somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চলচ্চিত্রকার নূরুল আলম আতিক-এর একটি চমৎকার লেখা শেয়ার করছি

০৩ রা জুন, ২০২০ সকাল ১০:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ০৫ জুলাই দৈনিক সমকাল পত্রিকায় চলচ্চিত্রকার নূরুল আলম আতিকের চমৎকার সুখপাঠ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছিলো। সকলের সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না।



আমার ব্যঞ্জনবর্ণ পরিচয়

নূরুল আলম আতিক

ক.

ক'য়ে কলা খ'য়ে খাই, বেশি কলা খেতে নাই, গ'য়ে গরু ঘ'য়ে ঘাস...ক খ গ ঘ ঙ... তখন আমি ইশকুলে পড়ি, প্রাইমারি। খালার বাড়ি গেছি, ঘাটাইল। খালাতো ভাইয়ের সাথে চড়ূই ধরে চড়ূইভাতি খাই। পুকুরে দাপাদাপি করি। ভরদুপুরে সাদা-কালো টেলিভিশনে দেখি ওই বর্ণমালার গান। সিনেমার নাম 'ডানপিটে ছেলে'। অনেক পরে জানি, ছবির পরিচালক খান আতা। আহা! ফিল্ম সোসাইটির বন্ধুদের ভারি ভারি সিনেমাবাজির মাঝে হারিয়ে গেছে খান আতার 'সুজন সখী'র কথা। কোনোদিন বলতেই পারি নাই আমার প্রথম প্রেম 'সুজন সখী'। একবার মা-খালার কোলে বসে দেখা ফারুক-কবরী-টেলিসামাদ। পরদিনই ছোট মামার সাথে চুপিচপি দেখা সব-সখীরে পারাপারের দুষ্টু সেই মিষ্টি গান।

খ.

খবরের কাগজের বিশেষ সংখ্যায় কাইয়ুম চৌধুরীর ইলাস্ট্রেশন দেখে আর্ট বুঝি। বাথরুমের আয়নায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির এক সকালে শৈশবে আমারও ছবি আঁকার ইচ্ছে হলো। টুথব্রাশের পেস্ট দিয়ে কাগজে বৃষ্টির ছবি এঁকেছি।

গ.

গাঙ শব্দটি শুনলে আমার মনে পড়ে মধুপুরের গড়ে ছোট্ট একটা নদী। ছোট মামার সাথে কতগুলি গরুর গাড়ি বোঝাই করে ধান, ডাল, কাঁঠাল ইত্যাদি নিয়ে টাঙ্গাইল ফিরছি। দীর্ঘ এই যাত্রায় পাকা কাঁঠালের গন্ধে শেয়াল আমাদের পিছু নিয়েছিলো। যাত্রাবিরতির কালে গভীর রাতে শেয়ালেরা ফরিদ মামার পা কামড়ে দিয়েছিলো। ফুটবলার এই মামার কথাই আমি বলেছি 'সাইকেলের ডানায়'। শতাব্দি ওয়াদুদ অভিনয় করেছিল ফরিদ মামার ভূমিকায়।

ঘ.

দাবার ঘোড়া চলে আড়াই চালে। জ্যান্ত ঘোড়া নজরে এলে এখনো আমি তাকিয়ে থাকি। প্রাণীটাকে বড় ভালোবাসি। বড়বাশালিয়া, দাদিবাড়ির সামনের খালপাড়ে রাস্তায় ঘোড়াদের চলাচল দেখে দেখে এদের প্রেমে পড়ে গেলাম ওই ছোট্টবেলাতেই। 'চতুর্থমাত্রা' আর 'ডুবসাঁতার'-এ ঘোড়ার জন্যে আমার কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। স্ট্ক্রিপ্ট কিংবা প্রোডাকশন ডিজাইনে। ঘোড়াগণ নিজেরাই এসে হাজির হয়েছেন।

ঙ.

ব্যাঙের ডাক এখনো শুনতে ইচ্ছা করে শৈশবের মতোই। ব্যাঙের লাফ মনে পড়লে বুঝি, ওরা তখন হাইকু লিখছিলো বায়োলজির খাতায়।

চ.

