somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেলবোর্নের দিনলিপিঃ ঘরে ফেরা, অনিশ্চিত পথে.... (৩)

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এর আগের পর্বটি দেখতে পাবেন এখানেঃ মেলবোর্নের দিনলিপিঃ ঘরে ফেরা, অনিশ্চিত পথে.... (২)

অবশেষে আমাদের “স্বাস্থ্য পরীক্ষা”র জন্য ডাক এলো। আমাদের পিছে পিছে সেই চীনা সাহায্যকারী মহিলাও ছিলেন। তিনি কাছাকাছি আছেন দেখে একটু ভরসা পাচ্ছিলাম। আমি আর গিন্নী পাশাপাশি দুটো টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে উপবিষ্ট হ’লাম। দুটো টেবিলেরই ওপারে চীনা স্বাস্থ্য দপ্তরের দু’জন নারী বসা। আমরা আমাদের পাসপোর্ট এবং সাথে থাকা অন্যান্য কাগজপত্র মেলে ধরলাম। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলাম, তাদের কাছে রক্ত নেয়ার কোন সরঞ্জামাদি আছে কিনা। দেখলাম, নেই। ভাবলাম, এখান থেকে ওনারা হয়তো আমাদেরকে কোন মেডিকাল ইন্সপেকশন রুমে পাঠাবেন। ওনারা স্পষ্ট ইংরেজীতে আমাদেরকে কিছু মৌখিক জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। কোন করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এসেছি কিনা জিজ্ঞেস করলেন। গত ১৪ দিন কোথায় কোথায় ছিলাম, তা জানতে চাইলেন। তারপর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে যেতে বললেন। সেই কাগজটিতে চীনা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজীতে লেখা ছিলঃ “The passenger has passed quarantine procedure”। জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যাবো? নিকটস্থ দাঁড়ানো একটা লোককে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ওদিকে। যাবার আগে চারিদিকে তাকিয়ে সেই চীনা সাহায্যকারী মেয়েটাকে খুঁজলাম, কিন্তু কোথাও তার দেখা পেলাম না। দুঃসময়ে তার কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যের ঋণ জীবনে ভোলার নয়। ঠান্ডা, শান্ত শিষ্ট আচরণের সেই মেয়েটি আমার অন্তরে একজন স্নেহাস্পদের আসন গড়ে নিয়েছিল। তাকে অন্ততঃ মৌখিকভাবে একটা ধন্যবাদ জানাতে পারলে শান্তি পেতাম, অন্তরে তো বহুদিন তার জন্য দোয়া থাকবেই। জীবনে চলার পথে আমরা এমনিভাবে কতজনের সাথে দয়ামায়া, স্নেহভালবাসা, সাহায্য-সহমর্মিতার ঋণে আবদ্ধ হয়ে যাই, অথচ তার জন্য কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়না, কৃতজ্ঞতাবোধটুকুও অপ্রকাশিতই রয়ে যায়!

