কোথাও কোন জানাযার নামাযে যোগদানের আহবান পেলে আমি তা পারতপক্ষে মিস করি না। চেনা হোক, কিংবা অচেনা কারো হোক, জানাযার নামায হবে শুনলেই আমি দাঁড়িয়ে যাই। আমাদের বাসার কাছে যে মাসজিদ আছে, সেটাতে প্রায়শঃই জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। মহল্লার মাসজিদ হিসেবে সেখানে যাদের জানাযা পড়ানো হয়, তাদের প্রায় সবাই পরিচিত মুখ হয়ে থাকে কিংবা তাদের নিকটাত্মীয় স্বজন। আর সেটা থেকে দূরে কোথাও হলেও, আমি চেষ্টা করি সময়মত সেখানে উপস্থিত হতে। গত চার সপ্তাহে অনেকগুলো (প্রায় ৮/৯টা) জানাযার নামাযে উপস্থিত হয়েছি, তার মধ্যে কেবলমাত্র একটি ছিল আমার নিকটাত্মীয়ের। বাকিগুলো ছিল সতীর্থ/তদীয় পত্নীদের, নিকট বন্ধুর অনুজ ভ্রাতার, এবং বাকিগুলো এলাকাবাসী এমন কারও বা তাদের পত্নীদের, যাদের সাথে একই এলাকাবাসী হয়ে থাকলেও জীবনে কখনো দেখা হয় নাই।
ছোটকাল থেকে একটা কথা শুনে এসেছি যে ‘নেক নিয়্যতে বরকত’। অর্থাৎ কোন ভালো কাজের নিয়্যৎ করলে সেটাতে অবশ্যই বরকত থাকবে। সম্প্রতি আমি দুটো জানাযার নামাযে যোগদানের ব্যাপারে এ কথাটার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছি। গত ১৬ অগাস্ট ২০২২ তারিখে এক নিকটবন্ধুর ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখলাম, সে ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে লিখেছে যে তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা, যে একজন নামকরা প্রকৌশলী ছিল, সে কয়েক ঘণ্টা আগে ইন্তেকাল করেছে। তার ব্রেন-স্ট্রোক করায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল, সে কথা আগেই বন্ধুর পোস্ট থেকে জেনেছিলাম। ছোটভাই এর অসুস্থতার খবর পেয়ে সে আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছিল ভাবীকে ছাড়াই, কারণ মাত্র কয়েক মাস আগেই ওরা দু’জনে বাংলাদেশে অনেকদিন ধরে বেড়িয়ে গিয়েছিল। আমি তখন অস্ট্রেলিয়ায় ছিলাম বলে তাদের সাথে এবারে দেখা হয় নাই। যাহোক, বন্ধু তার শোক ভারাক্রান্ত পোস্টে জানালো যে তার ভাই এর জানাযা অনুষ্ঠিত হবে ধানমণ্ডি ৭ নং রোডের ‘বায়তুল আমান মাসজিদ’ এ, সকাল এগারটায়।
সেদিন আমি ফজরের নামায পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এবং ঘুম থেকে ওঠারও এক ঘণ্টা পরে ল্যাপটপ খুলতেই বন্ধুর স্ট্যাটাসটা চোখে পড়লো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি হাতে সময় আছে এক ঘণ্টারও কম। অথচ আমার বাসা থেকে সকাল দশটায় এই কর্মদিবসের ভিড় ঠেলে বায়তুল আমান মাসজিদে যেতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা লাগার কথা। এদিকে আমার গাড়িটা সকাল নয়টায় আমার অনুমতিসাপেক্ষেই অন্য একটা ডিউটিতে নিয়োগ করা হয়েছে, সেটা ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হবে। ড্রাইভারকে সে ডিউটি থেকে কলব্যাক করলেও তার