চাঁদে পাওয়া আমি। জুলাইতে আর্মস্ট্রং-অলড্রিন চাঁদের গায়ে পদচিহ্ন আঁকলেন। পরের মাসে আমি মায়ের কোলে। টাঙ্গাইলের আকুরটাকুর পাড়া। বাড়ির নাম 'নিরিবিলি'। বড় মামা নজরুল সেনা করতেন। বৈঠকখানার দুটি ঘরভর্তি বই, সিলিংয়ে স্টেজের ঘরবাড়ি-গাছপালার কাট-আউট। আম-কাঁঠালের ছুটিতে ঢাকা থেকে নানুবাড়ি গিয়ে ওই বইয়ের স্তূপে আবিস্কার করি প্যানোরমা। আমেরিকান একটি ট্যাবলয়েড সাইজ পত্রিকা। অ্যাপোলো-১১'র চন্দ্রাভিযানের ছবি পত্রিকার পাতায় পাতায়। চাঁদের বুকে মানুষের পায়ের ছাপ, নভোচারীদের মুখ। লুনা নামে ডাক্তার বাড়ির মেয়েটিকে পড়া দেখিয়ে দিতে ডাক পড়ে। তখন আমি ভালো ছাত্র, ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষায় ঢাকা উত্তরে প্রথম হই। আমার নাম আতিক। পরে অবশ্য লুনা-টিক। চন্দ্রগ্রস্ত আজ অবধি! আর হ্যাঁ, চ'য়ে চিঠি। শিবব্রত বর্মনের লেখা ছোটগল্পের টিভি প্রোডাকশন 'চিঠি' সিরিজ কি কারো মনে আছে?

ছ.

ছাতার মতো এত সরলসিধা টেকনোলজি এখনো আমাকে বিস্মিত করে। রোদবৃষ্টির সন্ত্রাসে কেমন ফট করে মেলে দেয় ডানা! নিজে ভিজে কোলের মানুষকে আগলে রাখে। ছ'তে ছাতা। ছ'তে ছফা, আহমদ ছফাকে পিতৃজ্ঞান করেছি বলেই দূরে দূরে থেকেছি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ। পরের বছর কারো কাছে শুনে থাকবেন ছফা ভাই, আমি দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে পারি নাই। উনি ভাবলেন আমার অর্থাভাব। বললেন প্রতি মাসে এসে মাসোহারা নিয়ে যেতে। কী ক'রে বলি, ছফা ভাই, আমি উঁচু বিদ্যালয়ের কর্তাদের সাথে বেয়াদবি করছি বলে উনারা আমাকে পরীক্ষায় বসতে দেন নাই! কী সেই বেয়াদবি? থাক, না বলি, তাতে খসে পড়বে উঁচু সেইসব দালান-কোঠা।

জ.

জলে ভেসে গেছে জলছবি। তবু, জয়ন্ত, জায়েদ, সেলিম, সামির এ রকম বেশ কিছু বন্ধুর নাম উচ্চারণের জলছবি ফের ভেসে ওঠে। 'ফুলকুমার', 'চতুর্থমাত্রা', 'সাইকেলের ডানা' এসব তো আছেই, জলছবি সাধুসেবা? চারুকলার শুকনো পুকুরে দিন-রাত্রি লালন সাঁইয়ের সাধকদের জন্যে সাধুসেবা। এই শহর দেখেছে প্রথমবার; দ্বিতীয়বার সেই কতো কতো কাল আগে! জলছবির জানালায় উঁকি দেয়া সফল চলচ্চিত্র-মাস্তানদের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখি। কিসের মধ্যে কী! এদিকে, জহির রায়হানের খোঁজ পাওয়া গেছে। জহির মুদ্রিত আছেন ম্যাজিক লণ্ঠনে, আর উনাদের সাফল্যগাথা লিখা আছে আমার ধারাবাহিক ব্যর্থতার ফাঁকে-ফোকরে। আরো এক জহির আছেন, তিনি শহীদুল জহির। তার লেখার উপর ভর করে চিত্রনাট্য লিখা শুরু করেছিলাম। 'কাঁটা'র চিত্রনাট্যই প্রথমে লিখেছিলাম। তাঁর অনুমতিপত্র নিয়ে সরকারি অনুদানে জমাও দিয়েছিলাম। পরে অবশ্য ওই গল্পে অনুদান পেয়েছে কবিবন্ধু টোকন ঠাকুর। জানি, এই চলচ্চিত্রটি ঠাকুরের জীবনে একটি 'কাঁটা' হয়ে আছে।

ঝ.