ট্রান্সফার ডেস্ক হয়ে আমরা চেক-ইন কাউন্টারের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম। টিমটিমে আলোয় দেখতে পেলাম, কাউন্টারে একজন নারী এবং একজন পুরুষ তাদের ল্যাপটপ খুলে বসে আছেন। আমরা পুরুষটির দিকে অগ্রসর হ’লাম। উনি আমাদের পাসপোর্ট এবং বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে অদূরে রাখা চেয়ারে বসতে বলে ল্যাপটপে মনোনিবেশ করলেন। ওনার ভাবসাব দেখে মনে একটা ক্ষীণ আশার সঞ্চার হলো, হয়তো কানেক্টিং ফ্লাইটটা ডিলেয়েডও হতে পারে, উনি হয়তো ল্যাপটপে আমাদের তথ্য সংযোজন করছেন। একটু পরে উনি আমাদের ডেকে বললেন, আপনারা একই ফ্লাইটে যাবেন, কিন্তু ৪৮ ঘন্টা পর। আপনাদের আজকের যে ফ্লাইটে যাবার কথা ছিল, সেটা এখন আকাশে, ঢাকার পথে। ফ্লাইট মিস হতে পারে, সেটা মাথায় ছিল, কিন্তু ৪৮ ঘন্টা বিরতির কথা শোনার পর মাথায় নতুন করে বজ্রাঘাত হলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমরা এখন কোথায় থাকবো? উনি বললেন, এয়ারপোর্ট ট্রাঞ্জিট লাউঞ্জে, সেখানে চায়না সাউদার্ন এর জন্য আলাদা জায়গা চিহ্নিত করা আছে, সেখানেই আপনারা থাকবেন। আমি বললাম, যেহেতু আমাদের কোন ত্রুটির কারণে আমরা ফ্লাইট মিস করিনি, সেহেতু এ পরিস্থিতিতে আমাদের খাওয়া দাওয়া এবং হোটেল ব্যবস্থা তো এয়ারলাইনেরই করার কথা। উনি বললেন, জ্বী তা করার কথা এবং আপনি চাইলে তা আমরা করতেও পারি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে হোটেলগুলো সব বিমানবন্দরের বাইরে অবস্থিত। ভেতরেও একটা ট্রানজিট হোটেল ছিল, কিন্তু চীন সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী সেটাকে কোয়ারেন্টাইন হসপিটালে পরিণত করা হয়েছে। এয়ারপোর্টে যেসব যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাদেরকে সেখানে চিকিৎসা দেয়া হয়। আর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোন যাত্রী একবার বিমান বন্দরের বাইরে গেলে ১৪ দিন হেলথ কোয়ারেন্টাইনে কাটানোর আগে তিনি আবার বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে পারবেন না। এখন আপনিই ঠিক করুন আপনি কোথায় থাকবেন। দিস ইজ স্পেশাল সিচুয়েশন, ইউ সী!

বুঝলাম, গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়েছি। পরবর্তী ৪৮ ঘন্টা এয়ারপোর্টে কাটাতে হবে শুনে গিন্নীও মুষড়ে পড়লেন। সেটা দেখে আমিও অনেক দুর্বল বোধ করতে থাকলাম। মনে মনে আবার সেই আপ্তবাক্য আওড়ালাম, “carpe diem”, “carpe diem”! গিন্নীকে প্রবোধ দিতে থাকলাম, এ মুহূর্তে মন শক্ত করো। মন ভেঙে পড়লে শরীরও অচিরেই ভেঙে পড়বে, তাতে সমস্যা জটিল আকার ধারণ করবে। লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের খাওয়া দাওয়ার কী ব্যবস্থা? উনি বললেন, আমি দুঃখিত যে এ মুহূর্তে আমাদের মীল টাইম অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। সুতরাং আজ রাতের জন্য কোন মীল দিতে আমরা অপারগ। তবে আপনি যেখানে থাকবেন, সেখানে স্ন্যাক্স জাতীয় কিছু খাদ্য এবং পানীয় সব সময়ের জন্য ফ্রী পাওয়া যাবে। আগামীকাল এবং পরশু আপনাদেরকে লাঞ্চ এবং ডিনার সার্ভ করা হবে, কোন ব্রেকফাস্ট নয়। কথা পরিস্কার, তাই পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও আপাততঃ আশ্বস্ত হ’লাম। লোকটা ওয়াকি টকিতে একজন নিরাপত্তা কর্মীকে ডেকে এনে বললেন, ওনাদের ক্যারী-অন লাগেজগুলো পুনরায় স্ক্রীনিং করিয়ে নাও। এ কথা শুনে মনে পড়ে গেল, মেলবোর্নে চেক-ইন করার সময় কাউন্টারের মহিলা আমাকে চেক-ইন লাগেজের ট্যাগগুলো বোর্ডিং পাসের সাথে আটকে দিয়ে বলেছিলেন, এগুলো সরাসরি ঢাকায় চলে যাবে। গুয়াংঝুতে আপনার এসব খোঁজ করার প্রয়োজন নেই। মনে শঙ্কা জাগলো, লাগেজগুলো যদি ঢাকায় চলে যায়, তবে সেগুলো আনক্লেইমড লাগেজ হিসেবে লাগেজ কোয়ারেন্টাইনে চলে যাবে। পরে সেখান থেকে সেগুলোকে পুনরুদ্ধার করা আমার জন্য জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। আমি মনে এই শঙ্কা নিয়ে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের চেকড-ইন লাগেজগুলোর কী হবে? উনি আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ওগুলো এখানেই থাকবে এবং আপনার সাথে একই ফ্লাইটে যাবে। কিন্তু কেন যেন আমি তার এ আশ্বাসের উপর ভরসা রাখতে পারলাম না। মনে হলো, উনি আমাকে বুঝ দেয়ার জন্যেই এ কথাগুলো বলেছেন।