ফিরে আসতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে। অর্থাৎ, এটুকু সময়ে আমার গাড়িতে করে জানাযায় যোগদান করাটা অসম্ভব ব্যাপার। তবুও ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, উবার, সিএনজি যেটাই আগে পাই, সেটাতেই চেপে বসবো। হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপে আমাদের উভয়ের কিছু কমন বন্ধুর ফোননাম্বার ছিল। কাপড় পরতে পরতে প্রথম যাকে ফোন করলাম, সে জানালো যে সে ইতোমধ্যে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছে এবং সেদিন তার অফিসে না গেলে চলবে না। দ্বিতীয়জনকে করলাম, সে থাকে মিরপুর ডিওএইচএস এ। তার সাথে কথা বলে মনে একটু ভরসা জাগলো, দৈবক্রমে হলেও হয়তো আমার মনের আশাটা পূরণ হবে।
সেই বন্ধুটি জানালো, সে সকালে বার্তাটি দেখেছে। একবার সে ভেবেও ছিল যে জানাযায় যাবে। কিন্তু মোহাম্মদপুরে তার কিছু কাজ আছে বলে সে জানাযায় যাবার ইচ্ছা পরিত্যাগ করে মোহাম্মদপুরে যাবার জন্য ইতোমধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে নীচে নেমে গেছে, তক্ষুণি গাড়িতে উঠবে। আমার কল পেয়ে সে সিদ্ধান্ত পুনরায় বদলালো। প্রথমে জানাযায় যাবে-এতে একসাথে দু’জনের ইচ্ছে পূরণ হবে, পরে মোহাম্মদপুরে কিছুটা সময় থেকে ফেরার পথে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে, যদি না আমার মোহাম্মদপুরে কিছুটা সময় তার সাথে কাটাতে অসুবিধা না হয়। আমি ওর শর্তে রাজী হয়ে গেলাম। ওকে বললাম, আমার অসুবিধা হলে মোহাম্মদপুর থেকে আমি নিজ ব্যবস্থায় ফিরে আসবো, অন্যথায় ওর সাথে থেকেই গল্পগুজব করে সময় কাটাবো। ততক্ষণে বেলা বেজেছে দশটা তেইশ মিনিট। আমি ঝটপট করে ওযু করে হাতের সামনে যে কাপড় পেলাম, সেটাই গায়ে চড়িয়ে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বের হয়ে গেলাম। আমাকে সে বলেছিল স্টাফ রোড রেল ক্রসিং এর সামনে থাকতে। আমি রাস্তায় বের হয়েই দেখি অনেক গাড়ি লাইন ধরে যাচ্ছে, এসব গাড়ির সবগুলোকেই স্টাফ রোড রেল ক্রসিং দিয়েই যেতে হবে। আমি সামনে যেটাকে পেলাম, সেটাকেই হাত তুলে থামালাম। সে গাড়িতে কোন আরোহী ছিল না, একজন তরুণ ড্রাইভার গাড়িটি চালাচ্ছিল। আমি তাকে বললাম, ভাই আমাকে একটু স্টাফ রোড রেল ক্রসিং (আনুমানিক ৫০০/৬০০ গজ দূরত্বে) যেতে হবে, অত্যন্ত জরুরী। আমি কথা শেষ করার আগেই ড্রাইভার আমাকে উঠতে বললো, কেননা পেছনে গাড়ির চাপ ছিল।
গাড়িতে বসার সাথে সাথেই বন্ধুর কল পেলাম, আমি কোথায় জানতে চেয়ে। আমি বললাম, আমার আর দু’মিনিট লাগবে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে। সে জানালো সেও কাছাকাছি চলে এসেছে। আমি আরও আশান্বিত হ’লাম। একটু পরেই আবার বন্ধুর কল পেলাম, এবারে সে আশায় ছাই পড়লো। সে বললো, তার চালক ঢাকায় একেবারেই নতুন, ভুল করে একটি ইউটার্ন নিয়ে নিয়েছে। আমি প্রমাদ গুণলাম। আমাদের