ঝড় বাদলের সেই সন্ধ্যা! দৌড়ে বর্ধমান হাউজের বারান্দায়, আশ্রয়ের খোঁজে। গুটিগুটি পায়ে দোতলায় উঠে যাই। সঙ্গী প্রথম প্রেমিকা। তুমুল লোডশেডিং! বিদ্যুৎচমকে সেই চোখে চোখ রেখে আমিও কি কম চমকাইছি! ওই রাতের ঝাঁঝটা এখনো কাটে নাই!

ঞ.

কী আশ্চর্য এই ঞ বর্ণমালার ছবি দেখে চিরকাল মনে হয়, কেউ আমার কান মুচড়ে দিচ্ছে। উনি মিঞার বেটা, সময়!

ট.

টাকার খেলা। টাউট বাটপার ভাইবেরাদরদেরও দেখা কম হয়নি। টাকার বালিশ একেকটা।

ঠ.

ঠাকুরের গলার শুকনো ফুলের মালা। লিপিকার দুটি গল্প যে গল্পগুচ্ছের নামে গেলো- নতুন পুতুল ও কাঠঠোকরা ও কাদাখোঁচা পাখির গল্প- কই রবীন্দ্রভক্ত কেউ তো টুঁ শব্দটা করলো না! হায়! হয় কেউ দেখেনি। নয়তো ঠাকুরের গলায় সব কাগজের রঙিন মালা পরাতে ব্যস্ত। রবি ঠাকুরের লিখা, মৃত্যুর তিন সপ্তা আগে, 'মুসলমানির গল্প' নামের খসড়া থেকে 'না কমলা, না মেহেরজান'। একটি টেলিফিল্ম করেছিলাম। এই নামকরণ ইয়ার্কিমূলক নয়, দুটি ছবি নিয়ে প্রতিক্রিয়া, একটি সাঁইজিকে নিয়ে বানানো, অন্যটি থাক। মূলত রবিঠাকুরের গল্পের নামকরণটিই পছন্দ হয়নি। আমি হিন্দু-মুসলমানের ধর্মপরিচয় বাদ দিয়ে মানুষ চরিত্র আঁকার চেষ্টা করেছিলাম। জয়া আহসান এখানে অভিনয় করেন।

ড.

ডরভয় আরেকটু কম হলে আরো কিছু কাজ হতো, হ্যাঁ।

ঢ.

ঢালী আল মামুন। আর্টিস্ট। আর্ট করেন যিনি, তিনি আর্টিস্ট। আর যিনি প্রেম করেন তিনি প্রেমিস্ট? ঢালী ভাই প্রেমের মানুষ। এই জগৎ-সংসারে এমন মানুষের দেখা পেয়েছি, প্রেম-বন্ধুতা পেয়েছি তাইতে ধন্য। যারা তাঁকে জানেন তাঁরা জানেন বাকি কথা। ঢাকাঢাকি ছাড়াই কথাগুলা বললাম ঢালী ভাই...

ণ.

প্রাণ যায় যায়, তবু মাত্রা ছাড়া ন'র জন্যে এতো ব্যাকুলতা।

ত.

তিতাস একটি নদীর নাম। তারেক শাহরিয়ার আর তারেক মাসুদ- এঁরা আমার নদীভাই। আর তারকোভ্‌স্কি গুরু। 'তিমির জন্য লজিক বিদ্যা'- ফরহাদ মজহারের একটি বই। গণিতের সহজপাঠ। মূলত দার্শনিক গোডেল, চিত্রকর এশার, আর সঙ্গীতজ্ঞ বাখের চিন্তাজগৎ ও কর্মকুশলতা নিয়ে গাণিতিক পাঠ।

থ.

