somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্লগের ছবি দেখে মনের ছবি ভেসে ওঠে....

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(সেদিনের আসন্ন সন্ধ্যায়, অস্তগামী সূর্যের ম্লান আলোতে আমাদের স্টীমারের সমান্তরালে সেই লোকগুলোর ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলার দৃশ্যটি আমার মনে আজও গেঁথে আছে)


("রেলসেতু বসলো যখন যমুনার 'পরে,
বোনারপাড়াও গেল হারিয়ে চিরতরে!")


‘পাগলা জগাই’ ওরফে ‘মরুভূমির জলদস্যু’ এ ব্লগের একজন জনপ্রিয় ব্লগার। উনি অধুনা ব্লগে বেশ ঘন ঘন খুব সুন্দর সুন্দর ছবি পোস্ট করছেন, মন্তব্য/প্রতিমন্তব্যও করে যাছেন প্রায় নিয়মিতভাবে। গত পরশুদিন ওনার “নদী ও নৌকা-০৫” নামে একটা পোস্ট পড়ার সময় একটা ছবির দিকে আমার দুটো চোখ অনেকক্ষণ আটকে থাকে। এ রকম আমার অনেক সময়ই হয়। কোন ছবি দেখে, কোন কবিতা বা গল্প পড়ে নিজের দেখা অনেক ছবির কথা মনে ভেসে ওঠে। ওনার ছবিটা নিয়ে এবারে আমার মনে একের পর এক যে ছবি ও স্মৃতিগুলো ভেসে উঠেছিল, তা নিয়েই আমার আজকের এ পোস্ট।

১। দ্য ব্রীজ অন দ্য রিভার কাওরাইদঃ বুঝতেই পারছেন, এ লাইনটা বিখ্যাত মুভি “দ্য ব্রীজ অন দ্য রিভার কাওয়াই” এর অনুকরণে লিখলাম, যা নিয়ে ব্লগার জুন সেই ২০১০ সালে তার নিজ নামের নামে যে মাস, সে মাসে একটি সুন্দর পোস্ট লিখেছিলেন। কিন্তু আমার এ নাম দেয়াটা বোধহয় সঠিক হলোনা, কারণ আমার এ লেখায় বর্ণিত নদীটির নাম ‘কাওরাইদ’ নয়, সেটির নাম “সুতিয়া”, যদিও যে জায়গায় রেলসেতুটি অবস্থিত, সে জায়গাটির নাম ‘কাওরাইদ’। যাহোক, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে তোলা পাগলা জগাই এর উল্লেখিত পোস্টের প্রথম ছবি “সুতিয়া নদীতে জলবাস” ছবিটা দেখে আমার যেসব স্মৃতির কথা এক এক করে মনে পড়ে গেল, তা হচ্ছেঃ