কথোপকথন শুনে সেই তরুণ ড্রাইভারটি স্বেচ্ছায় আমাকে আরও কিছুদূর এগিয়ে দিতে চাইলো, আমি তাকে ধন্যবাদ আর শুভকামনা জানিয়ে তার গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই বন্ধু জানালো সে চলে এসেছে। তার গাড়িটি ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো আমার সামনে থামলে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম, কেননা যে ভুল ইউটার্নটি সে নিয়েছিল, তা থেকে ফিরে আসতে কমপক্ষে বিশ মিনিট লাগার কথা। যাহোক, আমি ত্বরিত গাড়িতে উঠে দেখি সময় আছে বিশ মিনিটেরও কম। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে যা হয়, আমরা এই সুদীর্ঘ পথে ৬টা সিগন্যালের মধ্যে একটাতেও আটকালাম না। শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা নিয়ে যখন গন্তব্যে পৌঁছ্লাম, তখনও এগারটা বাজেনি, বাজতে কয়েক মিনিট বাকি ছিল।
বন্ধুর ভাইয়ের জানাযায় উপস্থিত হতে না পারলে আমার খুব খারাপ লাগতো। একই মাসজিদে বছর কয়েক আগে বাদ এশা অনুষ্ঠিত তার বাবার জানাযায় আমি শরীক হয়েছিলাম। তারও কয়েক বছর আগে একই মাসজিদে তার মায়ের জানাযায়ও উপস্থিত ছিলাম। জানাযার নামাযান্তে আমি শোকগ্রস্ত বন্ধুকে কিছুটা সান্ত্বনা দেয়ার সময় বন্ধু আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার সে উপস্থিতির কথাও স্মরণ করলো। তারপর তাকে আমি বললাম কতটা শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা নিয়ে আমরা দুজন মাত্র আঠারো/উনিশ মিনিটে স্টাফ রোড রেল ক্রসিং থেকে অত্যন্ত অলৌকিকভাবে তার ভাইয়ের জানাযায় উপস্থিত হতে পেরেছি! সে সব শুনে শান্তভাবে বললো, খায়রুল, এসব এমনি এমনি হয় না। কেন হয়, তা তুমিও একটু ভেবে দেখো। আশাকরি বুঝতে পারবে। আমি খানিক ভাবলাম, এবং যা বুঝার তা বুঝে নিলাম।
দ্রুত ধাবমান সময়কে পরাভূত করে আমি অপর যে জানাযায় উপস্থিত হতে পেরেছিলাম, সেটা ছিল আমার আপন ভাতিজী-জামাই এর জানাযা। কিডনী বৈকল্যে ভুগে সে মাত্র পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সে গত ২৫ অগাস্ট ২০২২ তারিখে ইন্তেকাল করেছে। সেদিন তার জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল সকাল নয়টায়, মিরপুর ১৩/১৪ নং নম্বরের ‘ব্যাটালিয়ন জামে মাসজিদ’ এ। আমার বাসা থেকে স্বাভাবিক সময়ে সেখানে যেতে অন্ততঃ চল্লিশ মিনিট লাগার কথা। তার উপর আমি ‘ব্যাটালিয়ন জামে মাসজিদ’ চিনিনা, কাছাকাছি গিয়ে সেটার অবস্থানকে খুঁজে বের করতে হবে। একজনকে পথে নামিয়ে দিয়ে আমার সেখানে যাবার কথা ছিল, তাই সময়ের বেশ টানাটানি ছিল। সে সময়টাতে কচুক্ষেত এলাকায় প্রতিদিন ভীষণ জ্যাম থাকে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেদিন কচুক্ষেতে মোটেও জ্যাম পেলাম না। ফলে নির্ধারিত সময়ের আগেই আমি সেখানে উপস্থিত হতে পেরেছিলাম।