থতোমতো এই জীবন কাব্যময় হতো যদি থরোথরো প্রেমের কাঁপন এখনো জারি রাখতে পারতাম!

দ.

দিহান এক আশ্চর্য সম্ভাবনাময় অভিনেত্রী। 'বিকল পাখির গান', 'সুঁইসুতা', 'যাদুর শহর' কিংবা 'পেয়ারার সুবাস'- সবখানে তাকে দেখে দেখে আমার এত যে মুগ্ধতা! কী দুর্ভাগা এ শহর! এমন অভিনেত্রীকে জানান দিলো তোমাকে চাই না- দূর দেশে চলে যেতে বাধ্য হলো সে। দিহান আমার দেখা শহরের সবচে' ক্ষমতাধর অভিনেত্রী! মাফ করিস, দ'য়ের মত ভাঁজ হয়ে ফুটপাতে বসে আছি, আমিও যে এক ক্লান্ত পথিক। আর দেখ, ঠিক হাজার বছর আগের দীপঙ্কর অতীশের নামে এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় আছে। অথচ তাঁর রচিত একখানা পুস্তিকাও এখনো বাংলাদেশে ছাপা হয় নাই!

ধ.

ধরো চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে। জয় গুরু, লালন সাঁই। তোমার নামে ডান হাতের রেডিও ভাংছি টুকরা টুকরা, আলনায় রক্তাক্ত বালিশ শুকাই।

ন.

নৃ। একটি পত্রিকার নাম। এস.এম. সুলতান সংখ্যা, মিথ সংখ্যা ও অন্যান্য পুস্তিকায় আমার সহকর্মী, সহপাঠী বন্ধু আরিফুর রহমান মুনির। এদেশের মুদ্রণশিল্পে এক মরমি শিল্পী, বর্তমানে তাঁর প্রকাশনা সংস্থার নাম নক্‌তা। নদী নামের একটি পত্রিকা করতেন আমার বন্ধু তাজুল হক। তার সাথে ঘুরে ঘুরে আমার প্রকাশনার হাতেখড়ি। এই বিদ্যার করণেই চলচ্চিত্রম, শর্টফিল্ম ফোরাম, আর ফেরডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজের প্রকাশনা সম্পাদকের ভূমিকায় যৌবনের প্রায় একটি যুগ অভিনয় করেছি।

প.

'পেয়ারার সুবাস'। জয়া তখন ভীষণ ব্যস্ত। অভিনেত্রী জয়া আহসান। আমার আর তাঁর দু'জনেরই প্রথম ছবি 'ডুবসাঁতার'। সেই ২০০৮-এ। 'লাল মোরগের ঝুঁটি'র মেথরকন্যার চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে কলকাতা থেকে হাজির। যত বড় মুখ নয় তত বড় হাঁ নিয়ে আমি হা-হুতাশ করছি। বিশাল বাজেটের প্যাঁচ। হলো না। তুলনামূলক কম বাজেটের একটা ছবি শুরু করা যাক। তারও একই পরামর্শ, এটা হলে তবে একাত্তরের গল্প সামলানো হয়তো সম্ভব হবে। সেই 'পেয়ারার সুবাস' এখনও শেষ হবো হবো করছে, তিন বছর!

ফ.

'ফুলকুমার' আশিক মুস্তাফা। শহীদুল জহিরের গল্প, সেই সময় নিয়ে কবিবন্ধু আশিক মুস্তাফা একটা ছবি করেছিল। প্রযোজনা জলছবির নামে, এটা আশিকের ফিল্মস্কুলের ডিপ্লোমা ফিল্ম। আমি চিত্রনাট্য লিখি আর ছবির প্রধান সহকারী। যাই হোক, শহীদুল জহিরকে ছবিটা দেখতে পাবলিক লাইব্রেরির অডিটোরিয়ামে ডেকেছিলাম। ছবিটা দেখে উনি বেজার হয়েছিলেন। তার গল্পটা চিত্রনাট্যে যেই রকম পাল্টে দিয়েছিলাম যে, পরবর্তী সময়ে 'চতুর্থমাত্রা'র অনুমতি পেতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। তবে, এই অবসরে বলি, আমাদের সিনেমা 'ফুলকুমার'-এর চেয়ে দুইকদম বেশি এগিয়েছে- এটা এখনো আমি মানতে নারাজ। 'ফুলকুমার'-এর টিম মেম্বারদের এই অবসরে কৃতজ্ঞতা জানাই।

ব.