মধ্য ষাট থেকে মধ্য সত্তরের দশকে ঢাকা থেকে রাতের “৭ আপ, নর্থ বেঙ্গল মেল” ট্রেন ধরে বছরে কয়েকবার বাড়ী যাওয়া আসা করতাম। সে ট্রেনটি "কাওরাইদ" ক্রস করতো মধ্যরাতে, বারটা একটার দিকে। কাওরাইদ স্টেশন এবং ব্রীজ পার না হওয়া পর্যন্ত ঘুমাতাম না, এর একটা কারণ ছিল। একবার কাওরাইদ ব্রীজ পার হবার সময় ট্রেনটা সেতুর উপর কিছুক্ষণ থেমে থেকে খুবই ধীর গতিতে চলা শুরু করেছিল, অনেকটা পায়ে হাঁটার গতিতে। আমি জানালা খুলে ট্রেন থেকে দেখছিলাম কৃষ্ণপক্ষের নিশুতি রাতের নদীর আবছা ছবি। নদীর পাড়ে বাঁধা ছিল কিছু নৌকো, ঘন অন্ধকারে কেউ একজন একটা কুপি জ্বালিয়ে কী যেন খুঁজছিল। সেখান থেকে মানুষের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল, ট্রেনটি থেমে থাকা অবস্থায় রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আরো শোনা যাচ্ছিল খুক খুক কাশির শব্দ। অনেকটা ‘স্মোকার্স কাফ’ এর মত। সম্ভবতঃ সেগুলো ছিল বেদে-বেদেনীর নৌকো, যা এখন প্রায় বিলুপ্ত হলেও, তখন প্রায়শঃ দেখা যেত। হয়তো বেদের নৌকোগুলোর পাশে আরও ছিল মধ্যরাতে মাছ ধরতে আসা কিছু জেলেদের নৌকোও। শুনেছি পূর্ণিমা এবং অমাবস্যার রাতে কিছু জায়গায় মাছেরা ঝাঁক বেঁধে থাকে। যুত মত জাল ফেলতে পারলে সে সময়ে এক রাতের চেষ্টাতেই অনেক লাভ হয়ে থাকে। বেদে এবং জেলেদের সে ছবিটা এখনো মনে গেঁথে আছে। বেদে বেদেনীর যাপিত জীবন নিয়ে নানা রকমের কল্পনা তখন মাথায় চেপেছিল। যদি ওদের সাপগুলো কখনো কামড়ে দেয়? এই সাপের বাক্স নিয়ে ওরা কেমন করে সাড়াটা জীবন নৌকোয় কাটিয়ে দেয়? নৌকোয় জন্ম হওয়া, নৌকোয় বড় হওয়া, নৌকোয় করে সারাটা জীবন নদীর বুকে বুকে ভেসে বেড়িয়ে ঘর-সংসার করা, রান্না বান্না খাওয়া দাওয়াসহ জীবনের যাবতীয় চাহিদা মেটানো, ইত্যাদি ভাবনা আমাকে বেশ আলোড়িত করতো। এর পরে যখনই রাতের ট্রেন কাওরাইদ সেতু অতিক্রম করতো, আমি সেই সেতুর নীচে জীবন ধারণের সে দৃশ্যগুলো খুঁজতাম।

২। বাবুরাম সাপুড়েঃ সময়টা ছিল ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর আমরা সপরিবারে ট্রেনে করে দেশের বাড়ী যাচ্ছিলাম। ট্রেনের নাম “দ্রুতযান এক্সপ্রেস”, ঢাকা থেকে সকাল আটটায় ছাড়তো। আব্বা আম্মাসহ আমরা পাঁচ ভাইবোন যাচ্ছিলাম। ভাই বোনদের মধ্যে সবার বড় ছিল আমার বড় বোন, আমি ছিলাম দ্বিতীয়। আনুমানিক দুপুর দু’টার দিকে ট্রেনটা জামালপুরের ইসলামপুরে পৌঁছেছিল। আমরা জানালা দিয়ে দেখছিলাম, ট্রেন থেকে নেমে অনেক মানুষ বিস্তীর্ণ মেঠো পথ ধরে নিজ নিজ গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন। সদ্য লাঙল-কর্ষিত জমিগুলোতে তখনও বড় বড় মাটির ঢেলা ছিল, কৃষকেরা একটি বিশেষ ছন্দে কাঠের দুরমুশ দিয়ে একবার ডান থেকে বামে, আরেকবার বাম থেকে ডানে হাত চালিয়ে ঢেলাগুলো ভাঙছিলো। একটা সরু আ’ল ধরে মাথায় গামছা পেঁচানো একজন কৃষক ঘাড়ে একটা বংশদন্ডের দু’প্রান্তে দুটো ডালাতে করে (সেই জিনিসটার নাম ভুলে গেছি, আমাদের এলাকার স্থানীয় ভাষায় ভার-বাঁকুয়া বলে) তার গৃহস্থালী সম্ভার (যেমন হাটে বিক্রয় করার সামগ্রী) বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমার ছোট বোনটা তখন কেবল ছড়ার বই পড়া শুরু করেছে। তার ছড়ার বই এ ঠিক ঐ ধরণের একটা মানুষের ছবি দিয়ে তার নীচে ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ কবিতাটি লেখা ছিল। সে ঐ লোকটার দিকে তাকিয়ে আঙল তুলে বলে উঠলো, “ঐ যে, বাবুরাম সাপুড়ে যাচ্ছে”!

