দিপু দাসের হত্যাকাণ্ডকে প্রথম দেখায় ধর্মীয় উগ্রবাদের ফল বলে মনে করানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্ট, কিছু শিরোনাম এবং আলোচনার ভাষা পাঠককে সেই দিকেই ঠেলে দেয়। কিন্তু একটু গভীরে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে—এটি ধর্মীয় কোনো দ্বন্দ্ব নয়; বরং রাজনৈতিক প্রভাব, মালিকানা স্বার্থ এবং শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক নির্মম প্রতিশোধ।
দিপু দাস ছিলেন শিক্ষিত, সচেতন এবং সাহসী একজন শ্রমিক নেতা। তিনি কারখানায় শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে কথা বলেছিলেন—ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, নিয়মিত হিসাব ও স্বচ্ছতা। এসব দাবি কোনো ধর্মভিত্তিক নয়; হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব শ্রমিকের জন্যই প্রযোজ্য। দিপু একা নিজের জন্য কিছু চাননি; তিনি যা বলেছেন, তার সুফল পেত পুরো কারখানার শ্রমিকরা।
সমস্যা এখানেই। শ্রমিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়া মানেই মালিকপক্ষের কাছে ‘হুমকি’ হয়ে ওঠা। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মালিক রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী—একসময় আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ, বর্তমানে সুবিধামতো বিএনপির ছায়াতলে অবস্থান করছেন। ক্ষমতার এই রঙ বদলের খেলায় দিপুর মতো একজন সচেতন শ্রমিক নেতা ছিলেন অপ্রয়োজনীয় এবং বিপজ্জনক।
কিন্তু সরাসরি হত্যা করলে প্রশ্ন উঠবে, তদন্ত হবে, দায় এসে পড়বে প্রভাবশালীদের ওপর। তাই প্রয়োজন ছিল একটি ‘উছিলা’—একটি এমন আখ্যান, যা সহজে জনগণ গ্রহণ করবে এবং প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করবে। দিপু যেহেতু হিন্দু, তাই ধর্মীয় উস্কানিকে সামনে আনা হলো। হত্যাকে রূপ দেওয়া হলো ধর্মীয় সহিংসতার ঘটনায়, আর দায় চাপানো হলো জামায়াত-শিবির বা তথাকথিত ধর্মীয় উগ্রবাদীদের ওপর।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি নতুন কোনো কৌশল নয়। বছরের পর বছর নিরীহ মানুষকে হত্যা করে তার দায় ধর্মের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার উদাহরণ আছে। কিছু গণমাধ্যমও অজান্তে বা সচেতনভাবে সেই বয়ানকে শক্তিশালী করেছে। ফলে সাধারণ মানুষ প্রথমে যে গল্পটি শোনে, সেটিকেই সত্য ধরে নেয়।

অথচ ইসলাম নিজেই শ্রমিকের অধিকার বিষয়ে আপোষহীন। দিপু যদি মুসলিমও হতেন, শ্রমিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে তিনিও একইভাবে হুমকির মুখে পড়তেন—এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এখানে ধর্ম নয়, মূল দ্বন্দ্ব ক্ষমতা বনাম অধিকার।
দিপু দাসের হত্যাকাণ্ড তাই আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয়—ধর্মকে সামনে রেখে যে রাজনীতি করা হয়, সেটিই সবচেয়ে ভয়ংকর। কারণ এতে একদিকে সত্য চাপা পড়ে, অন্যদিকে সমাজে বিভাজন আরও গভীর হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই ‘ধর্মের নামে রাজনীতি’র চর্চা আজও চলমান। আর এর বলি হচ্ছে দিপুর মতো সাধারণ, নিরীহ মানুষ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৩৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