সেই নিরাপত্তা কর্মীর পিছু পিছু হেঁটে আমরা পুনরায় একটি তল্লাশী এলাকায় প্রবেশ করলাম। সেখানে আমাদের হ্যান্ড লাগেজ এবং আমাদের দেহ তল্লাশী করা হলো। তারপরে আমাদেরকে আরেকজন মহিলা নিরাপত্তা কর্মীর কাছে হস্তান্তর করা হলো। উনি আমাদের বোর্ডিং পাস চাইলেন। সেগুলো তিনি তার হাতে নিয়ে আমাদেরকে অনুসরণ করতে বললেন। আমরা ট্রানজিট এরিয়াতে চলে এলাম। সেখানে দায়িত্ব পালনরত আরেকজন মহিলার কাছে তিনি আমাদের বোর্ডিং পাস দুটো এবং আমাদেরকে হস্তান্তর করে উনি চলে যাচ্ছিলেন। আমি ওনাকে আমাদের বোর্ডিং পাস দুটোর কথা জিজ্ঞেস করলাম। উনি বললেন, ও দুটো কাউন্টারে রক্ষিত থাকবে। আমি কাউন্টারের মহিলার দিকে তাকালাম। উনিও একই কথা বলে আমাকে আশ্বস্ত করলেন। তারপর উনি আমাদেরকে ফিতে দিয়ে ঘেরা একটি এলাকার ভেতর প্রবেশ করিয়ে দিয়ে বললেন, আপনারা এ দু’দিন এখানেই থাকবেন। আর এ এলাকার প্রবেশ মুখে ২৪ ঘন্টা আমি অথবা আমাদের কোন স্টাফ থাকবে। আপনাদের যে কোন প্রয়োজনে আমাদেরকে জানাবেন, আমরা যথসাধ্য চেষ্টা করবো আপনাদেরকে সাহায্য করতে। কিছু রিক্লাইনিং ইজী চেয়ার দেখিয়ে বললেন, আমি জানি আপনারা ক্লান্ত। এসব চেয়ারে বসে চেয়ারের সাথে সংযুক্ত মেশিন দিয়ে আপনারা ব্যাক, নেক এবং কাফ মাসল ম্যাসেজ করিয়ে নিতে পারবেন, তবে তার জন্য একটা QR Code আপনাদের সেলফোনে কপি করে নিতে হবে। আমি তাকে বললাম, অন্য কোন কিছুর আগে এখন আমার প্রয়োজন ওয়াই ফাই সংযোগ। এখানে দেখলাম যে লেখা আছে ফ্রী ওয়াই ফাই সংযোগ পাওয়া যাবে, কিন্তু আমি তো পাচ্ছি না। উনি একটা কাউন্টার দেখিয়ে বললেন, ওখান থেকে আগে পাসপোর্ট স্ক্যানিং করিয়ে আনতে হবে। আমি জানি, আমার জন্য এসব ঝামেলার ব্যাপার, তাই আমি এ ব্যাপারে তার সাহায্য চাইলাম। উনি হাসিমুখে তা করে দিলেন। আমার দেখাদেখি গিন্নীও তার সেলফোনটা এগিয়ে দিলেন। মহিলা আমার কাছ থেকে তার পাসপোর্ট টা চেয়ে নিয়ে তারটাও করে দিলেন। আমরা উভয়ে আমাদের সেলফোনে ওয়াই-ফাই সংযোগ পেলাম।