৩। গুণ টানা নৌকোঃ আমাদের ট্রেনের লাইনের শেষ প্রান্তে ছিল বাহাদুরাবাদ ঘাট। সেখানে নেমে স্টীমারে উঠতে হতো, ঘন্টা তিনেক স্টীমার জার্নি করে অপরপ্রান্তে তিস্তামুখ ঘাটে পুনরায় ট্রেনে উঠতে হতো। বেশীরভাগ সময়ে স্টীমারে থাকতে থাকতেই সূর্য অস্ত যেত। শীতকালে নদীতে অনেক চর ভেসে উঠতো। পানির গভীরতা বুঝে কখনো মাঝ নদী দিয়ে আবার কখনো নদীর একেবারে তীর ঘেঁষে চালক মাস্টার স্টীমারটিকে চালিয়ে নিয়ে যেত। সেদিন লেইট লাঞ্চ করে আমি আর আমার বড় বোন সামনের খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা “আমি যা দেখি তুমি কি তা দেখো?” খেলছিলাম। স্টীমারটি তখন দ্বিতীয় পন্থায়, অর্থাৎ নদীর প্রায় তীর ঘেঁষে চলছিল। হঠাৎ দেখি, সেই তীরের উপর দিয়ে দু’জন লোক একটি মাল বোঝাই নৌকোকে গুণ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তাদের পেছনে পেছনে অন্য কয়েকজন লোক খালি হাতে হেঁটে যাচ্ছিল, সম্ভবতঃ একই গন্তব্যে। অনেকক্ষণ ধরে আমরা প্রায় একই লয়ে চলছিলাম, কালক্রমে যন্ত্রের কাছে পেশীর পরাজয় হয়, আমরা তাদের ছেড়ে অনেকদূর এগিয়ে যাই। সেদিনের আসন্ন সন্ধ্যায়, অস্তগামী সূর্যের ম্লান আলোতে আমাদের স্টীমারের সমান্তরালে সেই লোকগুলোর ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চলার দৃশ্যটি আমার মনে আজও গেঁথে আছে।

৪। ইঞ্জিনের ধাক্কাঃ তিস্তামুখঘাট থেকে আবার ট্রেনে করে রওনা হয়েছিলাম। বোনারপাড়া জংশনে এসে ট্রেনটা দু’ভাগ হয়। একভাগ সোজা শান্তাহারের দিকে যায়, অন্য একটি ইঞ্জিন এসে অপর প্রান্তে লেগে অপরভাগকে টেনে গাইবান্ধা হয়ে রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার যাত্রীদের নিয়ে অনেকটা উল্টো ডিরেকশনে চলে যায়। এই বোনারপাড়া জংশন নিয়ে আমি একটা কবিতাও লিখেছিলাম, যা লিঙ্কে দেখতে পাবেন। ইঞ্জিন ঘুরানোর কারণে ট্রেনটা বোনারপাড়া জংশনে অনেকক্ষণ থামে। ঐ বিরতিটুকুর সময় আব্বা ট্রেন থেকে নেমে একটি টী-স্টলে গিয়েছিলেন কিছু চা-নাস্তা নিয়ে আসার জন্য। আমাদের সবচেয়ে ছোট্ট ভাইটি তখন ছিল কোলের শিশু। আম্মা একটু হাত পা ঝাড়ার জন্য ওকে আমার বড় বোনের কোলে দিয়ে যেই না উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, অমনি ট্রেনটির ইঞ্জিন সজোরে ধাক্কা দিয়ে মেইন বডির সাথে সংযোজিত হয়েছিল। সেই ধাক্কার চোটে আপির কোল থেকে আমাদের ছোট্ট ভাইটি ট্রেনের ফ্লোরে পড়ে যায়। এটা দেখে সবাই ভয়ে আঁৎকে উঠেছিল, তবে সৌভাগ্য যে ভাইটি তেমন বড় আঘাত পায়নি, সামান্য একটু কান্নার পর সে থেমে গিয়েছিল। এর পরে যতবার আমি বোনারপাড়া জংশন ক্রস করেছি, ততবারই আমার সেদিনের সেই ঘটনাটির কথা মনে পড়েছে, এখনও মনে পড়ে।

ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

উৎসর্গঃ এ পোস্টের মূল অনুপ্রেরণা ‘পাগলা জগাই’ এর “সুতিয়া নদীতে জলবাস” শীর্ষক ছবিটি। এজন্য পোস্টটি সৌখিন চিত্রগ্রাহক, ব্লগার ‘পাগলা জগাই’ কে উৎসর্গ করা হলো। ছবিটি দেখার জন্য পাঠককে তার নদী ও নৌকা-০৫ পোস্টে যাবার জন্য অনুরোধ করছি।



ঢাকা
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
শব্দ সংখ্যাঃ১০২৩
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২৩ রাত ১২:৩৪
২৪টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×