কুউউউউ ঝিকঝিক....
আমার ছোটবেলা থেকে আমি বাড়ি থেকে ঢাকা কিংবা ঢাকা থেকে বাড়ি ট্রেনে করেই বেশি যাতায়াত করেছি। কারণ আমাদের বাড়ি থেকে সে সময়ে ট্রেনে যাতায়াতই সুবিধেজনক ছিল। সড়কপথে সুবিধে হয়েছে ১৯৯০ এর পর থেকে। সেই ছোটবেলা থেকেই সেজন্য ট্রেন জার্নি আমার খুবই প্রিয়। ট্রেনে শুধু যাতায়াত করাই নয়, এমন কি কাছে বা দূরে থেকে চলন্ত ট্রেনের ছুটে চলা দেখতে আমি ভালবাসতাম, এখনো ভালবাসি। আমাদের গ্রামের বাড়ির উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছিল 'বিন্যাগাড়ীর বিল'। সে বিলটিতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত এবং শীতকালে অসংখ্য পাখি এসে বসত বলে বিলটি সে সময়ে শিকারিদের কাছে বিখ্যাত ছিল, পছন্দনীয়ও ছিল। বিলের উত্তর প্রান্ত ঘেঁষে পূবে-পশ্চিমে লালমনিরহাট-বুড়িমারী রেল লাইন চলে গিয়েছে, সেটা দিয়ে প্রতিদিন ও রাত মিলিয়ে ৩টি ৩টি করে মোট ৬টি ট্রেন আপ-ডাউন করতো। ট্রেন আসার শব্দ পেলেই আমি বিলের এ প্রান্তে দাঁড়িয়ে পিলপিল করে চলা ট্রেনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। 'পিলপিল' করে যেত, কারণ কাছেই একটা স্টেশন ছিল। হয় ট্রেনগুলো স্টেশন থেকে ছেড়ে যেত, নয়তো স্টেশনে এসে থামতো। উভয় কারণে বিলের ওপারের স্থানটিতে ট্রেনের গতি খুব শ্লথ থাকতো। তাই সেগুলো ঠিক ছুটে চলতো না, বরং পিলপিল করে আসতো। কি মধুর সেসব স্মৃতি। এখন বিলটি ভরাট করে মানুষজন ঘরবাড়ি বানিয়েছে, বিলের উপর দিয়ে পাকা সড়ক চলে গেছে। সেই সাথে চিরতরে হারিয়ে গেছে 'মধুর সেসব স্মৃতি'!
রাতের বেলায় ট্রেনগুলো দেখতে বেশি সুন্দর লাগতো। বিলে পানি থাকলে ট্রেন চলাচলের শব্দ অনেক দূর থেকে/পর্যন্ত শোনা যেত। ঘন আঁধারের মাঝে নিকটস্থ বাঁশ ঝাড়ের ফাঁক ফোকর দিয়ে জোনাকি পোকার ঝিকিমিকি আলো দেখা যেত, আরেকটু দূরে পাটক্ষেতের কাছাকাছি শেয়ালের হুক্কা হয়া ডাক শোনা যেত। আরও কিছুটা দূরে বিলের জলের ওপারে শুধু আবছা স্কাইলাইনটা ছাড়া আর কিছু দেখা যেত না, কেবলমাত্র ট্রেন চলাচলের সময় ম্যাচবক্সসদৃশ ট্রেনের চলমান কামরাগুলোর আলোকিত জানালাগুলো এক এক করে চলে যেত, আর তা দেখে আমি মুগ্ধ হ’তাম, এবং সে মুগ্ধতা থেকে অনেক ভাবনা মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তো। এসব নিয়ে ভাবতে খুব ভালো লাগতো। রাত এগার/বারটার দিকে দিনের শেষ ট্রেনটি বুড়িমারীর দিকে যেত, ভোর পাঁচ/ছয়টার দিকে সেটা আবার ফিরে এসে লালমনিরহাটের দিকে যেত। এ দুটো ট্রেন চলার ঘরঘর শব্দ এবং ডিজেল ইঞ্জিনের ‘ভেঁপু’র আওয়াজ বিছানায় শায়িত থেকেই বেশিরভাগ সময় শুনতাম। ট্রেন চলে যাবার আধা ঘণ্টা খানেক পর আমাদের বাড়ির পাশের মাত্র পঞ্চাশ গজ দক্ষিণে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরে মহিষখোঁচা কিংবা পশ্চিমের অন্যান্য এলাকাগামী পায়ে হাঁটা কিংবা গরুরগাড়িতে আসীন যাত্রীদের গলার আওয়াজ শোনা যেত। তারা নানা রকমের গল্প করতে করতে পথ চলতো। গরুরগাড়ির গারোয়ানদের কেউ কেউ গলা ছেড়ে ভাওয়াইয়া গান গাইতে গাইতে চলে যেত। সে গানের সুরে আচ্ছন্ন হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম।
