এক দেশে আছেন এক রানী যিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের অধীনে দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে দুনিয়ার বহু দেশ সহ নিজ দেশকেও শাসন করে চলেছেন। সেই রানীর স্বামী, ছেলেমেয়ে নাতি-পুতি নিয়ে ভরা সংসার কিন্ত তাঁর রাজত্বে কোন রাজা নেই। বলছি রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপের কথা। তিনি ছিলেন রানীর সহচর ইংরেজীতে যাকে বলে রয়্যাল কনসর্ট, যিনি সুদীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে রানীর পাশে পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে থেকে তাকে তাঁর সকল রাজকীয় দায়িত্বে, সকল পারিবারিক কাজে সহযোগিতা করে গেছেন। গত ৯ই এপ্রিল শুক্রবার ভোরে ৯৯ বছর বয়সে তিনি উইন্ডসর প্রাসাদে নিজের বিছানায় ঘুমের মধ্যে মৃত্যু বরন করেন। তাদের মেজ ছেলে প্রিন্স এন্ড্রু সাংবাদিকদের জানিয়েছেন দীর্ঘ দিনের সংগীকে হারিয়ে শোকাহত রানী বর্তমানে এক অসীম শুন্যতায় ডুবে আছেন।
অত্যন্ত সুদর্শন, স্মার্ট ১৮ বছর বয়সী নেভীর ক্যাডেট অফিসার প্রিন্স ফিলিপের সাথে রানীর যখন প্রথম সাক্ষাৎ হয় তাখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩ । বাবা ষষ্ঠ জর্জ ও মা এলিজাবেথের সাথে তারা দুই বোন গিয়েছিলেন রাজকীয় সফরে ডার্টমাউথের নেভাল একাডেমীতে যেখানে ক্যাডেট হিসেবে ছিলেন প্রিন্স ফিলিপ। দুই বোন এলিজাবেথ ওঁ মার্গারেটকে একাডেমিটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। আর তাকে প্রথম দেখায়ই তখনকার রাজকন্যা এলিজাবেথ মুগ্ধ হন। ফিলিপ রাজপুত্র হলেও তাঁর প্রথম জীবন কুসুমাস্তীর্ন ছিল না । জন্মসুত্রে ডেনমার্ক ও গ্রীসের রাজপুত্র ফিলিপের জন্ম হয়েছিল ১৯২১ সালের ১০ই জুন গ্রীসের কর্ফু দ্বীপের এক ভিলায়। তাঁর বাবা ছিলেন গ্রীস ও ডেনমার্কের ক্ষমতাসীন রাজা প্রথম কনস্ট্যান্টাইনের ভাই প্রিন্স এন্ড্রু আর মা ছিলেন ডেনমার্কের বর্তমান রাজকীয় পরিবারের সদস্য প্রিন্সেস এলিস অফ ব্যাটেনবার্গ। চার বোনের পর একমাত্র ভাই প্রিন্স ফিলিপ ছিলেন সবার আদরের। কিন্ত প্রিন্স ফিলিপের যখন ১৮ মাস বয়স তখন গ্রীসের সাথে তুরস্কের ইতিহাস বিখ্যাত যুদ্ধে পরাজিত গ্রীস ভয়ানক ক্ষতির মুখোমুখি হন ফলে সৈন্যবাহীনি ও জনগনের চাপে গ্রীসের রাজা প্রথম কনস্ট্যানটাইন সিংহাসন ত্যাগে বাধ্য হন। গ্রেফতার হন সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রিন্স ফিলিপের বাবা সহ অনেকে অফিসার।পরবর্তীতে এক চুক্তির মাধ্যমে প্রিন্স এন্ড্রু পরিবারকে নিজ মাতৃভুমি গ্রীস থেকে নির্বাসিত করা হয়।
সেসময় তাদের সম্পর্কিত ভাই বৃটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ হিজ ম্যাজেস্টিস শিপ ক্যালিপসো নামে নৌবাহিনীর একটি জাহাজ পাঠান তাদের উদ্ধারের জন্য। বলা হয়ে থাকে সোনার খাটে জন্মানো আঠারো মাস বয়সী প্রিন্স ফিলিপ একটি কমলালেবুর বাক্সে শুয়ে ফ্রান্সে এসেছিল তাঁর বাবা মা আর চার বোনের সাথে। ফ্রান্সের উপকন্ঠে ফিলিপের এক ধনাঢ্য খালা প্রিন্সেস জর্জ অভ গ্রীস ও ডেনমার্কের বাসায় আশ্রয় নেন । এখানে একটি কথা না বললেই নয় তা হলো ইউরোপের প্রায় দেশের রাজা রানীরাই আত্মীয়তার সুত্রে বাধা। যেমন প্রিন্স ফিলিপের মা ছিলেন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সম্রাজ্ঞী রানী ভিক্টোরিয়ার আত্মীয়া।
