somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিশাচ গল্প, কিছু সত্যি, কিছু কল্পনা

১৯ শে আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বেশ কয়েক বছর আগের কথা সদ্য বিবাহিত এক যুগলের ঢাকার অদুরে প্রত্যন্ত এক গ্রামে কাজের সুত্রে স্বল্পকালীন বসবাস করতে হয়েছিল। জনবসতিহীন দিকশুন্যপুর গ্রামের এক ধারে ধু ধু খালি মাঠ আর তারই কিনার ঘেষে কিছুটা জায়গা জুড়ে ছিল অফিসটি। সেখানে যেতে হলে তখন পদযুগলই ছিল ভরসা। জমিটির মাঝখান জুড়ে ছিল একটি মাঝারী আকারের পুকুর যার পানি রান্না থেকে শুরু করে সব কাজেই ব্যবহার হতো। সেই পুকুরের একদিকে চার পাঁচটা টিনের রুম যার একটি ছিল অফিস, বাকিগুলোতে চার পাঁচ জন অফিস কর্মী থাকতো। পুকুরের অপর পাড়ে দুই না বলে দেড় কামরা বলাই ভালো এক ছোট্ট টিনের ঘরে বাস ছিল সেই তরুন দম্পতির। আজন্ম শহরে বাস করা পানি বিদ্যুতের মত নুন্যতম নাগরিক সুযোগ সুবিধাবিহীন এই নির্বান্ধবপুরে সংসার পেতে বসাটা তাদের দুজনার কাছে যেন এক চরম এডভেঞ্চারের মতই ছিল।

বিকেল হলে নিয়ম অনুযায়ী মেয়েটির স্বামীসহ অফিসের সবাই দূর দুরান্তের গ্রামে চলে যেতো । সমিতির মিটিং শেষ করে প্রায়ই তাদের ফিরতে রাত দশটা বেজে যেত। গ্রাম দেশ, সুর্য্যটা পশ্চিমে ঢলে পরার সাথে সাথেই চারিদিকের তল্লাট জুড়ে দম বন্ধ করা এক ঝুম অন্ধকার নেমে আসতো। মেয়েটির কাছে সেই রাত দশটাকে মনে হতো যেন মাঝ রাত। সেই একলা সময়টিতে মেয়েটি ছাড়া আরেকজন মাত্র মানুষই থাকতো সেখানে , সে হলো সেই অফিসেরই পুরনো রাঁধুনী লোল চর্ম কুঁজো মতন এক বৃদ্ধা যাকে সবাই নানী বলে ডাকতো।

সন্ধ্যা থেকেই অফিস ঘরের খানিকটা পেছনে ছন আর বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরী কালিঝুলি মাখা এক রান্নাঘরে কুপির টিমটিমে আলোয় মাটির চুলোয় সবার জন্য রান্না করতে বসতো নানী । একাকী থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে ওঠা মেয়েটি অনেক সময় রান্নাঘরে বৃদ্ধার পাশে গিয়ে বসতো । মাঝে মাঝে শুনতো কি যেন বিড় বিড় করে নিজ মনে বকে চলেছে বৃদ্ধা। সে সময় তার উপস্থিতিটা যে পছন্দ করতো না তা বুঝতে পেরে মেয়েটি চেষ্টা করতো পারতপক্ষে তার কাছে গিয়ে না বসতে।

ভাদ্রমাসের এক নিস্তব্ধ রাত্রি, মেয়েটি হারিকেন জ্বেলে নির্জন ঘরে একাকী বসে আছে। সেই রাত্রিতে চারিদিক জুড়ে ঘুট ঘুটে অন্ধকার নেমে এসেছিল। রাত নেমে আসা মাত্রই দেখা যায় আশে পাশের জঙ্গলে জোনাকি পোকাদের শরীরের বাতিগুলো জ্বলছে আর নিভছে আজ কি এক অজানা কারনে তারা আলো নিভিয়ে বসে আছে।
হারিকেনের আলোয় ঘরে পোঁকা মাকড় আসবে তাই মেয়েটি উঠে দরজা জানালা বন্ধ করে দিলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমে ঘেমে নেয়ে ঊঠলো মেয়েটি। বাইরের সাথে তাল মিলিয়ে ঘরের ভেতরেও যেন এক সুচীভেদ্য অন্ধকার যা সরাতে হারিকেনটি তার সামান্য আলো নিয়ে প্রানপন চেষ্টা করছে। চালের উপর নুয়ে পরা বাঁশের ঝাড় যে কিনা সামান্য বাতাসেও শব্দ করে সেও যেন আজ বড্ড নীরব। এত অন্ধকার আর নীরবতায় মেয়েটির দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন।

হঠাৎ করেই পঁচা মাংসের এক তীব্র কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘর জুড়ে। আঁচলে নাক চেপে ধরতেই মেয়েটি অনুভব করলো গা শিউরে ওঠা বরফ শীতল এক শিরশিরে হাওয়া যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার সারা শরীরে।
কাঠের দরজা-জানলাগুলো ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে উঠতেই আতংকে ফ্যাকাশে হয়ে ওঠা মেয়েটি হারিকেনের মৃদু আলোয় তাকিয়ে দেখে ঘরের দক্ষিন পশ্চিম কোন জুড়ে ঘন কুচ কুচে কালো এক অন্ধকার আস্তে আস্তে বিশাল এক কিম্ভুত কদাকার শরীরের আকৃতি লাভ করছে। সেই বীভৎস আকৃতির ভেতর এক ভয়ংকর দানবের মুখ বসানো আর তার মাঝে সাদা এক জোড়া বিশাল চোখ।