গত ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখ বিকেল সোয়া তিনটায় মারা গেলেন রাওয়ার প্রাক্তন চেয়ারম্যান মেজর খন্দকার নূরুল আফসার (অবঃ)। ০৬ তারিখ বাদ জোহর তার নামাযে জানাযায় শরীক হয়েছিলাম। উনি একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। অকাতরে মানুষের উপকার করে গেছেন, কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে। আমি জানতাম, অত্যন্ত অমায়িক এবং বিনয়ী এই মানুষটির জানাযায় অনেক জনসমাগম হবে, তাই হাতে একটু সময় নিয়েই রওনা হয়েছিলাম তার জানাযায় শরীক হতে। ভাগ্যিস, সেটা করেছিলাম; নইলে আর পাঁচ মিনিট পর রওনা দিলে মাসজিদ পর্যন্ত যেতেই পারতাম না। সেদিন বহু লোক যানজটের কারণে জানাযার নামাজে সামিল হতে পারেননি, কেউ কেউ মাঝপথ থেকে ফিরে গিয়েছিলেন।
জানাযার নামাযের সময় আমি সবচেয়ে বেশি অভিভূত হই যখন মৃত ব্যক্তির স্বামী/সন্তান কিংবা অন্যান্য নিকটজন তার হয়ে মুসল্লীদের কাছে ক্ষমা চান। বিশেষ করে পুত্ররা যখন মা বাবার জন্য ক্ষমা চান, তখন আমার মন থেকে উভয়ের জন্য দোয়া চলে আসে। জানাযার সময় প্রথা অনুযায়ী কোন মৃত ব্যক্তির পক্ষে যদি তার পুত্র মা’ফ চাওয়ার জন্য দাঁড়ায়, সে মুখ খোলার আগেই আমি তার মা/বাবাকে মা’ফ করে দেই এবং তার জন্য দোয়া করতে থাকি। এ সময়টাতে আমার হৃদয়টা দুমরে মুচড়ে যেন ভাঙতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে সেই পুত্রটি আমার পুত্র হয়ে যায়! আমি নামাযান্তে ঘরে ফেরা পর্যন্ত নিরন্তর তাদের জন্য দোয়া করতে থাকি। জানাযার নামাযের তৃতীয় তাকবীরের পর পড়ার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দোয়া রয়েছে। আমি আরবিতে এ দোয়াটি পুরোপুরি মুখস্থ করতে পারিনি, তবে এর বাংলা অর্থ জানি। আমি মনে মনে সে অর্থটিই নিজের ভাষায় বলে যাই, সেই সাথে তাৎক্ষণিকভাবে মনে আসা আরও কিছু দোয়া সহ।
দোয়া চাওয়াটা শুধুই কোন আনুষ্ঠানিকতা নয়। বক্তার চাওয়ার মধ্যে আকুতি থাকলে তা শ্রোতার অন্তর স্পর্শ করে যায়। আর অন্তরে দোলা লাগলে প্রার্থনা এমনিতেই ওষ্ঠে এসে পড়ে। তাই এমন আকুল আবেদন শোনার সাথে সাথে আমার কণ্ঠে অনুচ্চারিত থাকলেও অন্তরে উচ্চারিত হতে থাকে প্রতিটি স্বামীহারা পতিব্রতা বিধবা নারীর জন্য, প্রতিটি পিতৃহারা সন্তানের জন্য, প্রতিটি সন্তানহারা পিতামাতার জন্য, পিতামাতার প্রতি অনুগত সকল সন্তানের জন্য আমার আকুল, অকৃত্রিম দোয়া এবং শুভকামনা। দোয়ায় কতটুকু কাজ হয় জানিনা, কিংবা আমার দোয়ায় কারও কোন উপকার হবে কিনা সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু জানাযার নামাযে দোয়া পড়ার পর আমার মনটা খুব হাল্কা হয়ে যায়। এজন্য আমি জানাযার নামায সাধারণতঃ মিস করি না, নিজের প্রয়োজনেই।
ঢাকা
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ১৩৬৭
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:০৭