কবি বিনয় মজুমদারকে সাক্ষী রেখে একদিন বেসুরো গলায় গাইলাম 'বিকল পাখির গান'। ইহা বাংলাদেশের আপন সিনেমা-ভাষার একটি স্পষ্ট নমুনা। ওহে কৌতূহলী মন, পরখ করে দেখবেন। ভিমিওতে রাখা আছে আপনার জন্যেই। আর, এখন দিবাস্বপ্নে বংশীবাদক মেয়েটিকে দেখতে পাই। বেথুন কলেজের ছাদে বসে প্রীতিলতা বাঁশি বাজাচ্ছেন। রাধা-কৃষ্ণের ব্যাপারটার সাথে তাঁর দেশপ্রেমের উত্তাপটুকু বুঝে নিতে মন চায়। যে দুইখানা ছবি হয়েছে চট্টগ্রাম আর মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে, তা দেখে মনে হয়েছে, বাঙ্গালের কাছ থেকে প্রীতিলতার বাঁশি শোনার প্রয়োজন আছে!

ভ.

ভাতেমারা আর তরকারিমারাদের সাথেই বাকি কয়টা দিন। মানুষের বাগানের শুটিংয়ে বেশ বড় একটা টিম নিয়ে আমরা গেছি পেডেল স্টিমার পি.এস. মাহ্‌সুদে। মোরেলগঞ্জে স্টিমারটা থামে, ইউনিটের নারীমুখের উপস্থিতি দেখতে এলাকার লোকজন উৎসুক। আমিও সতর্ক, এর আগে এই স্টিমারে মোশাররফ করিমকে দেখতে নানান হুজ্জতির খবর জানা। যাই হোক উৎসুক জনতার 'হিরো আর হিরোইন কেডা'র উত্তরে স্টিমারের কর্মীর কণ্ঠ :আরে ভাই একজন ভাতে মারা আরেকজন তরকারি মারা। হি.হি.হি.।

ম.

মানুষের বাগান। বাড়ির সামনে কিংবা পেছনে বাগান করা ভুলে গেছি। ছাদে কিংবা বারান্দায় ইতিউতি কিছু বাগানের ধারণা। আমরা মানুষের একটা বাগান রচনা করতে চাই। অনেক দিনের পুরনো বন্ধু এই বাগান করতে উৎসাহ দিলেন। তাঁর নাম মোখলেসুর রহমান লেনিন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে লেনিন ছিলেন নৃ'র প্রকাশক। আজ ব্ল্যাকমিরর ফিল্মস-এর প্রথম প্রযোজনা হিসেবে মানুষের বাগান করার কারিগর। আমাকে রেখেছেন সেই বাগানের মালী। শিগ্‌গির মানুষের বাগানে আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। আরেক বন্ধু মামুনুল হক এই বাগানের ইন্ধনদাতা। বলে রাখি, এই মামুন বন্ধুই আমার জীবন-মৃত্যুর এক সন্ধিক্ষণে কী উদ্যমে অন্যদের উতলা করে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলো!

য.

যাদুর শহর। আমার অনেক আক্ষেপ ছিল, যার যার শহর নিয়ে গান থাকে। আমি কেন এত অভাগা, আমার আপন শহর নিয়ে কোন গান নাই! '৯২য় কলকাতার সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান শুনি, 'গড়িয়াহাটার মোড় মিনিমিনি বাস বাস...' আর আমার শহরের গাইয়েরা শুধু প্রেমের ছিনিমিনি নিয়ে ব্যস্ত। অনেক অভিমানে, অনেক প্রেম নিয়ে রচিত হলো এ শহর যাদুর শহর, ঢাকা-রে। আহারে, একটা যাদুর মানুষ নিয়েও এই সুযোগে একটু বলি। তিনি যাদুর শহর। ২০১২ সালে এই ধারাবাহিক নাটকের পর টিভি থেকে ইস্তফা নিয়েছি। টাইটেলের গান গেয়েছিল চিরকুট। আনন্দের লিখা গান। আক্ষেপ ছিলো, এই শহর নিয়ে কোনো গান নাই। প্রেমের গানে ডুবাডুবি অথচ শহরের সঙ্গে যেন প্রেম করতে নাই- সেই প্রয়োজনে লিখা হলো, এ শহর যাদুর শহর।

র.

