ভয়ংকর ভিসুভিয়াস
শনিবার খুব ভোরে রওনা দিলাম রোম থেকে নেপলসের উদ্দেশ্যে। বিশাল এসি বাসভর্তি ট্যুরিস্ট বেশীরভাগই আমেরিকান তবে কিছু স্প্যানিশ আর দুজন ছিল কলম্বিয়ান। কেউ এসেছে পরিবার সহ কেউবা বন্ধু নিয়ে । এশিয়ান দের মধ্যে আমরা স্বামী স্ত্রী। গাইড মেয়েটি জানালো তার নাম জিয়ানী, আর ড্রাইভারের নাম রোলান্ডো।
শহর ছাড়িয়ে হাইওয়েতে উঠলাম। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছি হাতের বায়ে আপেনাইন পর্বত মালা যা কিনা বুট জুতার আকৃতি ইতালীকে পুর্ব থেকে পশ্চিমে দুভাগ করেছে লম্বা লম্বি ভাবে। আলপ্স পর্বত থেকে যার উৎপত্তি সে যাচ্ছে আমাদের সাথে সাথে নেপলস পর্য্ন্ত ।দুরে পাহাড়ের উপর কোন এক বিখ্যাত সন্ন্যাসীর মঠ যা আমাদের ভ্রমন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্ত গাইড বাসের জানালা দিয়েই আমাদের মঠ দর্শন পর্ব শেষ করলো।
আপেনাইন পর্বতমালা
বাস চলছে একই গতিতে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি,ভীষন মাথা ব্যাথা করছে আমার। জিয়ানি কে বল্লাম পেইনকিলার জাতীয় কিছু আছে কিনা? সে বল্লো: না, তবে নেপলসে পৌছে সবাই যখন সিটি ট্যুর করবে তখন সে এক ফাকে আমাকে একটা ডাক্তারের কাছে নামিয়ে দেবে, ডা: আমাকে পরীক্ষা করে প্রেশক্রিপশন লিখে দেবে মাথা ব্যাথার জন্য, সেটা নিয়ে আমি যাবো কোনো ফার্মাসীতে, সেখান থেকে আমি কিনে খেতে পারবো নাপা জাতীয় ঔষধ! শুনে তৎক্ষনাৎ আমার মাথা ব্যাথা চলে গেল।সেই মুহুর্তে উন্নত দেশের প্রতি আমার রাগ উঠতে লাগলো। আর আমাদের দেশে মুদীর দোকানেও নাপা কিনতে পারি, অনুন্নত থাকার এই এক সুখ!
নেপলসের চার্চের অভ্যন্তরে
নেপলসে নেমে সেখানকার বিখ্যাত মিউজিয়াম আর চার্চ দেখলাম ঘুরে ঘুরে। নেপলস শহরটি একদম সমুদ্রের তীরে। সুনীল টাইরেনিয়ান সি।নেপলস বন্দর।বিশাল বিশাল জাহাজ ভীড়ে আছে।যারা ক্যাপ্রি দ্বীপে যাবে তারা নেমে গেল। ক্যাপ্রির সেই বিশাল ওশেন লাইনার দেখে আমার ভীষন আফসোস হচ্ছিল।কারন অনেকবারই ট্যুরিস্ট কোম্পানি আমাদের ক্যাপ্রির রূপ সৌন্দর্যের বিবরন দিয়ে সেখানে যাবো কিনা জানতে চেয়েছিল, কিন্ত পানির প্রতি ভয় আমাকে রাজী করাতে পারেনি। কিন্ত জাহাজ দেখে....
যাক এখন আর আফসোস করে লাভ নেই।
আমরা সেখানে নেমে একটু ঘুরলাম কি ভালো লাগছিল তবে প্রচন্ড রোদ ছিল।এর মধ্যেই কয়েকজনকে দেখলাম আগুনের মতন তপ্ত সেই পাথরের উপরে শুয়ে রৌদ্রস্নান করছে!
