“অন রোড ম্যাজিস্ট্রেট” এর কাছ থেকে সেই মহার্ঘ্য সনদপত্রটি অর্জনের পরে আমাদের গাড়ীকে সেদিন প্যাহেলগামে যেতে দেয়া হয়েছিল বটে, তবে হাইওয়ে ধরে এগুতে দেয়া হয়নি। অনেকটা পথ ঘুরে, গ্রামীণ সড়ক আর অলিগলি ঘুরে সেদিন প্যাহেলগামে যেতে হয়েছিল। পথে আপেলের ফ্রেশ জ্যুসের একটা দোকানের/বাগানের সামনে এসে শাফি গাড়ী থামালো। আমরা বেছে বেছে কয়েকটা আপেল নিলাম। সেগুলো চেপে দোকানী আমাদেরকে ফ্রেশ জ্যুসের তিনটি গ্লাস এগিয়ে দিল। সেখানে পরিচয় হলো দোকানের কর্মচারী আমের খান এর সাথে। সে আমাদের মুখে বাংলা কথা শুনে জিজ্ঞেস করলো, ‘ফ্রম বাংলাদেশ’? আমি হ্যাঁ বলাতে সে এক নিঃশ্বাসে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের তামিম ইকবাল থেকে শুরু করে শেষ খেলোয়াড়ের নামগুলো গড় গড় করে বলে গেল, যা আমি নিজেও হয়তো বলতে পারতাম না। নামগুলো বলতে পেরে সে নিজেকে খুব গর্বিত বোধ করলো বলে মনে হলো, এবং নিঃসন্দেহে আমিও। সে জানালো সে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ভক্ত এবং কোন ম্যাচে বাংলাদেশ খেললে সে আর অন্য কোন দলকে কখনোই সমর্থন করে না। স্মরণ করলাম, এ কথাটি অবশ্য প্রথম দিনেই শাফিও আমাকে জানিয়েছিল। এখন ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলছে। যেদিন বাংলাদেশের খেলা থাকে, সেদিন আমি যেন আমার বেডরুম থেকেই শাফি এবং আমের খানের করতালির আওয়াজ শুনতে পাই।
ঘুরা পথে যাওয়ার কারণে সেদিন প্যাহেলগামে পৌঁছতে বেশ দেরী হয়ে গিয়েছিল। দেরী হবার আররেকটা কারণ ছিল জায়গায় জায়গায় থেমে কিছু ছবি তোলা। এক জায়গায় শাফি গাড়ী স্লো করে বললো, স্যার এটা ঝিলাম নদীর শাখা। পেছনে আরো গাড়ী আসতে থাকায় সেতুর ওপরে গাড়ী থামানোর কোন উপায় ছিল না। আমি স্লো করা গাড়ী থেকেই ঝিলাম নদীর কিছু ছবি তুলে নিলাম। আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের গানে সিন্ধু এবং ঝিলাম নদীর কথা আছে। দুটো নদীকেই দেখতে পেলাম কাশ্মীর সফরে এসে। কবি কি কখনো দু’দন্ড সময় এই দুই নদীর তীরে বসেছিলেন? আমি জানিনা।
নদী পার হবার পর রাস্তার দু’পাশে বড় বড় কিছু নদীবাহিত বোল্ডার দেখতে পেলাম। একটা বোল্ডারে দেখলাম বড় বড় করে রেড অক্সাইড পেইন্ট দিয়ে লেখা, “আই লাভ ইউ, হেনা”। চলন্ত গাড়ী থেকে দেখা, ছবি তোলার ইচ্ছে থাকা সত্তেও গাড়ী থামাতে পারলাম না। তবে মনে মনে ভেবে রাখলাম, পরের দিন ফেরার পথে সেখানে থেমে একটা ছবি তুলে রাখবো। প্রেমের এসব বিশুদ্ধ উচ্চারণ আমার কাছে সঙ্গীতের মত মনে হয়। যে প্রেমকাতর যুবক এমন একটা কোমল আবেদন এক কঠিন শিলার উপর উৎকীর্ণ করে রেখে গেছে, সেও হয়তো জানতো, তার এ ব্যর্থ আবেদন হয়তো বোবা পাথরের উপরে বোবা হয়েই থাকবে বহুদিন, একসময় রোদ বৃষ্টিতে বিলীন হয়ে যাবে, তবুও সে কথাগুলো তার প্রেমিকার চোখে পড়বে না, কর্ণকুহরেও প্রবেশ করবে না, কারণ তা কখনো বলা হবে না। এ কথা জানা থাকা সত্তেও হয়তো সে বিশ্বস্ততার সাথে তার অনুভূতির কথা এভাবে পাথরে লিখে রেখে শুধু হেনাকেই নয়, বিশ্বকেও জানিয়ে দিয়েছে তার ভালবাসার কথা।। মানুষ অনাদিকাল হতে অপরের মনে একটু স্থান পাবার জন্য পাথরে নাম লিখে এসেছে। সম্রাট অশোকও তা করেছিলেন। কিন্তু মান্না দে গেয়েছেন, "যদি কাগজে লিখো নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে, পাথরে লিখো নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে, হৃদয়ে লিখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে"। কিন্তু আমরা ক'জনাই বা কারো হৃদয়ে নাম লিখতে পারি?