বাংলাদেশ রেলওয়েতে ডিজেল ইঞ্জিনের সংযোজন হয় ষাটের দশকে। উত্তরাঞ্চলের রেলওয়ে বিভাগগুলোতে তা যোগ হয় ষাটের দশকের শেষের দিকে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্তরের দশকের প্রথমেই। তার আগে ছিল বাষ্পীয় শকট, গনগনে আগুনে কালো কয়লাকে পুড়িয়ে সেই তাপশক্তি দিয়ে ইঞ্জিনের বয়লারের পানিকে বাষ্পে পরিণত করা হতো এবং সেই বাষ্পশক্তি দিয়ে ইঞ্জিনগুলো চলতো। ডিজেল ইঞ্জিন যেমন ভারী শব্দে ‘ভেঁপু’ বাজাতো, কয়লার ইঞ্জিনগুলো তেমনটা নয়। সেগুলো ‘হুইসেল’ বাজাতো কুউউউউ শব্দ করে। ট্রেন চলা শুরু করার আগে অবশ্যই এই হুইসেল বাজানো হতো, তারপরে আস্তে আস্তে বাষ্প ছেড়ে দিলে লোহার চাকার সাথে সংযুক্ত লিভারগুলো (Lever) সামনে পেছনে চলাচল করে ট্রেনের চাকায় গতি সঞ্চার করতো। এই আস্তে আস্তে বাষ্প ছাড়ার সময় ‘ঝিক ঝিক’ করে শব্দ হতো, সেই সাথে লোহার পাতের সাথে চাকার ঘর্ষণে সেই শব্দ আরও ঘনীভূত হতো। এর থেকেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে সেই ট্রেনগুলো ‘কুউউউউ ঝিকঝিক ট্রেন’ নামে পরিচিত ছিল। ডিজেল ইঞ্জিনের ‘ভেঁপু’র চেয়ে কালো ইঞ্জিনগুলোর এই ‘কুউউউউ ঝিকঝিক’ শব্দ মনটাকে অনেক বেশি করে টানতো। কয়লার ইঞ্জিন টানা এই কালো ট্রেনগুলো চলে যাবার পরেও ইঞ্জিন থেকে ছেড়ে দেওয়া কয়লার গুড়া মিশ্রিত কুণ্ডলীপাকানো কালো ধোঁয়া বাতাসে মিশে ভেসে ভেসে আমাদের নাকে এসে লাগতো। ট্রেন ভ্রমণের সময় জানালার বাইরে বের করা আমাদের মাথা আম্মা বারে বারে টেনে এনে ভেতরে ঢোকাতেন, যেন কয়লার গুড়ো আমাদের চোখে প্রবেশ করে কোন অঘটন না ঘটাতে পারে।
স্কুলে, খুব সম্ভবতঃ নবম/দশম শ্রেণীতে আমাদের পাঠ্য বইয়ে রবার্ট লুই স্টিভেনসন এর ‘ফ্রম আ রেলওয়ে ক্যারেজ’ (From a Railway Carriage, by Robert Louis Stevenson) কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কবিতাটি আমার খুবই প্রিয় ছিল এবং বহুপঠনে তা মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল, আজ অবধি তার অনেকাংশ মুখস্ত আছে। লুই স্টিভেনসন এর এ কবিতাটি ১৮৮৫ সালে তার “A Child’s Garden of Verses” নামক বই এ প্রকাশিত হয়। ট্রেনে উঠে চাক্ষুষ যেসব দৃশ্যাবলী আমি সে সময়ে দেখতাম, কবিতাটিতে সেসবই এক এক করে বিবৃত হয়েছে দেখে কবিতাটি এত ভালো লাগতো। একসময় কবিতাটি আমি অনুবাদও করেছিলাম, সেটা দেখা যাবে এখানেঃ
ট্রেনের কামরা থেকে (অনুবাদ কবিতা)
শুধু ট্রেনই নয়, চলমান যে কোন কিছুই দেখতে আমার ভালো লাগে। যেমন আকাশে ভাসতে ভাসতে মেঘপুঞ্জে ঢুকে যাওয়া কোন প্লেন, দূরের কোন হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলা যাত্রীবাহী বাস, পিকনিকের সীজনে মাইকে গান বাজিয়ে ছুটে চলা বাসের কাফেলা, নদীর বুকে পাল তোলা নৌকা, স্টীমার কিংবা লঞ্চ। সবই ভালো লাগে-- জীবন স্রোতের সাথে চলমান, জীবনবাহী যে কোন যান।
“গতির পিছু ধাওয়া করার সাধ্য আমার নেই।
মনটা পিছু নেয়, তাই গতিময় কিছু দেখলেই!”
ঢাকা
১০ সেপ্টেম্বর ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ৭৬০
ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট থেকে। তবে শেষের চারটে ছবি আমার ব্যক্তিগত ফটো আর্কাইভ থেকে নেয়া হয়েছে।
বহে সমান্তরাল....
- বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি বাঁক নেয়া চলমান ট্রেন, আমার ছোটবেলার আকর্ষণ। জানালা দিয়ে মাথা বের করে গুণতে চেষ্টা করতাম, মোট কয়টি বগী আছে। ভাইবোনদের মাঝে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো।
সংস্কারকৃত একটি রেলপথ.....
নীচের ছবি চারটে ২০১৭ সালের এক রোদেলা বিকেলে তোলা, ইউএসএ'র ওকলাহোমায়। বালক দু'জন আমার ভাতিজা।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৯:৫১