১৯৭৪ সালের এরকম এক শীতের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। ময়মনসিংহ শহর থেকে একটু দূরে অবস্থিত সেই বিশ্ববিদ্যালয়েও তখন শীতের সময়ে গ্রাম বাংলার নবান্নের ঘ্রাণ পাওয়া যেত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই পল্লীগ্রামের মত ধানের চাষ হতো। ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল লাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল আয়তনকে বিভক্ত করেছিল। রেল লাইনের এক পাশে ছিল দালান-কোঠা, অপর পাশে ধান ও নানারকমের শাক-সব্জীর ক্ষেত। সন্ধ্যের আগে থেকেই শিশির ঝরা শুরু হতো, এশার সময় থেকেই আকাশ থেকে ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদর নেমে এসে দৃষ্টিকে নিকট দূরত্বে সীমিত করে দিত। কুয়াশার কারণে কাছে না আসা পর্যন্ত ট্রেনের হেডলাইট দেখা যেত না। উত্তরবঙ্গে আমার বাড়ি হবার কারণে সেই ছোটবেলা থেকেই এই লাইনের উপর দিয়ে আমাদের ট্রেন আসা যাওয়া করতো। আঁধার রাতে পল্লী প্রান্তরে হঠাৎ করে ভেসে ওঠা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলো ঝলমলে এক টুকরো শহর দেখে অবাক হতাম।
এমনই এক শীতের রাতে সেদিন কি উপলক্ষে যেন খোলা আকাশের নীচে মঞ্চ তৈরি করে ওদের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। খুব সম্ভবতঃ বৎসর সমাপনী অনুষ্ঠান। সব অনুষ্ঠানেই যেমন হয়, প্রথমে কিছু ‘খুচরো শিল্পী’দের দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়; তারপর সময় যত বাড়তে থাকে, ক্রমান্বয়ে একের পর এক ওজনদার শিল্পীদের মঞ্চে আগমন ঘটতে থাকে। সেদিনও তাই হলো। দুই একজন খুচরো শিল্পীর পর মঞ্চে এলো এক মিষ্টি মুখের পঞ্চদশী (বয়সটা আমার অনুমানের ভিত্তিতে, কিছুটা কমবেশিও হতে পারে) শিল্পী। যতদূর মনে পড়ে, কেউ একজন আমাকে বলেছিল মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কোন শিক্ষক পরিবারের সন্তান। তার গান শুনে তাকে আমার মোটেই ‘খুচরো শিল্পী’ মনে হয়নি। বস্তুতঃ তার সে গানটিই আমার কাছে ছিল সে রাতের শ্রেষ্ঠ নিবেদন।
মেয়েটি তার পরিশীলিত কণ্ঠে পরিবেশন করেছিল ললিতা ধর চৌধুরীর গাওয়া গান- “ঐ লাল গোলাপটা দাও না আমায় দাও না”। অত্যন্ত আবেগভরা কণ্ঠে এবং অভিব্যক্তিতে মেয়েটা চমৎকারভাবে গেয়েছিল সেই গান। মাত্র তিন মিনিটের গান, খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। গানের মাঝে সে যখন বলছিল, “এলো চুলে পরবো তাকে”, তখন খেয়াল করে দেখলাম সত্যিই তার এলোচুলে একগুচ্ছ লাল গোলাপ গাঁথা আছে। আমার মনে হয়েছিল, গানটা বোধহয় তার জন্যই লেখা হয়েছে। ঐ বয়সে শুধু ছেলেরাই নয়, মেয়েরাও অনেক কল্পনা বিলাসী হয়ে থাকে। গানের সাথে সাথে তার অভিব্যক্তি দেখে আমার সেরকমই মনে হয়েছিল। সে যখন মঞ্চ থেকে নেমে এলো, তখনো আমার কানে বেজে চলেছে সেই আকুতি, ‘ঐ লাল গোলাপটা দাও না আমায় দাও না’। হারিয়ে যাওয়া শিল্পী ললিতা ধর চৌধুরীও তার গাওয়া আরও কিছু মিষ্টি গানের মাঝে (যেমন, “ছোট চিঠি লাগে তবু মিষ্টি, যদি তুমি লেখো”) এই গানটির জন্যেও বিখ্যাত হয়ে আছেন।
ঢাকা
৩১ ডিসেম্বর ২০২২
https://www.youtube.com/watch?v=CK4tzmKrqjA
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:১৪