কালো সেই অন্ধকারটি ফুলে ফেপে এবার যেন আরো বড় হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে মেয়েটির দিকে । তার সেই রক্তহীন চোখ মেয়েটির চোখের উপর এমন ভাবে নিবদ্ধ যেন একজোড়া চুম্বক। দৈত্যাকৃতি অজগর যেমন তার শিকারকে এক অমোঘ আকর্ষনে বিবশ করে ফেলে। তেমনি করে এবার আতংকে অবশ হয়ে আসা মেয়েটিকে সেই অশরিরী অন্ধকার যেন এগিয়ে এসে তার শরীরের মাঝে সবলে গ্রাস করে নিচ্ছে।
ঘোর কাটিয়ে ঝটকা দিয়ে উঠেই মেয়েটি কাঁপা হাতে কোন রকমে হারিকেন নিয়ে খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে আসে পাগলের মত। কিন্ত সেই অশরিরী বস্তুটি যেন তার সাথে সাথে এসে পিঠের উপর চেপে বসতে চাইছে ক্রমশ যেন ভারে নুয়ে পড়ছে শরীর। তাই নিয়েই মেয়েটি পুকুরের পাড়ের ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে চেষ্টা করতে লাগলো। সেই সাথে চিৎকার করতে গিয়েও দেখে তাঁর গলা দিয়ে কোন আওয়াজই বের হচ্ছে না ।

হঠাৎ করেই সেই অন্ধকার বস্তটি পিঠের উপর থেকে নেমে পরলো, তারপর অত্যন্ত দ্রুত গতিতে মেয়েটির চারপাশ ঘুরে ঘুরে আস্ঠে পৃষ্ঠে বেধে ফেলতে লাগলো। সেই অদৃশ্য চাপে মেয়েটির মনে হচ্ছে তার সারা শরীরের হাড়গোড় যেন ভেংগে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এবার বুঝি সে মরে যাবে। ঠিক এমন সময় অবশ হয়ে আসা হাত থেকে হারিকেনটা পরে গিয়ে ঠিন ঠিন আওয়াজ তুলে কাঁচটা ভেঙ্গে পড়লো, কেরোসিন গড়িয়ে পড়লো চারিদিকে তারপর বেশ খানিক্ষন দপ দপ করে নিভ গেল সলতে্টা। সাথে সাথে শরীরটা যেন হালকা হয়ে আসলো আর অনেক কষ্টে এবার এক চিৎকার করে মাটিতে উপুর হয়ে পড়লো মেয়েটি । জ্ঞ্যন হারাবার আগে কানে ভেসে আসলো রান্নার বুড়িটার খোনা গলার আওয়াজ। তার পাশে দাঁড়িয়ে হি হি করে হেসে হেসে কাকে যেন বলছে, ‘কিঁরে একা ঘরে পাঁইয়াও পারলি না মাইঁয়াটারে তুইলা নিয়া যাইতে’!

তারপর আর কিছু মনে নেই মেয়েটির। এরপর চোখ মেলতেই সে দেখে তাদের ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে। জানালা দিয়ে রোদের আলো এসে তেরছা করে মেঝেয় পরে আছে। ঘরের ভেতর তার স্বামী ও দু একজন অফিস সহ-কর্মী। মেয়েটি অবাক হয়ে দেখলো গেরুয়া বসন এক সন্ন্যাসীও বসে আছে বিছানার পাশেই কাঠের চেয়ারে। মেয়েটি জানলো তার খবর শুনে দুরের গ্রাম থেকে নিজেই চলে এসেছে। চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষন বসে থাকার পর তার স্বামীকে শুধু বললো ,
“আপনি ভাগ্যবান যে আপনার স্ত্রীকে ফিরে পেয়েছেন, কিন্ত সবাই এমন ভাগ্যবান হয়না”। কারনটি জানার জন্য মেয়েটির স্বামী অনুরোধ করলে সন্ন্যাসী থেমে থেমে জানালো গতরাতে তার স্ত্রীকে এক ভয়ংকর পিশাচ ধরেছিল যার হাতে পরলে একমাত্র পরিনতি ভয়ংকর মৃত্যু।
এক সময় এ জায়গাটি ছিল শশ্মান কিন্ত নদী সরে যাবার পর এলাকাটি এখন পরিত্যক্ত। আজ থেকে বহু বছর আগে এক প্রেত সাধক তান্ত্রিক এই শশ্বানে বসে প্রেত সাধনা করেছিল তাকে বাধ্য করে কাজে লাগানোর জন্য। সাধনার সময় এক অমাবশ্যার রাতে সেই পিশাচের হাতেই তান্ত্রিকের মৃত্যু হয়। আজও সে শুধু অমাবশ্যার রাত্রিতেই বের হয়। আর গতকালই ছিল সেই কাল অমাবশ্যা।
“কাঁচ ভেঙ্গে হারিকেনের আগুন বাইরে এসে পরায় সে আপনার স্ত্রীকে ফেলে গিয়েছিল। যত দ্রুত পারেন তাকে এখান থেকে সরিয়ে দিন, পরের বার ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন নাও হতে পারে। খেয়াল করেছেন নিশ্চয় গ্রামের কেউ আপনাদের অফিসের আশপাশ দিয়ে দিনের বেলায়ও চলাফেরা করে না”।
মেয়েটি সেই রান্নার বুড়ির কথাটি আর উল্লেখ করলো না। সে পরিস্কার তার পরিচিত গলা শুনেছিলো, কিন্ত চোখে তো দেখেনি। তাই হয়তো কেউ বিশ্বাস নাও করতে পারে। এর কিছু দিন পরেই তারা সেখান থেকে বদলী হয়ে চলে এসেছিল।


সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ৮:৩৫
৪৯টি মন্তব্য ৪৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×