ওয়াই-ফাই সংযোগ পাবার পর গিন্নী ভেবেছিলেন, যতক্ষণ ঘুম আসবেনা, ততক্ষণ তিনি অন্ততঃ ফেইসবুকিং করে সময় কাটাতে পারবেন। কিন্তু উনি তো জানতেন না যে চীনে ফেইসবুক, হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবার, মেসেঞ্জার, সবই অচল। আমি তা জানলেও ঐ মুহূর্তে সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা দু’জনেই এসব ব্যবহার করতে গিয়ে ব্যর্থ হ’লাম। তখন আমার স্মরণ হলো যে এসব এখানে ব্যবহার করা যাবেনা। গিন্নীকেও তা জানালাম। ইতোমধ্যে কাউন্টারের স্টাফ এর শিফট পরিবর্তন হলো। প্রথমে যিনি ছিলেন, তিনি ভাল ছিলেন, খুব হেলপফুল ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, তার সাথে ইংরেজীতে কমিউনিকেট করতে কোনই অসুবিধে হচ্ছিল না। পরে যিনি এলেন, তিনি ওনার তুলনায় একটু গম্ভীর প্রকৃতির। আমার সেলফোনের চার্জ শেষ হয়ে এসেছিল। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় চার্জ দেয়া যাবে। উনি দূরে কয়েকটি চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ওখানকার চেয়ারগুলোর হাতলের নীচে প্লাগ-ইন এর ব্যবস্থা রয়েছে। আমি সেখানে গিয়ে দেখলাম, একটাতেও আমার প্লাগ ফিট হচ্ছেনা। ফিরে এসে ওনাকে বললাম। উনি উঠে আমাকে নিয়ে আবার সেখানে গেলেন। উনি নিজেও চেষ্টা করে দেখলেন, কিন্তু ফিট করতে পারলেন না। তখন উনি বুদ্ধি করে প্লাগ থেকে আমার USB Port টা খুলে শুধুমাত্র USB Port লাগানোর জন্য একটি কানেকশন পয়েন্টে সেটা লাগিয়ে দিলেন। পরে আমি নিজেই কিভাবে সেটা লাগাবো, সেটাও দেখিয়ে দিলেন।

ফোন চার্জ করে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ইন্টারনেট ব্রাউজিং এ মনোনিবেশ করলাম। কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না বলে ভাল লাগছিল না। ই-মেইল খোলার সাথে সাথে ঢাকা থেকে ছোট ছেলের পাঠানো একটি মেইল পেয়ে বোধোদয় হলো যে অন্ততঃ এখান থেকে ই-মেইলে সবার সাথে যোগাযোগ করা যাবে। ছেলে মেইলে একটা ছবি সংযুক্ত করে লিখেছে (বঙ্গানুবাদ), “বাবা, এটা আমার কলীগ রাফিদ এর WeChat এর একটা QR Code, চীনে সবাই কমিউনিকেশন এর জন্য এই এ্যাপ টা ব্যবহার করে। তুমি কারো সাহায্য নিয়ে এই কোডটা স্ক্যান করে আমার কলীগের সাথে প্রয়োজনে WeChat এ যোগাযোগ করতে পারো”। আমি এর আগে QR Code কিংবা WeChat, কোনটার সাথেই পরিচিত ছিলাম না। অগত্যা আবার সেই কাউন্টারের মহিলার সাহায্য চাওয়া! ওনার কাছে গিয়ে দেখি উনি নিজেও সেলফোনে কার সাথে যেন চ্যাট করছেন, এবং চীনে চ্যাট করার একমাত্র উপায় WeChat। ভেবেছিলাম, উনি বিরক্ত হবেন, কিন্তু না, উনি মোটেই তা হলেন না। উনি আমার সেলফোনটা চাইলেন, অনেকক্ষণ ধরে এটা ওটা করে অবশেষে ফোনটি আমার হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, আপনারটা আই-ফোন। আই-ফোনে কিছু সমস্যা হয়, কোডটার সাথে কানেক্ট করতে পারলাম না। আমি বিফল মনোরথ হয়ে আমার জায়গায় ফিরে এলাম।