প্রিন্স ফিলিপের শিক্ষা জীবন বাড়ির পাশে এক ইংরেজী স্কুলে শুরু হলেও ১৯৩০ সনে তাকে পড়াশোনার জন্য বৃটেনে পাঠানো হয়। সে সময় তিনি তাঁর সম্পর্কিত নানী ভিক্টোরিয়া মাউন্টব্যাটেনের সাথে বাকিংহাম প্রাসাদের পাশেই কেনসিংটন প্যালেসে থাকতেন। এর বছর তিনেক পরে তাঁর চার বোনই জার্মান প্রিন্সদের বিয়ে করে জার্মানীতে চলে যান। সিজোফ্রেনিয়া ধরা পড়ায় তাঁর মাকে গ্রীসের একটি স্যানিটোরিয়ামে পাঠানো হয়। এর ফলে তাঁর শৈশব কৈশোর এমনকি তরুন বয়সেও তাঁর মায়ের সাথে তেমন যোগাযোগ ছিল না । আর বাবা প্রিন্স এন্ড্রু মোনাক্কোর বিখ্যাত রিসোর্ট শহর মন্টি কার্লোতে রাজকীয় বিলাস ব্যাসনে দিন যাপন করছিলেন, এই সবই ঘটে প্রিন্স ফিলিপের বয়স যখন আট। অর্থাৎ আট বছর বয়সেই তাঁর পরিবার আর কোনদিন এক ছাদের নীচে থাকেনি , যা তাঁর মানসিকতাঁর উপর প্রচন্ড প্রভাব ফেলেছিল।
১৯৩৭ সনে প্রিন্স ফিলিপ আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনার সন্মুখীন হন। জার্মানী থেকে লন্ডনে এক বিয়েতে অংশ গ্রহনের জন্য রওনা হয়েছিলেন প্রিন্স ফিলিপের বোন সিসিল, সাথে ছিল তার জার্মান প্রিন্স স্বামী ও দুই বাচ্চা। এক মর্মান্তিক প্লেন দুর্ঘটনায় তারা সবাই মারা যান। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বোন ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অন্ত্যষ্টিকাজে অংশ গ্রহন করতে প্রিন্স ফিলিপ জার্মানী গিয়েছিলেন।তাঁর বোন আর তাঁর স্বামী দুজনাই ছিলেন নাজী বাহিনীর সদস্য। হিটলারের ইহুদী নির্মুলের সময় প্রিন্স ফিলিপের মা প্রিন্সেস এলিস মানসিক অসুস্থতা থেকে সুস্থ হয়ে জার্মানীতে সন্নাসিনীর জীবন যাপন করছিলেন। সে সময় তিনি ভয়ংকর বিপদের আশংকা থাকা সত্বেও একটি ইহুদী পরিবারকে দীর্ঘ সময় লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিল। তারপর ও তার বোন ও তাঁর স্বামীর নাজী সংশ্লিষ্টতা প্রিন্স ফিলিপের জীবনে একটি কালো দাগ রেখে গেছে।
১৯৩৯ সনে প্রিন্স ফিলিপ বৃটেনের বিখ্যাত রয়েল ন্যাভাল কলেজ ডার্টমাউথে ক্যাডেট হিসেবে জীবন শুরু করেন। পরের বছর সেরা ক্যাডেট হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। এই সময়ের মাঝেই প্রিন্স ফিলিপের জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে আর তা হলো এক সত্যিকারের রাজকন্যার সাথে পরিচয়। সে সময়ের বৃটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জ তাঁর স্ত্রী দুই মেয়েকে নিয়ে এক রাজকীয় সফরে ডার্টমাউথ নেভাল কলেজে যান , রাজকন্যাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব পরে প্রিন্স ফিলিপের উপর ।গ্রীক দেবতার মতই অসাধারন দৈহিক সৌন্দর্য্যের অধিকারী সেই সাথে সোনালী চুলের সুদর্শন, স্মার্ট, বাকপটু ১৮ বছরের প্রিন্স ফিলিপের সমুদ্রের অসীম নীল জলের মত নীল চোখে চোখ রেখে এক মুহুর্তেই হারিয়ে যান ১৩ বছরের কিশোরী রাজকন্যা । যেই চোখ সে এই ৭৫ বছরেও সরাতে পারে নি ।
এরপর থেকে শুরু হয় তাদের চিঠি বিনিময়, কখনো প্রাসাদে বেড়াতে আসা, আস্তে আস্তে গভীর সেই বন্ধুত্ব পরিনত হয় ভালোবাসায় । তবে বিভিন্ন সুত্র মতে প্রেমে পড়ার ব্যাপারে এলিজাবেথের আগ্রহই ছিল বেশি। ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলা এক পারিবারিক জীবনের লোভ এবং নিস্পাপ সরল মুখশ্রীর এলিজাবেথের নিখাদ ভালোবাসায় মুগ্ধ ফিলিপও তাতে সাড়া দেয়।