অপরূপ সুনীল টাইরেনিয়ান সাগর
নেপলস ছেড়ে হাতের ডানদিকে গর্জনশীল ভিসুভিয়াস পর্বত আর গভীর নীল টাইরেনিয়ান সমুদ্রের পাশ ঘেষে আমরা যাচ্ছি পম্পেই।তখন দুপুর বারোটা বাজে। আমাদের বাস পম্পেই নগরীর ধ্বংস্বাবশেষের পাশে এসে থামলো।
সেখানে বিরাট এক প্রবাল আর ক্যামিওর কারখানা।ভূমধ্য সাগরের প্রবাল পৃথিবী বিখ্যাত। ক্যামিও হচ্ছে ঝিনুকের খোলটা যা ঘসে সাদা করে গহনায় ব্যবহার করা হয়।এটা আমাদের দেশেও আগে গহনা বিশেষ করে লকেটে ব্যবহার করা হতো।সেখানে কে কি কিনলো জানিনা তবে আমরা কিছু কিনি নাই।
প্রচন্ড গরম সূর্যের গনগনে তাপে সবকিছু যেন পূড়ে যাচ্ছে। কারখানার সামনেই ত্রিপল টাংগানো ওপেন রেস্টুরেন্ট। দুপুরের খাবার সেখানেই খেতে বসলাম সবাই। আমাদের টেবলে আমরা ছাড়া দুই কলম্বিয়ান ভদ্রমহিলা আর আট দশ বছরের বাচ্চা সহ এক আ্যমেরিকান ভদ্রলোক। যথরীতি সেই বিস্বাদ পিৎজা আর পাস্তা ,আমি আর বাচ্চা ছেলেটা শুধূ লুকিয়ে পাউরুটি খাচ্ছিলাম। ওর বাবা জানালো গত ৫দিন ধরে সে পাউরূটিই খাচ্ছে। পিৎজা আমাদের দেশে টেস্টই আলাদা।
যাক খাবার কথা বাদ।
পম্পে নগরী
অদূরেই ভিসুভিয়াস পর্বত,মেঘের গর্জনের মতন গুম গুম শব্দ করেই চলেছে আর তার শব্দে চারিদিক কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমি জানি তখনই কিছু হবেনা।পাহাড়ের ঢালে অনেক ঘর বাড়ী, তবুও ভয় ভয় লাগছিল।
সে সময় ইউরোপে রোমান সম্রাটদের শাসনামলে উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল এই পম্পেই ও তার সহোদরা নগরী হার্কুলেনিয়াম। ব্যবসা বানিজ্য, শিক্ষা দীক্ষা, শিল্প কলা বিশেষ করে আধুনিক নগরায়নের এক চুড়ান্ত উৎকর্ষের প্রতীক ছিল পম্পেই।কিন্ত ৭৯ খৃস্টাব্দে নগর থেকে অল্প কিছু দুরত্বে থাকা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াসের দুদিনের ভয়ংকর অগ্নুৎপাতে চার থেকে ছয় ফুট জলন্ত লাভার নীচে মূহুর্তের মধ্যে চাপা পড়ে গেল সে দুটি নগরী যেখান থেকে খুব কম সংখ্যক লোকই বাঁচতে পেরেছিল।
১৬০০ বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার পর ১৫৯২ খৃস্টাব্দে আকস্মিকভাবে এই দুটি নগরী আবিস্কৃত হয়, যা সমগ্র বিশ্বে এক প্রচন্ড আলোড়নের সৃস্টি করে। পরবর্তীতে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে এই নগরীকে। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠে পম্পেই।
পম্পেই নগরীর একটি বাড়ী
এখানে আমাদের গাইড পরিবর্তন হয়ে আসলো একজন বয়স্ক কিন্ত রসিক ভদ্রলোক,টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম সেই মৃত পুরীতে।তার মুখ থেকেই শুনলাম উপরের এইসব জানা অজানা ইতিহাস। সে আমাদের সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে শুরু করলো।
প্রথমেই দেখলাম নগরীর প্রধান দেবতা সুর্য দেব এ্যাপলোর মন্দির, এর পর গ্ল্যডিয়েটরস বা ক্রীতদাসদের থাকার জন্য ব্যারাক।
নগরীর প্রধান দুটি রাস্তার একটি
এ নগরীর প্রধান প্রধান দুটো রাস্তা, রাস্তাকে ল্যাটিন ভাষায় বলে ভিয়া, একটার নাম ভিয়া স্ট্যবিয়ানা আরেকটার নাম ভিয়া আব্বনডানজা। প্রতিটি রাস্তাই আগ্নেয় পাথরে বাধানো এবং রাস্তার দুপাশেই ফুটপাথ। আর একটু পর পর চার কোনা পাকা করা হাউসের মধ্যে পাইপের সাহায্যে পানীয়জল সরবরাহের ব্যাবস্হা। গাইড দেখালো পাথরের বেদীতে ঝুকে পানি খেতে খেতে পাথরটি কিভাবে একদিকে ক্ষয় হয়ে গেছে।
ক্ষয় হয়ে যাওয়া হাউসের একদিক
রাস্তা দুপাশেই বিশিস্ট ও ধনী ব্যক্তিদের বাড়ী, পাথরের বাথটাব বসানো পাবলিক বাথ, যেখানে সমাজের উচুস্তরের লোকজন গোসলের ফাকে ফাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক খোশ গল্প এবং বিনোদনে ব্যস্ত সময় কাটাতো।