একটু পরে সেই মহিলা হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে এলেন। আমাকে জানালেন, আমার মেইল থেকে তিনি কোডটা ট্রান্সফার করে ওনার নিজের সেলফোন থেকে কানেক্ট করার চেষ্টা করছিলেন এবং কেউ একজন কলটা ধরেছেন। এই বলে উনি ওনার ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি এক অপরিচিত মুখ দৃশ্যমান। হ্যালো হ্যালো করতেই উনি সালাম দিয়ে বললেন, আঙ্কেল আমি আপনার ছেলের বন্ধু রাফিদ। ছেলের বল্ধু বলাতে আমি তাকে তুমি করেই সম্বোধন করে সংক্ষেপে আমার বৃত্তান্ত বললাম এবং সেসব তথ্য আমার ছেলেকে জানিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। সে বললো, ঠিক আছে আঙ্কেল আমি অবশ্যই তাকে বলবো, কিন্তু আপনি একটু অপেক্ষা করেন, আমি ওর সাথে কানেক্ট করার চেষ্টা করছি। আমি ফোনটা ধরে থাকলাম, একটু পরেই আমার ছেলের কন্ঠে “হ্যালো বাবা” ডাকটা শুনতে পেলাম। সেই সাথে ওর চেহারাটাও ফোনের পর্দায় ভেসে উঠলো। ওর চেহারাটা দেখে এবং ওর সাথে কথা বলে জানটা ঠান্ডা হলো। হোয়াটসএ্যাপে আমাদের একটা ফ্যামিলী গ্রুপ আছে, যেটার মাধ্যমে আমরা একে অপরের সাথে কানেক্টেড থাকি। আমি ওকে সবিস্তারে সব বৃত্তান্ত জানিয়ে বললাম কথাগুলো ফ্যামিলী গ্রুপে জানিয়ে দিতে, যেন ছেলেরা, বৌমারা, সবাই সবকিছু জানতে পারে। বিশেষ করে মেলবোর্নে থাকা ছেলেকে যেন সে রাতেই ফোন করে জানিয়ে দেয়, কারণ আমি জানি ওখানে তখন প্রায় শেষরাত হলেও ওরা দু’জনেই আমাদের একটা খবর পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে জেগে থাকবে। পরে জেনেছি, সে রাতে কথা বলার সময়ে আমার ছোট ছেলে কোনরকমে আমার ছবির একটা স্ক্রীনশট নিয়েছিল। সে ছবিটাতে আমার পুরো মুখ আসেনি, চুল থেকে নাকের নীচ পর্যন্ত এসেছিল। ও সেটাই ফ্যামিলী মেইল গ্রুপে পোস্ট করেছিল। ঐ অর্ধেক মুখের ছবিটা দেখেই সবাই খুশী হয়েছিল এবং তার পরদিন সকালে দেখি ছেলেদের কাছ থেকে অনুরোধ এসেছে, ‘মায়ের ছবি পাঠাও’।