রব ফকির। বন্ধু জায়েদ এক রাতে, বেশ রাতে জগতি চিনিকলে নিয়ে গেলো রব ফকিরের সাথে দেখা করতে। চিনিকলে মাদকতাময় ধোঁয়াশার মাঝে রব ভাইয়ের ওই আবির্ভাব জাগতিক নয়, চিনিময়। ভালোবাসাময়। এর পর তার দোতারার তারে বাঁধা পড়লো বাকিটা সময়। জলছবির দিনগুলি কিংবা চন্দ্রবিন্দুর সময় তাকে কাছে পাওয়া মানে, শব্দের মাঝে নিঃশব্দ করে কিছু ধ্যান আর তার গুরুবোন আকলিমার জন্যে প্রেম আমার দূর-দূরান্তরের। আকলিমার মতন কইলজার জোর দিয়ে আমি কাউরে গান গাইতে শুনি নাই- 'কেশে ধরে আমায় লাগাও কিনারে!'

ল.

লাল মোরগের ঝুঁটি! জীবনের এই প্রান্তে এসে সবচে' বড় ফাঁদ। নিম্নবর্গের মানুষ স্বাধীনতার যুদ্ধ '৭১-এ কী রকম বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে, তার রূপকার্থ নিয়ে রচিত চলচ্চিত্র প্রস্তাবনা। সরকারি অনুদান ৩৫ লাখ। দরকার এক কোটি বিশ। বিশ লাখ দিয়ে শুটিং করে বাকিটা বিষফোঁড়ার মতো টনটন করছে। ফোঁড়া কাটবে তেমন ডাক্তারের খোঁজে আছি। প্রযোজকের খোঁজ চাই!

ব.

বাবার সাথে এই জীবনে সবচে' কম কথা বলা হলো। একদিন বাথরুমের আয়নায় নিজের ছবি দেখে চমকাই। আর তাঁকে জানান দিই এখন তো বুঝি, নিজেই বাবা হয়েছি। অক্ষম সন্তানকে মাফ করে দিয়েন আব্বা। বাবা আর আব্বা'র মধ্যে ফারাকটা কী? দুই শব্দেই আছে দুইটা ব। টাইপোগ্রাফিতে একটায় সমীহ, প্রেম। অন্যটায় শুধুই বুকের উপর ঝাঁপ।

শ.

শুকু, মাতিয়া বানু শুকু। আর্টিস্ট। ইদানীং টেলিভিশন করেন। বলে রাখা ভালো, এই বিটির মতন ডায়ালগ লিখতে পারে, এই দেশে এমন কাউকে এখনো আমি চিনি না! তিনিই রেখেছেন আমায় তাঁর তিন সন্তানের (সাধু-শান্তি-অগ্নি) পিতা ক'রে। বড্ড মেজাজি। প্রথম দেখার গল্পটা এইখানে না বলি। সাইকেলের ডানার গল্পটাও তোলা থাকুক বাতাসের কানে, শান্তিনিকেতনের সাঁওতাল পল্লীর পথের ধুলায়। আচ্ছা, শামসুদ্দিন আবুল কালামকে চেনেন? হ্যাঁ, কাঞ্চনগ্রাম, কাশবনের কন্যা ইত্যাদি উপন্যাসের লিখক। উনি ষাটের দশকের শুরুতে সিনেমা পড়তে ইতালি গেলেন। জ্যা রেনোয়া, ভিসকন্তিদের শুধু বন্ধুই ছিলেন না। রোম ইউনিভার্সিটি তাঁকে 'ডি লিট' উপাধিও দেয়। আর তিনি পেটের দায়ে ইতালি আর হলিউডের বি-গ্রেডের সিনেমায় অভিনয় করেন। ছবিতে তাঁকে দেখে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয়। সিনেমার ওয়ালীউল্লাহ'র ডিপ্লোমা ফিল্মটা ইতালির ওই ফিল্ম ইশকুল থেকে কে খুঁজে আনবে?