একটা ঘরের মধ্যে দেখলাম বেশ কিছু লোকের মৃতদেহ পাথর হয়ে আছে,সাথে ছোট বাচ্চা আর কুকুরও আছে।
জীবন্ত মানুষের মমি
এই যে জীবন্ত মানুষগুলো ফুটন্ত লাভার করাল গ্রাসে মুহুর্তের মধ্যে ফসিলে পরিনত হয়েছিল, ঐতিহাসিকরা মনে করেন তারা পরবাসী, কোনো কারনে পম্পে এসে রাতের মত সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল।কিন্ত সে আশ্রয় ছিল তাদের শেষ আশ্রয়স্হল।
কি ভয়াবহ এক শোচনীয় মৃত্যু! কি করুন এক দৃশ্য।
ক্যাভে ক্যানেম অর্থাৎ কুকুর থেকে সাবধান
মৃত পম্পেই নগরীতে আমরা জীবিত মানুষরা হেটে হেটে দুপাশে কবরে পরিনত হওয়া বাড়িগুলো দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। গ্রিল দিয়ে বন্ধ একটা বাড়ী দেখিয়ে গাইড বল্লো, এটা এক ট্র্যাজিক কবির বাড়ী। বাইরে থেকেই গ্রিলের ফাক দিয়ে দেখলাম ঘরে ঢোকার প্রধান দরজার মেঝেতে মোজাইক করা কুকুরের একটি ছবি তার নীচে ল্যাটিন ভাষায় লেখা 'ক্যাভে ক্যানেম' অর্থাৎ "বিওয়্যার ওফ দ্যা ডগ"। গাইড জানালো এটাই নাকি পৃথিবীতে সর্ব প্রথম কুকুর থেকে সাবধান হবার লিখিত বানী।
হাউস অব দ্যা ফন
এরপর দেখলাম রাস্তার পাশেই পম্পের নামকরা অত্যন্ত ধনী ব্যাক্তির এক বিশাল বাগান বেষ্টিত বাড়ী, বাড়ীর নাম হাউস অব দ্য ড্যান্সিং ফন। গেট দিয়ে ঢুকতেই বাধানো এক চত্বর তার মাঝখানে একটু নীচু চৌবাচ্চা। সেটার মধ্যে বন আর পশু পাখির দেবতা ফনের নৃতরত একটি ছোট্ট ব্রোন্জের মুর্তি।যা হাজার হাজার বছর ধরে জলন্ত লাভা এবং পরবর্তীতে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া সেই কঠিন শক্ত ঝামা পাথরের নীচে থেকেও অবিকৃত আছে। প্রাংগনের চারিদকে চেরী, পাইন, দেবদারু আর পামগাছ। গাইড জানালো বাড়ীর মালিক অগ্নুৎপাতের সময় তার সোনার মোহরের বস্তা নিয়ে পালনোর ব্যর্থ চেস্টা করে মারা গিয়েছিল, তার বাড়ীর উঠোনেই জলন্ত লাভার নীচে চাপা পরে। সে বাড়ীর দেয়ালে দেয়ালে লাল রঙে আঁকা কত ছবি তবে তার বেশীরভাগই অস্পষ্ট ।
এই সেই বেকারী
একটি বেকারী দেখলাম তার মধ্যে ওভেন সহ রুটি বানানোর পাত্র এবং উপকরন যেমন গম জাতীয় শস্য ও দেখালো গাইড। মনে করা হয় অগ্নুৎপাতের আগেও ওখানে কাজ চলছিল
সবশেষে গাইড আমাদের নিয়ে গেল পম্পে নগরীর বিখ্যাত ( চারিত্রিক কারনে কুখ্যাত)ভেট্টি ভাইদের বাড়ীতে। বাড়ীতে ঢোকার আগেই গাইড এই দুই ভাইয়ের কীর্তিকলাপ সমন্ধে আমাদের কে অবহিত করলো। গাইডের ভাষায় দশ বছর আগেও দেখার জন্য কোন মহিলার সেই ভাইদের বাসায় প্রবেশাধিকার ছিলনা ,এখন আধুনিক জামানা তাই সে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে বলে গর্ব ভরে মহিলাদের দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি উপহার দিল!
বিখ্যাত ভেট্টি ভাইদের বাড়ী
ভেতরে ঢোকার আগেই অপ্রস্ততই হোলাম। চৌকোনা সেই বাড়ীর বিভিন্ন দেয়ালের গায়ে আঁকা আছে যথারীতি নারী পুরুষের ভোগ লালসার বিভিন্ন ভংগীমার ছবি যা কোনো শিল্পের মর্যাদায়ই পরেনা।অর্থ এবং চারিত্রিক বৈশিস্টের কারনেই তাদের নাম পম্পেই নগরবাসীর কাছে সুবিদিত ছিল। মাঝখানে বাগানের দিকে মুখ করে চারিদিকে ঘোরানো বারান্দা ওয়ালা চারকোনা একতালা বাড়ীটি টালির ছাদ দেয়া। বাড়ীটি ছিল নগরীতে প্রবেশের দুটি পথের একটি ভিসুভিয়াস গেটের একদম পাশে, যেখান থেকে খুব কাছে জীবন্ত ভিসুভিয়াস পর্ব্তটাকে সোজা দেখা যাচ্ছিল, অগ্নৎপাতের সময় লাভা এসে আমার মনে হয় ওদেরই প্রথম ঢেকে দিয়েছিল।
অনেকেই বলে এটা ছিল ঐ নগরবাসী তথা ভেট্টি ভাইদের পাপের শাস্তি !এত পাপ বোধহয় ধরিত্রীও সহ্য করতে পারেনি।
তাই ! তবে কি সেখানে কোনো ভাল মানুষই ছিলনা!
শেষ পর্বঃ
ভিসূভিয়াস - ২
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৪৪