somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ইলিশ মাছকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



উদ্দেশ্যঃ এই প্রস্তাবনার উদ্দেশ্য হলো ইলিশ মাছের (জাতীয় মাছ) সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরা এবং এটিকে বাংলাদেশের অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা।

প্রেক্ষাপটঃ ইলিশ (Tenualosa ilisha) হলো বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং জাতীয় পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক। বিশ্বের মোট ইলিশ আহরণের প্রায় ৬৫% বাংলাদেশে পাওয়া যায় (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০২৩)। এই মাছ শুধু খাবার নয়—এটি কবিতা, লোকগীতি, গল্প এবং দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িত।

পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদী এবং বঙ্গোপসাগরে ইলিশের প্রধান আবাসস্থল। এর স্বাদ ও গন্ধকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সেরা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেও ইলিশের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা এর দীর্ঘ সাংস্কৃতিক সংযোগের প্রমাণ।

সাংস্কৃতিক গুরুত্বঃ উৎসব ও আচারঃ পহেলা বৈশাখে পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ খাওয়া বাঙালির প্রধান ঐতিহ্য। বিয়ে, ঈদ ও নবান্ন উৎসবেও ইলিশ রান্না করা হয়।


সাহিত্য ও লোককথাঃ প্রবাদ, মাছের রাজা ইলিশ এর মর্যাদা প্রকাশ করে। গান ও লোকগীতিতে ইলিশকে নদীর আশীর্বাদ হিসেবে দেখা হয়। গল্পে ইলিশকে আনন্দ ও প্রাচুর্যের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।


সামাজিক বন্ধনঃ আত্মীয়-স্বজনকে ইলিশ উপহার দেওয়া সম্মানের প্রতীক। পরিবারে ইলিশ খাওয়া শুধু খাবার নয়, বরং একসাথে আনন্দ ভাগাভাগির প্রথা।

অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ ইলিশ বাংলাদেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২% এবং দেশের জিডিপির প্রায় ১% যোগান দেয় (বিবিএস, ২০২২)। প্রায় ৪.৫ লক্ষ জেলে সরাসরি ইলিশ আহরণের সঙ্গে জড়িত এবং আরও ৪০ লক্ষ মানুষ পরোক্ষভাবে এর সঙ্গে জীবিকা নির্বাহ করে (বিশ্বব্যাংক, ২০১৯)। ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে ইলিশ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। ইলিশ মৌসুমে স্থানীয় মাছ বাজারগুলো একেকটি সাংস্কৃতিক মেলার মতো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

ঐতিহ্যের মূল্যঃ ধরন প্রক্রিয়া: নৌকা, জাল এবং মাছ ধরার কৌশল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে। রন্ধনশৈলী: শুঁটকি, সরষে ইলিশ, ইলিশ পোলাও, পাতুরি—সবই বিশেষ ঐতিহ্য। আঞ্চলিক গৌরব: চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা ইত্যাদি জায়গার ইলিশ নিয়ে গর্ব ও প্রতিযোগিতা স্থানীয় পরিচয় তৈরি করেছে।


ঐতিহাসিক গুরুত্বঃ মুঘল আমলে ইলিশ রাজকীয় খাবার হিসেবে পরিচিত ছিল। নদীভিত্তিক প্রাচীন বানিজ্যপথে ইলিশ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ব্রিটিশ শাসনামলের নথিতে ইলিশকে “রূপালি ফসল” বলা হয়েছে।

পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নঃ অতিরিক্ত আহরণ ও নদী দূষণের কারণে ইলিশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। সরকার ইলিশ অভয়াশ্রম, প্রজনন মৌসুমে আহরণ নিষেধাজ্ঞা, এবং জেলেদের সহায়তা কর্মসূচি চালু করেছে। অমূর্ত ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেলে জনগণ আরও সচেতন হবে এবং টেকসই আহরণ নিশ্চিত হবে।


সীমান্তবর্তী স্বীকৃতিঃ ইলিশ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় জায়গায় জনপ্রিয় হলেও পদ্মা-মেঘনার ইলিশকে সর্বোচ্চ মানের ধরা হয়।


যৌক্তিকতাঃ ইলিশ শুধু মাছ নয়, এটি একটি জীবন্ত ঐতিহ্য। এটি বাংলাদেশের মানুষের পরিচয়, আবেগ ও জীবনধারাকে বহন করে। স্বীকৃতি পেলে সাংস্কৃতিক জ্ঞান ও ঐতিহ্য সংরক্ষিত হবে। টেকসই মাছ ধরা নিশ্চিত হবে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ আরও মর্যাদাবান হবে।

সুপারিশঃ বাংলাদেশ সরকারকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদপ্তর (DoF), এবং বাংলাদেশ জাতীয় কমিশন ফর ইউনেস্কো–এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনেস্কো তে আবেদন করে ইলিশ মাছকে অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

ইলিশ শুধু খাবার নয়, এটি ভালোবাসা, ঐতিহ্য, কবিতা, জীবিকা ও গৌরবের প্রতীক। এটি নদীকে মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে যুক্ত করে। অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ইলিশকে স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, নদী ও ঐতিহ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুরক্ষিত থাকবে।


তথ্যসূত্র

১. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), ২০২২। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বার্ষিকী।
২. মৎস্য অধিদপ্তর (DoF), বাংলাদেশ, ২০২৩। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ সংকলন।
৩. বিশ্বব্যাংক, ২০১৯। দক্ষিণ এশিয়ায় ইলিশের অর্থনৈতিক গুরুত্ব।
৪. ইউনেস্কো, ২০০৩। অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত কনভেনশন।
৫. করিম, এম., ২০১৬। ইলিশ: বাংলাদেশের গৌরব। বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
৬. রশিদ, হ., ২০১৮। বাংলাদেশের নদীতে ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার পদ্ধতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৪১
১০টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×