১৯৪৬ সনে প্রিন্স ফিলিপ রাজকন্যা এলিজাবেথের বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জের কাছে তাঁর মেয়ের পানিপ্রার্থনা করলে রাজা জানিয়ে দেন মেয়ের ২১ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। সে সময় ইতিহাস বিখ্যাত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বৃটিশ নৌ বাহিনীর অফিসার হিসেবে ফিলিপ অক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন নৌ যুদ্ধে অবতীর্ন হয়ে একজন যোদ্ধা ও সমর কুশলী হিসেবে নিজ দক্ষতার পরিচয় দেন।এই যুদ্ধে তিনি তাঁর দুই বোনের স্বামীদের বিরুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন যারা ছিলেন জার্মান নৌ বাহিনীর সদস্য।
১৯৪৭ সালের ২০ শে নভেম্বর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধাক্কা সামলে ওঠা বৃটেনে এক রংগীন আলোর ঝলকানি নিয়ে এসেছিল প্রিন্স ফিলিপ আর রাজকন্যা এলিজাবেথের বিয়ে। রাজপরিবারের অনেকেই তাঁর এই বিয়েতে প্রথমে সম্মত ছিলেন না কারন তিনি রাজপুত্র হলেও তাঁর কোন রাজ্য ছিল না, রাজকীয় আদব কেতায়ও অভ্যস্থ ছিলেন না, যেখানে এলিজাবেথ ছিলেন তখনকার দিনের বিখ্যাত রাজপরিবারের সদস্যা ও ভবিষ্যত রানী, মানুষ হচ্ছিলেন রাজপ্রাসাদের চৌহদ্দির মধ্যে নানা রকম রাজকীয় আচার আচরনের মধ্যে দিয়ে। কিন্ত এলিজাবেথ তাঁর ভালোবাসায় ছিলেন একনিষ্ঠ প্রেমিকা। প্রিন্স ফিলিপ ও তাকে প্রচন্ড ভালোবেসেছিলেন যা বজায় ছিল তাঁর ৭৫ বছরের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে।
নিজের গ্রীক ও ডেনিশ পরিচয় মুছে তাইতো তিনি মাতৃকুলের পরিচয় মাউন্টব্যাটেন উপাধি গ্রহন করেছিলেন সাথে বৃটিশ নাগরিকত্ব। গ্রীক চার্চকেও ছেড়েছিলেন তাঁর ভালোবাসার জন্য। চিঠি বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে তাদের পরিচয় শেষ পর্যন্ত ভালোবাসা এবং শেষে পরিনয়ে গড়ায় । ১৯৫২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী প্রিন্স ফিলিপ আর এলিজাবেথ যখন কেনিয়া সফরে তখন সংবাদ আসে তাঁর পিতা রাজা ষষ্ঠ জর্জের আকস্মিক এবং অকাল মৃত্যুর সংবাদ। সেই দুঃসংবাদটি ভবিষ্যত রানীকে জানিয়েছিলেন তাঁরই স্বামী প্রিন্স ফিলিপ আর সেদিন থেকেই তিনি তাঁর অল্প বয়সী এবং সদ্য মা হওয়া অনভিজ্ঞ স্ত্রী রানী এলিজাবেথের সমস্ত রাজকীয় এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালনে এক কঠিন পাথরের মত পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন যা শেষ হলো ৯ই এপ্রিল ২০২১ তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
রানী এলিজাবেথ তাঁর ৫০ তম বিবাহ বার্ষীকিতে তাই বলেছিলেন He is someone who doesn't take easily to compliments but he has, quite simply, been my strength and stay all these years, and I, and his whole family, and this and many other countries, owe him a debt greater than he would ever claim, or we shall ever know.
ছবি ও তথ্য নেট ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০২১ সকাল ১০:০০