ষ.

পেট কাটা মূর্ধণ্য ষ।

স.

সুলতান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছর ১৯৯০-এ নৃ' পত্রিকার এস.এম. সুলতান সংখ্যা করতে চাই। মূলত আহমদ ছফার একটি দীর্ঘ লেখা এই প্ররোচনা দিয়ে থাকবে। ছফা ভাইয়ের মাধ্যমে সুলতান ভাইয়ের সাথে পরিচয়। একটা ইন্টারভিউ নিতে শাহাদুজ্জামানকে নিয়ে প্রথমবার নড়াইল যাই। এর পর বেশ কয়েকবার। সুলতান ভাই ও তার ওই সময়ের সংসারের সাথে সখ্য হয়। একবার শর্টফিল্ম ফোরামের চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধক হিসেবে তাঁকে ঢাকা আনার দায়িত্ব পড়ে, সম্ভবত ৯২। লম্বা কাহিনী, অন্য সময় বলা যাবে। ঢাকায় একদিন তাঁকে নিয়ে কবি আল মাহমুদের কাছে যাই শিল্পকলা একাডেমি। ওই আড্ডায় সুলতান ছবি আঁকেন, আল মাহমুদ কবিতা- দুই-ই মুদ্রিত আছে নৃ'র মিথ সংখ্যায়। যাই হোক, সুলতান ভাই আর আমি রিকশায় ধানমণ্ডি ফিরছি ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর বাসায়। শিল্পী সুলতান তাঁকে নিয়ে তারেক মাসুদের নির্মিতব্য ছবি 'আদম সুরত'কে ইশারা করে বললেন, আচ্ছা তারেক সাহেব তো উনার কোনো ইন্টারভিউ নিলেন না! সারাটা পথ সুলতান আর কোনো কথা বলেননি। আমিও দুই শিল্পীর পরস্পরের চেনা জায়গার মর্মটুকু আন্দাজ করে চুপ থাকি।

হ.

হায়রে আমার মন মাতানো দেশ! রূপ দেখে তোর কেন আমার পরান ভরে না! হায়! এই দেশের মানুষই আমার বাঙলা বিভাগের শিক্ষক হুমায়ুন আজাদকে কাটাকুটি করলো! তাঁর কতো নদী সরোবর, লাল নীল দীপাবলি, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না- এই বইগুলি পড়েই শৈশব-কৈশোরে দেশপ্রেম-ভাষাপ্রেম-বাঙলাপ্রেম ঘটে থাকবে। আর হুমায়ুন ফরীদি ভাইয়ের সাথে তাঁর শেষ বয়সে আমার প্রেম হয়েছিলো। গভীর রাতের প্রেম, আমরা পরস্পরকে ঘুমাতে যেতে বলতাম। এখনো রাত গভীর হলে প্রায়ই ফরীদি ভাইকে মনে পড়ে। একরাতে তাঁকে ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়েছি: আফসোস, আপনার না আমাদের; একজন তোশিরো মিফুনের জন্যে কুরোশাওয়া থাকেন, একজন ক্লাউস কিনস্কির জন্যে হেরজগ, অভিনেতা সৌমিত্রের জন্যে সত্যজিৎ রায়। ফরীদি ভাই, আপনার জন্যে, আপনার সময়ে সিনেমায় কোনো ডিরেক্টর জন্মান নাই!

র.

রানওয়ে। আমার শৈশবজুড়ে রানওয়ে। আমি রানওয়েতে দৌড়ে দৌড়ে বড় হয়েছি। প্রথমত পুরাতন এয়ারপোর্ট। পরবর্তীকালে কুর্মিটোলায় নির্মাণাধীন নতুন এয়ারপোর্ট। আর হ্যাঁ, রান্নাবান্না আমার বেশ পছন্দের বিষয়। এটাও আমি প্রথম শিখি মায়ের কাছে। পরবর্তীকালে চিত্রশিল্পী তরুণ ঘোষের কাছে। এই তরুণ দার সঙ্গ করেই জানি ছবি আঁকা, রান্না করা আর সিনেমা নির্মাণ একই কথা।

ড়.

