"নাতালিয়া" আমার মেয়ে। এই নভেম্বরের ২৩শে সে ১৩ তে পড়বে। ওর এক মাথা কালো কুঁচকুচে চুল, স্বচ্ছ নীল স্ফটিকের মত এক জোড়া চোখ আর গোলাপী সাদায় মেশানো ওর গাঁয়ের রঙ দেখে যে কেউ হয়ত ভুল করে বসবে ওকে জীবন্ত স্নো হ্যোয়াইট ভেবেই। যেদিন ও প্রথম আমার কোলে এলো, সেই ক্ষনটির কথা আমি কখনও ভুলিনা। যখন তখন কারণে অকারনেই আমার মনে পড়ে যায় সেই অসাধারণ মুহুর্তটির কথা। বহু বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে চলেছি আমি, মাড়িয়ে গিয়েছি তপ্ত উষর মরুভূমি, যে কোনো মুহুর্তে পা ফসকে যাওয়া ক্লেদাক্ত পিচ্ছিল পথে পা টিপে টিপে হেঁটে গেছি বহুদূর। গন্তব্যে পৌছুবার আগেই ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে শরীর ও মন। তবুও আমি অটল থেকেছি আমার সিদ্ধান্তে, পৌছেছি আমার গন্তব্যের সীমারেখায়। তবে আমার এই ৩৪ বছরের কঠোর কঠিন প্রস্তর মর্মরিত জীবনে নাতালিয়ার আবির্ভাব, সে ছিলো এক অসাধারণ অজানা মূহুর্ত। সেই আলৌকিক শিহরনের মূহুর্তটি রুপকথার গল্প হয়ে আমার হৃদয়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে আমৃত্যু অথবা আজীবন !
লম্বা সাদা গ্লাভস জড়ানো দুহাতে হাসিখুশি শ্বেতাঙ্গিনী নার্স যখন আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো এই জীবন্ত ডলটিকে। সে এক অদ্ভুৎ মিষ্টি সূরে কেঁদে উঠে ঘাড় বাঁকিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো আমার দিকে। ওর বড় বড় পদ্মকোরোকের নীল জ্বলজ্বলে তারা দুটির চারপাশ ঘিরে তখন টলমল করছিলো স্বচ্ছ নীল দীঘির মত জল। এ্যানেস্থাসিয়ার প্রকোপে আমার চোখের পাতা মুঁদে আসছিলো বারবার। তবুও আমি প্রানপনে চেয়ে রইবার চেষ্টা করছিলাম। ভারী চোখের পাতার ফাঁকে ফাঁকে আমি দেখছিলাম আমার রক্তমাংসে গড়ে ওঠা এই অপূর্ব সুন্দর রাজকন্যাটিকে। ওর লাল টুকটুকে ঠোঁটের ভেজা ভেজা ভাবটুকুনও আমার স্মৃতিতে আজও জ্বাজল্যমান অবিকল সেই প্রথম দিনটির মতই। আমার অবস্থা একটু ক্রিটিকাল থাকায় আমার কাছে বেবিটিকে বেশ কয়েকদিন রাখতে দেওয়া হল না। শুধু রোজ নিয়ম করে দুবেলা সকালে এবং বিকালে আমাকে দেখাতে নিয়ে আসত ওরা। বেডটাকে উঁচু করে দিয়ে আমার কোলে কিছুক্ষন দেওয়া হত নাতালিয়াকে। যতক্ষন পারতাম আমি বুকে আঁকড়ে ধরে থাকতাম ওকে। একটা মুহুর্তের জন্যও চোখ ফেরাতাম না ওর মুখ থেকে। ওর বন্ধ চোখের পাতার উপরে একটা অদ্ভুৎ ভাঁজ ছিলো। সেই ভাঁজ এখন অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে এলেও, ও যখন চোখ বোঁজে, আমি ঠিক আজও আভাস পাই সেই অদ্ভূৎ মিষ্টি ভাঁজটির। অবিকল সেই একদিনের বাচ্চাটির মতই।