কিশোর বয়সে যারা (অপরিপক্ক প্রেমিকেরা) এমন নির্ভেজাল অনুভূতির কথা সরাসরি প্রেমিকাকে বলতে পারেনা, তারাই বুঝি এমন উদ্দেশ্যহীনভাবে তাদের অনুভূতির কথা প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দেয়। আগে ভাবতাম, এমন কাজ বুঝি শুধু বাঙালিরাই করে। কিন্তু পরে জেনেছি, প্রেমের এই অদ্ভূত প্রকাশের ইতিহাস বিশ্বজনীন। সামু ব্লগে আমি “আমার কথা” নামে একটা সিরিজ লিখেছিলাম। সেখান থেকে কিছুটা অংশ এখানে তুলে ধরছি। সিরিজটি ২০১৬ সালের বই মেলায় “জীবনের জার্নাল” নামে বই আকারে আত্মপ্রকাশ করেছিলঃ
“আমাদের স্কুলের পাশেই ছিলো সেন্ট্রাল গভঃ গার্লস হাই স্কুল। পাশাপাশি দুটো স্কুল একই বেষ্টনী প্রাচীর দ্বারা বিভক্ত ছিলো। তবে উভয় স্কুলের জন্য ছিলো একটাই কমন অডিটোরিয়াম। নজরুল-রবীন্দ্র জয়ন্তী ও ইত্যাকার অনুষ্ঠানাদি এলে বড়ভাইদের দেখতাম খুব আগ্রহভরে অপেক্ষা করতেন কখন ক্লাস শেষে অডিটোরিয়ামের দরজা খুলবে। সেখানে তারা আপুদের সাথে একসাথে রিহার্সাল করতেন। বলাই বাহুল্য, এসব করতে গিয়ে তাদের কারো কারো মধ্যে প্রেমের প্রথম পাঠও নেয়া হয়ে যেতো। এ তথ্য প্রকাশ পেতো এখানে সেখানে এর ওর মুখে আলোচনার মাধ্যমে। যারা লাইলী মজনু বা শিরি ফরহাদের মত হয়ে উঠতো, তাদের নামগুলি জ্বলজ্বল করে কে বা কারা বাথরুমের দেয়ালে কিংবা হেথা হোথা লিখে রাখতো প্লাস চিহ্নের মাধ্যমে। যেমনঃ জামিল+দিনা, সোনা+রূপা, খোকা+ নিরু ইত্যাদি। আমার এ লেখাটা পড়ে আমার এক পরিব্রাজক পাঠক আমায় জানিয়েছেন যে এই প্লাস(+) চিহ্নের ব্যাপারটা নাকি বিশ্বজনীন। তিনি বিশ্বের আরো অনেক দেশে এমনকি ইউরোপেও এর অনুরূপ ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছেন। ‘মিউনিখের অলিম্পিয়া টাওয়ারেও দেখেছি এই প্লাস চিহ্ন। প্রেমের ভাষা সার্বজনীন’ – তিনি আমায় জানিয়েছেন। আমি ভেবেছিলাম, প্লাস চিহ্নের ব্যাপারটা শুধু বাংলাদেশেরই কালচার। তার দেয়া তথ্য জেনে আমার সে ভুল ভাঙলো। অবশ্য আমিও আমেরিকায় বেড়াতে গিয়ে নিউ ইয়র্ক এরHowes Cave এর সুগভীর গুহার ভেতরেও প্লাস চিহ্নে আবদ্ধ কিছু নাম উৎকীর্ণ থাকতে দেখেছি”।
উপরের এই অধ্যায়টি পড়ে এই ব্লগেরই একজন পাঠক তার স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবেঃ “প্লাস দিয়ে নিজের নামের সাথে ‘প্রস্তাবিত’ প্রেমিকার নামও লেখা হতো। নব্বইয়ের দশকে মোহাম্মদপুরের আসাদগেট সংলগ্ন রাস্তার একটি দেয়ালের লিখন আমাকে স্পর্শ করেছিল। ‘পুষ্পা তুমি আমার!’ কী আবেদন! জানি না, পুষ্পা তার হয়েছিল কি না, অথবা সে কোথায় এখন আছে! কিন্তু কথাগুলো আজও আমার মনে আছে”।
যাহোক, আমি সেদিন বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম। কারণ, অর্ধেক দিন চলে গেছে, অথচ আমরা তখনো হোটেলেই পৌঁছতে পারলাম না। এ কথা ভাবতে ভাবতেই দেখি শাফি রাস্তা ছেড়ে বামে ঘুরে একটা দোতলা বাড়ীর সামনে এসে গাড়ী থামালো। বুঝলাম, এটাই আমাদের আজকের নিবাস- “গোল্ডেন রেসিডেন্স”। শাফি মালপত্র নামিয়ে দিল। আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম।
চলবে......
ঢাকা
০৮ জুন ২০১৯
ছবিতে আমের খান মাঝখানে।
ফ্রেশ এ্যাপেল জ্যুস
ঝিলাম নদী
গাড়ী থেকে তোলা ঝিলাম নদীর ছবি
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৯ বিকাল ৩:১১