ছেলের সাথে কথা বলার পর মনে ভীষণ শান্তি অনুভব করেছিলাম। এই শান্তি শান্তি ভাব নিয়েই ইজী চেয়ারে বসে ঘুমাবার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। চেয়ারে বসে মনে হলো, চায়না সাউদার্নের সেই স্টাফের কথাটা- “আমি জানি আপনারা ক্লান্ত। এসব চেয়ারে বসে চেয়ারের সাথে সংযুক্ত মেশিন দিয়ে আপনারা ব্যাক, নেক এবং কাফ মাসল ম্যাসেজ করিয়ে নিতে পারবেন”। আমি ঊঠে কাউন্টারের মহিলার কাছে গিয়ে বললাম, আমরা চেয়ার-ম্যাসেজ নিতে চাই, কিন্তু QR Code এর সাথে পরিচিত নই। উনি একটুও বিরক্ত না হয়ে উঠে এলেন এবং ওনার ফোন দিয়ে দুটো চেয়ারের ম্যাসেজ মেশিন চালু করে দিলেন। ম্যাসেজ শেষে আমরা অনুভব করলাম, শরীরের ব্যথা বেদনা সব দূর হয়ে গেছে। আমরা যে জায়গাটায় ঘুমাবো বলে মনস্থির করলাম, সেটা একটা স্বচ্ছ কাঁচের দেয়ালের সংলগ্ন ছিল, যার বাইরেই এয়ারপোর্টের রানওয়ে, টারম্যাক এবং বোর্ডিং ব্রীজ টারমিনাল দেখা যায়। সারারাত চারিদিকে উজ্জ্বল আলো জ্বলে, প্লেন আসে, প্লেন যায়। আমার অবশ্য আলোতে ঘুমাতে মোটেই অসুবিধে হয় না, প্যান্ট শার্ট পরে ঘুমাতেও অসুবিধে হয় না, কিন্তু গিন্নীর কথা ভেবে চিন্তিত হচ্ছিলাম।

ট্রানজিট এলাকায় প্রবেশ করার পর থেকেই লক্ষ্য করছিলাম, একেবারে কাচের দেয়াল ঘেঁষে একটি জায়গায়, মেঝেতে একটি বিছানার চাদর বিছিয়ে দু’জন মহিলা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওনাদের সাথে কম্বল বালিশও ছিল, খুব সম্ভবতঃ ওনারা ব্যাকপ্যাকার। এলাকাটিতে চায়না সাউদার্নের এর সেই স্টাফ ছাড়া ওনারা দুইজন এবং আমরা দুইজন, এই চারজনই সে রাতে উপস্থিত ছিলাম। মহিলা দু’জনের একজন মধ্যবয়স্কা, তিনি শ্বেতাঙ্গিণী, ককেইশান। তার সাথের জনের বয়স আনুমানিক ২৫/৩০ এর মধ্যে হবে, কিন্তু তিনি শ্যামাঙ্গিণী। যেহেতু আমরা সবাই একই মেঝেতে ঘুমাবো, আমরা দু’জনেই তাদের সাথে হ্যালো বলে পরিচিত হয়ে নিলাম। জানলাম, ওনারা আমেরিকান, যাবেন লস এঞ্জেলিস এ। ওনাদের ট্রানজিট ৩৪ ঘন্টার জন্য, যাবেন পরের রাত নয়টায়। ওনারা এতক্ষণ আমাদের দুর্গতির কথা কান পেতে শুনছিলেন বলে মনে হলো, কারণ ওনারা আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনভাবে ওনারা আমাদেরকে সাহায্য করতে পারেন কিনা। আমি ধন্যবাদ দিয়ে না বলাতে ওনারা আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে খুবই আন্তরিকতার সাথে বললেন, আমরা যদি চাই, তবে ওনারা আমাদেরকে সে রাতের জন্য একটা কম্বল আর একটা বালিশ ধার দিতে পারেন। আমি ওনাদের এ কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ওনারা বলেন কি! করোনার ভয়ে সবাই ঘন ঘন হাত ধুচ্ছে, একে অপরের থেকে ৫/৬ ফুট দূরত্বে অবস্থান করছে, নাকে মুখে মাস্ক লাগাচ্ছে, হাতে গ্লাভস লাগাচ্ছে, আর ওনারা এই অপরিচিত দু’জন ভিনদেশীকে কম্বল আর বালিশ অফার করছেন? একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম তাদের এ প্রস্তাবের কথা শুনে। শুধু বিনয়ের সাথে না করলাম, কিন্তু যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারলাম না।