আমার কাছে ওকে রাখবার নির্ধারিত সময়টুকু শেষ হতেই ওরা যখন ওকে আমার কোল থেকে নিয়ে যেত, আমার ভীষন রাগ লাগতো। বাকীটা সময় আমি আমার বেডে থাকতাম ঠিকই কিন্তু আমার মন পড়ে থাকতো ওর কাছে। ভয় হত যদি ভুল করে ওকে মিশিয়ে ফেলে ডক্টর নার্সেরা অন্য বেবিদের সাথে? কষ্ট হত হয়ত কত্তইনা কাঁদছে বাচ্চাটা আমার, আমাকে কাছে না পেয়ে। রাগও হত ওদের উপরে। মনে মনে গাল দিতাম ওদেরকে, নিজেকেই প্রশ্ন করতাম, কি পাষানী বাবা, এতটুকু বাচ্চা কি মাকে ছাড়া থাকতে পারে! ঘুমের ঔষধ দেওয়া হত আমাকে ঘুম পাড়াতে কিন্তু আমি ঘুমাতাম না। জোর করে জেগে থাকতাম কি এক অজানা ভয়ে। তবুও এক অদ্ভুৎ ভালো লাগায় সারাটাক্ষন ভরে থাকতো মন। আমার রাজকন্যাটিকে নিয়ে অদূর ভবিষ্যতের স্বপ্নের জাল বুনতাম মনে মনে। ঠিক আমার মনের মত করেই গড়ে তুলবো আমি ওকে। আমার জীবনের সকল অপূরণীয় স্বপ্নগুলির বাস্তব রূপ দেবো আমি আমার মেয়েটির মাঝে। ও আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। ওকে আমি আমার স্বপ্নগুলো দিয়েই গড়ে তুলবো। এই নাতালিয়ার মাঝেই রেখে যাবো আমি আমার অস্তিত্তের বীজ । নতুবা আমার নিঃশেষতার সাথে সাথে শেষ হয়ে যেত আমার ছায়াটিও। কিন্তু সেই অনিঃশেষিত ছায়াটি নিয়েই এই পৃথিবীর বুকে হাঁটবে এক সত্যিকারের রাজকন্যা। আমার মত কোনো দুঃখিনী রাজকন্যা নয় সে। তাকে আমি সকল ঐশ্বর্য্যে গড়ে তুলবো মহীয়ান।
নাতালিয়ার জন্মের বহু বছর আগে থেকেই আমি ছিলাম আমার জীবনে একা। এই একাকীত্ব যে আমাকে কোনো রকম দুঃখ বা কষ্টের সাগরে ভাসিয়েছে তা নয়। বরং আমার একাকীত্বকে আমি উপভোগ করেছি ঠিক আমার মত করে। হয়তোবা এই একাকীত্বটাকে দরকার ছিলো আমার নিজের কাজের মাঝে শতভাগ ডুবে থাকার উপযুক্ত কাল ক্ষেপন হিসাবে। তাই কোনোরকম আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব বর্জিত মোটামুটি নিজের কাজগুলো নিয়ে নিভৃতে ছিলাম আমি। কিছুটা ইচ্ছাকৃতই। কাজেই এই বিদেশ বিভুই এ নাতালিয়ার জন্ম মুহুর্তে হসপিটালটিতে বলতে গেলে ডক্টর এবং নার্সদের হাতেই ছিলো আমার আর আমার সন্তানের সকল দায়িত্ব। যদিও আমার সার্জারীর বন্ড সিগনেচার হতে শুরু করে লোকাল গার্ডিয়েনের দায়িত্ব নিয়েছিলো আমার সহকর্মী ক্লারা। তবে সেতো শুধু সহকর্মীই। খুব বেশি কিছু তার কাছে আশা করা যায়না। করিনিও আমি। তবুও ক্লারা অনেকই করেছিলো। আজও সে সুখে দুখে রয়েছে আমার পাশেই। বরং ওকে প্রতিদান দেবার মত কোনো সুযোগই পাইনি আমি। তবে এটা বুঝি সকল দানের প্রতিদান হয় না। কিছু কিছু নিস্বার্থ দান প্রতিদানহীন থাকাই ভালো। ক্লারা এমনই একজন নিস্বার্থ ভালোবাসার বন্ধু আমার। বলতে গেলে বর্তমানের একমাত্র বন্ধুই সে আমার।
