টহল নৌকায় বনদস্যুরা হামলা চালিয়ে ২টি চাইনিজ রাইফেল ও ৮০ রাইন্ড গুলিসহ বিএম জহির উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ঘটনার ৫ দিন পর গভীর বন থেকে জহিরের লাশ উদ্ধার করে বনবিভাগ। ২০০৬ সালের ১৬ জানুয়ারি একই রেঞ্জের হলদেবুনিয়া টহল ফাঁড়িতে বনদস্যুরা হামলা চালিয়ে ৩টি অস্ত্র ও ১৮৩ রাউন্ড গুলি লুট করে নিয়ে যায়। গত ১৯৯১ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে বনদস্যুরা হামলা চালিয়ে বনপ্রহরী আবুল কালাম আজাদ ও নৌকা চালক আবদুর রহিমকে কুপিয়ে আহত করে ৪টি রাইফেল ১১৫ রাউন্ড গুলি ও অন্যান্য মালামাল লুট করে।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ১৩ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সুন্দরবনের ১৯ দস্যু নিহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দস্যু দমনে অভিযান অব্যাহত রাখলেও তাদের নির্মূল করা যাচ্ছে না। দস্যুরা তাদের নির্মম পরিণতির কথা জেনেও এ কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে। নতুন নতুন নামে বাহিনী গঠন করে চালাচ্ছে দস্যুতা। উপকূলীয় পেশাজীবীদের দাবি, এসব বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি এদের গডফাদার ও অস্ত্রের যোগানদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালাতে হবে। গডফাদার ও অস্ত্র সরবরাহকারীদের নির্মূল করতে পারলে দস্যুতাও বন্ধ হবে বলে তাদের অভিমত।
এ বিষয়ে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো জানান, বনবিভাগে লোকবল কম থাকায় বনরক্ষীদের দুই চারজনের দল নিয়ে অনেক ছোট-বড় খালে টহল দিতে হয় তাই বনদস্যুদের বিশাল বাহিনীর সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া দস্যুরা মারা পড়লে আইনগত অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। বনরক্ষীদের কোনো ঝুঁকি ভাতা না থাকায় তারা আহত হলে চিকিত্সা বা ক্ষয়ক্ষতির কোনো টাকা পান না তাই দস্যুদের সঙ্গে সংঘর্ষ সাধারণত এড়িয়ে চলেন। কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার শরীফ জানান, বর্তমানে সমুদ্রকেন্দ্রিক দস্যুতা হচ্ছে। তাই কোস্টগার্ডের সমুদ্র অভিযানের সামর্থ্য না থাকায় নৌবাহিনী টহল দিচ্ছে। তবে সুন্দরবনে কোস্টগার্ডের তিনটি স্টেশন ও একটি আউটপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে দ্রুত অভিযান চালানোর ফলে সুন্দরবনে দস্যুতা অনেক কমে গেছে। তাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান। শরণখোলা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আজিজুল হক জানান, তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত এক বছরে পুলিশ ২৮ জন বনদস্যুকে গ্রেফতার করেছে। তবে দস্যুদের গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হলেও তারা জামিন পেয়ে পুনরায় দস্যুতায় নেমে পড়েLink:

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