আমরা শুয়ে পড়লাম, অনেকক্ষণ পর হাল্কা ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। হঠাৎ শুনি, একটি পুরুষ কন্ঠ এবং দু’টি নারীকন্ঠ কথা বলছে। চোখ বন্ধ করেই তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, নতুন ট্রানজিট যাত্রী এসেছে। ওদের কথাবার্তা শুনে গিন্নীও জেগে গিয়েছিলেন। একটু পরে ওনারা মেঝেতে শুয়ে পড়লেন, মহিলা দু’জন পাশাপাশি, পুরুষটি একটু দূরে। গিন্নী আমাকে জেগে থাকতে বলে ওযু করতে গেলেন। পুরুষটি খানিক পর আমার কাছে উঠে এসে বললেন, ওনারা অস্ট্রেলিয়ান, এসেছেন ক্যাম্বোডিয়া ও লাওস সফর করে, যাবেন সিডনীতে, পরের দিন রাত সাড়ে নয়টায়। ওনার স্ত্রীর ঠান্ডা লাগছে। ঠান্ডা লাগলে ওনার নাক দিয়ে পানি পড়ে, আর নাক দিয়ে পানি পড়লে ওনাদের পরের দিনের যাত্রা বাতিল হতে পারে। উনি অনুরোধ করে জানতে চাইলেন, আমরা ওনার স্ত্রীকে গলায় পেচানোর জন্য স্কার্ফ জাতীয় কোন কিছু দিয়ে সাহায্য করতে পারি কিনা। সম্ভবতঃ আমার স্ত্রীর মাথায় হিজাব দেখে তিনি অনুমান করেছিলেন, তার কাছে এক্সট্রা স্কার্ফ থাকতে পারে। আমি তাকে বললাম, আমার স্ত্রী ওয়াশরুমে গেছেন। উনি ফিরে এলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো। যদি থাকে, তবে অবশ্যই দিব। গিন্নী ফিরে এলে আমি তার কাছে কথাটা পাড়লাম। উনি বললেন, দেখো, লস এঞ্জেলিসের সেই মহিলা দু’জন আমাদেরকে কম্বল ও বালিশ পর্যন্ত দিতে চেয়েছিলেন, আর এনারা তো শুধু একটা স্কার্ফ চাচ্ছেন। কোন ব্যাপার না, এই বলে তিনি সাথে থাকা ক্যারী অন লাগেজ থেকে একটা স্কার্ফ বের করে আমাকে বললেন, যাও দিয়ে আসো। আমি ভদ্রলোককে ডেকে সেটা তাকে দিলাম। উনি অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সেটা নিয়ে গিয়ে তার ঘুমন্ত স্ত্রীর গলা থেকে বুক পর্যন্ত ঢেকে দিলেন। চরম দুঃসময়ে এসব ছোট ছোট মানবিকতার স্মৃতি আমার সঞ্চয়ে জমা হতে থাকলো, যা আমি আমার পাঠকদের জানানোর ইচ্ছে সংবরণ করতে পারলাম না।


ঢাকা
০৪ এপিল ২০২০
শব্দসংখ্যাঃ ২২৪৬


আমাদের ট্রানজিট অবস্থান থেকে ইজী চেয়ারে বসে কিংবা শুয়ে থাকলে মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে মোটা কাঁচের দেয়ালের বাইরের এসব দৃশ্য দেখতাম। সারা দিন, সারা রাত ধরে বিভিন্ন আকার ও প্রকারের প্লেন আসতো, যেত। বোর্ডিং ব্রীজে লাগানো চায়না সাউদার্নের এই সম্মুখের প্লেনটির ভ্যাকুয়াম ক্লীনিং চলছিল। প্লেনটি রাতে অকল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।


এসব চেয়ারে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতাম, একই সাথে সেলফোনের সাহায্যে কিউ আর কোড দিয়ে চেয়ারের ডান হাতলে রাখা ঐ ছোট্ট মেশিনটি চালু করে ঘাড়, পিঠ কোমর এবং পায়ের কাফ মাসল ম্যাসেজ করানো যেত।


পিপিই (PPE) পরিহিত সম্পূর্ণ সুরক্ষিত বাইয়ুন বিমানবন্দর, গুয়াংঝু এর স্টাফ।


একজন মুসাফির


শত ক্লান্তির মাঝেও এদের নির্মল হাসি মনকে প্রফুল্ল করতো।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০২০ সকাল ৭:১২
২৪টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×