যাইহোক। বলছিলাম নাতালিয়ার কথা, আমার ১৩ বছরের টিন এইজ মেয়েটা। ওর দিকে তাকালেই মনে হয়, ঠিক যেন রুপকথার স্নোহ্যোয়াইট গল্পের বই এর পাতা থেকেই উঠে এসেছে সে। আমি ওর এক মাস বয়স থেকেই রুপকথার ঐ পরীদের মত করেই সাজিয়ে গুছিয়ে বড় করে তুলেছি তাকে এই এতটা বছর। এর জন্য আমার কম ভোগান্তি হয়নি । তবুও নাতালিয়া তো আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। ওকে কি কম যত্নে চলবে? কম কাঁঠ খড় পোহাতে হয়নি আমার ওকে পেতে গিয়ে। কত রকম হরমোনাল পরীক্ষা নিরীক্ষা, মেডিসিন, ট্রিটমেন্ট, ওজন আয়ত্বে আনা থেকে শুরু করে কঠোর নিয়মানূবর্তিতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে বেশ কয়েকটা মাস। তবুও আমি আশা হারাইনি। ফিরে যাইনি বিফল পথে। আমার এই রাজকন্যাকে পেতে দৃঢ় প্রতীজ্ঞ থেকেছি আমি। সয়ে নিয়েছি জীবনের সকল জটিলতা। প্রতিবন্ধকতার সকল কাঁটা ছিন্ন করে এগিয়ে গেছি আমি। শুধুই সামনে। পিছন ফিরে দেখার কোনো অবকাশ ছিলো না আমার। আমি চেয়েছি এই পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে নিজস্ব স্বকীয়তায় হেঁটে চলুক গর্বিত এক রাজহংসী, আমার নাতালিয়া। রুপে, গুনে, মেধা ও মননে ছাড়িয়ে যাক সকলকে সে। আমি চেয়েছি এই জীবনের সকল বাঁধা অতিক্রম করে বীর বিজয়িনীর মত হেঁসে উঠুক কেউ এই পৃথিবীর বুকে। সে আমার নাতালিয়া।
চির মাতৃস্নেহ বিবর্জিত এই আমির মাঝে এই আকুল মাতৃত্বের তৃষ্ণা যে ঠিক কি রকম তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না কখনও। তবুও সেই আকন্ঠ উঠে আসা উদ্বেলিত তৃষ্ণার বুদবুদে তখন আমি দিশেহারা। সারাটাক্ষন আমার চোখে ঘুরে বেড়ায় ফুটফুটে এক দেবশিশু। সে কখনও হাসে, কখনও কাঁদে এমনকি অস্ফুটে মা বলেও ডাকে। আমার রীতিমত অডিও হেল্যুসিনেশন শুরু হলো। আমার শয়নে স্বপনে জাগরণে তখন শুধুই মাতৃত্বের হাহাকার। একদিকে আমার চিরকুমারী জীবন কাটিয়ে দেবার কঠোর কঠিন ব্রত আরেকদিকে মাতৃত্বের এই ব্যাকুল ত্বষ্ণা। এই দুই এর মাঝে হাবু ডুবু খাচ্ছি তখন আমি। রাস্তা ঘাটে, রেস্তোরায় পার্কে বাবা, মা বা দুজনের হাত ধরেই যখন হেঁটে যায় ফুটফুটে মিষ্টি শিশুগুলো। আমি হা করে তাকিয়ে থাকি সেদিকে। আমার বুকের ভেতরে ব্যথার ঝড় ওঠে। এই জীবনে কেউই রইলোনা আমার। একান্ত আপনজন। যে শুধুই আমার আপন অস্তিত্বের প্রতিকৃতি। আমার স্রোতধারা। একজন একান্ত আপনজনের তৃষায় আমার প্রান ফেটে যায়, বুক ফেটে কান্না আসে। আমার আপন স্বত্তা, আমার একজন অস্তিত্বের অংশীদার, আমার প্রবাহধারা। কোথায় পাবো তারে! আমি উতলা হয়ে উঠি। সাইকিয়াটিস্টেরও পরামর্শ নেই আমি। উনি আমাকে এবং আমার কালচার, কৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আমাকে কারো সাথে ঘর বাঁধার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমার চোখে ভাসে, সদ্য কৈশর পেরিয়ে তরুণী হতে চলার সেই কোমল মুহুর্তটিতে হৃদয় উজাড় করা অদ্ভুৎ প্রেমময় ভালোবাসার সময়টুকু। এবং হঠাৎ ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার সেই বিষম শকটুকুও। যা আমার ভেতরে এতটাই প্রোথিত হয়েছিলো যে এই জীবনের আর কাউকে ভালোবাসাই হলো না আমার। আর বিয়ে তো অনেক দূরের কথা। আমি তা চাইওনা।