ভাঁড়ামো আর অভিনয়ের ফারাকটা জানতেও চ্যাপলিনের কাছে ধর্না দেওয়া চাই!

ঢ়.

গূঢ় কথা চালাচালি করে কী লাভ? তবু আর কতোকাল নাকে শর্ষের তেল দিয়া ঘুমাবো? এক বন্ধু বিজ্ঞাপন বানান বিল দখলকারীদের হাউজিংয়ের জন্যে। শৈশবে ওই বিলে আমি সাঁতার শিখেছি, ওইখানেই সাঁতার কাটতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে আমার ক্লাস ফাইভের দুই বন্ধু। খুব কাছের বন্ধু শৈশবে হারানোর স্মৃতি তো এখনো পরিস্কার। সিনেমা-সিনেমা করে রাস্তাঘাটে এতকাল ঘোরাঘুরি করে এমন অনেক গুপ্তকথা জানি, যা প্রকাশ না করাই ভালো।

য়.

ইহা দ্বিতীয় য়!

ৎ.

ৎ দিয়ে যা যা কথা মনে আসছে তা বললে ছাপা মুশকিল। প্রিয় বন্ধু, আপনারাই আন্দাজ করে নিন।

ং.

অং রাখাইন। প্রিয় সহকর্মী। দুর্দিনের বিরল সঙ্গী। 'আমার সাইকেল' এবং 'লাস্ট পোস্টঅফিস' গুরুত্বপূর্ণ দুটি সিনেমা। সিনেমায় যেমন, রান্নাবান্নায়ও পটু। এ বিষয়ে আমার হিংসা, আর তাঁর অহংকারটুকু জারি থাকুক।


:.

দুঃখের পাহাড় আর সুখের পাহাড়ের মাঝে বয়ে চলছে প্রিয় কর্ণফুলী। ওই নদীতে লুকিয়ে রেখেছি অনেক কিছু। গোপন কিছু। বললে, ছিঃ ছিঃ করবে সবাই।

ঁ.

চন্দ্রবিন্দু নামে একটা নন-ফিকশন প্রোগ্রাম তৈরি করেছিলাম, অভিনেতা স্বাধীন খসরুর প্ররোচনায়। আমি লাকি, বন্ধু শারমিন লাকিকে এই জীবনে পেয়েছি। আমার বিবেচনায় সবচে' জরুরি কাজ। নূরুল আলম আতিক নামে ভিমিওতে জমা আছে। সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন, সময়ের চাঁদ হাতের নাগালে পেতেও পারেন!

ি
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২০ সকাল ১০:৩৪
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রোএক্টিভিটি এবং কম্পাউন্ড ইফেক্ট: আমার গুরুত্বপূর্ণ দুইটি শিক্ষা

লিখেছেন মাহদী হাসান শিহাব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১১



আমার গুরুত্বপূর্ন দুইটা লার্নিং শেয়ার করি। এই দুইটা টুল মাথায় রাখলে দৈনন্দিন কাজ করা অনেক সহজ হয়। টুল দুইটা কাজ করতে ও কাজ শেষ করতে ম্যাজিক হিসাবে কাজ করে।

এক.

স্টিফেন কোভের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

লিখেছেন সায়েমার ব্লগ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৩

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ
ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

১।
যৌন প্রাকৃতিক, জেন্ডার নয়।জেন্ডার মানুষের সৃষ্টি (social, cultural construction)। যৌনকে বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন সময়ে যেভাবে ডিল করে, তাঁকে ঘিরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্মৃতির ঝলক: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি এবং মনের শান্তির খোঁজে

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০১



সরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে একটি ঘূর্ণায়মান পথ জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর অবস্থানে আমি খুব শান্তি অনুভব করি। নদীর জল ছুঁয়ে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সঙ্গে এক আন্তরিক সংযোগ অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×