কিন্তু আমি মা হতে চাই। শুধুই একজন মা। মমতাময়ী মায়ের এক অদ্ভূত অজানা অস্তিত্ত আমি অনুভব করি আমার নিজের মাঝে। আমি চাই আমার একজন অতি আপন কেউ থাকুক এই ধরিত্রীতে। যাকে বুকে চেপে ধরে ভুলে যাওয়া যায় এই পৃথিবীর সকল অবহেলা, সকল প্রত্যাখানের ব্যথা। আমার ভেতরে বোধ হয় যে, সেই অতি আশ্চর্য্য অনুভবের একরতি প্রিয় মানুষটির জন্যই আমি তিলে তিলে মরে গিয়েও বেঁচে থেকেছি এই ৩৪টা বছর। অনুভব করি, সে আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। ভোরের অরুণ আলোয় মাখা দিনের শুরু, জ্যোস্নামাখা ফাগুন রাতের গান। আমি দিনে দিনে ভেঙ্গে পড়তে থাকি। নুয়ে পড়তে থাকি উদাসীনতার নৈরাজ্যে। আমার ভেতরে বয়ে যায় শূন্যতার হাহাকার। তখন একদিন ক্লারাই আমাকে পরামর্শ দেয়! ক্লারার পরামর্শেই আমি খুঁজে পাই আমার স্বপ্নের ভূবন। আমার স্বপ্নের রাজকন্যাকে তিলে তিলে গড়ে নেবার স্বপ্ন দেখি। ভেসে যাই এক অজানা আনন্দের স্রোতধারায়। আমার হৃদয়ের গভীরে জলতরঙ্গের মিষ্টি টুংটাং সূর বাঁজে। সেই সূরে গলা মেলাই আমি। নেচে চলি বর্ষাস্নাত ময়ুরীর মত আমার কল্পনার রঙ্গিন বনভূমিতে একাকী অবিরল।স্বপ্নে আমার রাজকন্যা খিলখিল হাসে।আমি শুনতে পাই সেই হাসি অবিকল একবারেই আমার পাঁজরের গা ঘেসে
হৃদয়ের গহীন কুঠুরে। আমি মগ্ন হয়ে পড়ি বার বার।
এরপর আরও কয়েক মাস কেটে যায় আমার রাজকন্যাকে গর্ভে ধারন করবার নানা প্রস্তুতিতে। আমি বেঁছে নেই কালো কুঁচকুঁচে চুল আর গোলাপী আভায় মেশানো গোলগাল মায়াবী মুখ আর গাঢ় নীলচোখের এক আইরিশ যুবককে। কিনে নেই তার বংশ কনিকা। আমার রাজকন্যার জন্য তাকেই সবচাইতে উপযুক্ত মনে করি আমি। দিন কাটে, রাত পেরোয় । আমি উপভোগ করি আমার মাতৃত্বকালীন দীর্ঘ সময়গুলো। প্রানভরে উপভোগ করি আমি আমার স্বর্গীয় সকল ব্যাথা ও বেদনাগুলোকেও। দিনে দিনে শরীরের পরিবর্তনগুলি পরিস্ফুট হতে থাকে। আমি অবাক হয়ে বহন করে চলি আমার পরম আরাধ্য, আকুল পিয়াসী সেই মাতৃত্বকাল। আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি আমার সন্তানের বেড়ে ওঠার ইতিহাস। আমি চুপি চুপি কথা বলি ওর সাথে। লিখে চলি একের পর এক চিঠি ওর কাছে সারা রাত্রী জেগে জেগে। ওকে গান শোনাই, ঘুম পাড়িয়ে দেই। শপিং মলগুলো ঘুরে ঘুরে কিনি নানা রকম জামা, বেবি লোশন, বেবি ওয়েল, ফিডার ইত্যাদি ইত্যাদি। ভরে তুলি ঘর একের পর এক ওর জন্য কেনা আবোল তাবোল জিনিসপত্রে। এরপর দীর্ঘ প্রতীক্ষার পথ পাড়ি দিয়ে এক সোনালী সন্ধ্যায় আমার কোল জুড়ে আসে আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। মাই মোস্ট ভ্যালুয়েবল বেবি। মাই আইভিএফ চাইল্ড নাতালিয়া...
নাতালিয়াকে নিয়ে এরপর শুরু হয় আমার নতুন জীবন.....
কিন্তু.....
চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:০৯