somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'চটেমটেই তো!'

২৭ শে মে, ২০১১ রাত ১০:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

করিতে পারিনা কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে
পাছে লোকে কিছু বলে।।

হৃদয়ে বুদবুদ্ মত
ওঠে শুভ্রচিন্তা কত
মিশে যায় হৃদয়ের তলে
পাছে লোকে কিছু বলে।।

কামিনী রায়ের এই লাইনগুলি যে বয়সে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম সে বয়সটা ছিলো মুখস্থ করার; ওজন বুঝে হৃদয়স্থ করার বয়সটা পেয়েছি আরো অনেক বছর পর। আমাদের বাংলা বইটার নাম ছিলো, যতদূর মনে পড়ে, সবুজপত্র কিংবা সবুজপাতা। ক্লাশ নিতেন আমজাদ স্যার। চোখে পুরু কাঁচের চশমা- তায় আবার স্কচ টেপের নানান কারিকুরি। কোনরকমে রিডিং পড়তে পারলেই বেঁটেখাটো ওই লোকটা বেজায় সন্তুষ্ট হতেন; কাব্যসুধা চেখে দেখবার তাড়না তার মধ্যে কস্মিনকালেও ছিলোনা। আমাদেরও মন এবং চোখ থাকতো ক্লাশরুমের ঠিক বাইরের রঙ্গন গাছের ঝোপের ওপর। কামিনী রায়ের দুর্দান্ত বাণীগুলোর প্রাণশক্তি তৎকালে বড় বেশি ছিলোনা বোধ হয়; কর্ণকুহর ইস্তক বড়জোর; রঙ্গনের ঝোপ ডিঙিয়ে মনের আঙিনা অবধি অ্যাকসেস পেতনা। মোদ্দা কথা- আমাদের কাঁচা মনে মিসেস রায়ের কাব্যের 'বেইল' ছিলোনা।

তারও আগের কথা যদি ধরি- যখন ক্লাশ ফাইভ- আমাদেরকে গিলতে হয়েছিলো যতীন্দ্রনাথ বাগচীর 'কাজলাদিদি'। এই চমৎকার কবিতাটি কেন আমাদেরকে অতটুকুনকালে পড়ানো হয়েছিলো সেটা আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে আমি কোনদিন বুঝে উঠতে পারবো না বলেই মনে হয়। 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা'- লাইনটিতে গন্ধের যে তীব্র মৌতাত তা টের পাওয়া কি ওইটুকুন বয়সের কাজ? দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মায়ের মুখ ঢাকবার কারণটা কখনোই বুঝিনি। এই বুঢ্ঢাকালে এসে যখন নিচের লাইনগুলো
পড়ি তখন মায়ের কষ্টটা কিছুটা মনে হয় যেন বুঝতে পারি-

'দিদির মতন ফাঁকি দিয়ে
আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে র'বে?
আমিও নাই দিদিও নাই- কেমন মজা হবে!'

দুঃখের কথা, ক্লাশ ফাইভে কিন্তু ব্যাপারটাকে লুকোচুরি টাইপের থ্রিলিংই মনে হতো!

কবিতার কথা বলতে গিয়ে এই মুহূর্তে আরেকটা কবিতার- আসলে ছড়ার-কথা মনে এলো। সুফিয়া কামালের খুব সম্ভবত, নাম 'পল্লীস্মৃতি'। আমার মতে ওটা ছিলো ওই বয়সের জন্য একটা পারফেক্ট কবিতা। সুয়ো-দুয়োর গল্প থেকে শুরু করে পাতালপুরীতে সাতশ' সাপের পাহারা থেকে রাজপুত্রকে ছিনিয়ে আনবার অংশগুলো খুব রোমাঞ্চ জাগাতো। তবে 'আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে'- কথাগুলো ধাঁধাঁর মতন লাগতো। মায়ের বকুনিতে উল্লাস বাড়ার কার্যকারণ তখনো বুঝিনি যে!

কাজী কাদের নেওয়াজের একটা কবিতাও পড়তে হতো ওই ক্লাশেই- 'শিক্ষকের মর্যাদা' নামে। ওইটাও বেশ সহজপাচ্য ছিলো; শুধু দুয়েকটা জায়গা বাদে। একটা ছিলো- 'ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিলো তার ভালে' এবং অন্যটি 'দিল্লীপতি, সে তো কোন ছার'। আরো ছিলো- 'পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?'। আমি অবশ্য ছাত্র তেমন সরেস ছিলাম না; ক্লাশে রোল ছিলো ঊনপঞ্চাশ; তার ওপর ইশকুল-পালানিটা তখন থেকেই মকশ্ করতাম; না বুঝবার সেটাও একটা কারণ হতে পারে। তবে অনেক কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝি যে, নিচের চিত্রকল্পের মতন আদর্শ শিক্ষার্থী আজ আর পাওয়া যাবে না!

'ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে, আনত নয়নে
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়ে নিজেরি পায়ের ধূলি
ধুয়েমুছে সব করিছেন সাফ সঞ্চারি অঙ্গুলি।'


এই মুহূর্তে দুটো কবিতার হদিশ পেতে খুব ইচ্ছে করছে- প্রথমটির নাম নিশ্চিতভাবে মনে নেই- সম্ভবত 'ঝড়ের রাতে' ধরণের কিছু হতে পারে। কবির নামও মনে নেই এখন। বইয়ের শুরুতেই কবিতাটি গদ্যাকারে ছিলো- সঙ্গের ছবিতে ছিলো ঝড়ের মধ্যে উর্ধ্বশ্বাসে-দৌড়ে-চলা একটি বালকের ছবি। অভাগা বালকের নাম মাহবুব। তার মনিব তার ওপর বেদম অত্যাচার চালাতো- 'শুধুই গালাগালি/ আর পান থেকে চুন খসলেই মার আথালি-পাথালি'- এটুকু মনে আছে। আর মনে আছে-

'অত্যাচারী চিরকালই ভীরু
যতই মোটা হোকনা দেহ, সাহস বেজায় সরু।'

এই মাহবুব যখন অত্যাচার রুখে দাঁড়ায়- 'ভয়কাতুরে মাহবুব আজ এমন সাহসী!/ কাঁপুনি নেই কঁকানি নেই, হেঁট করে নেই মাথাটি'- তখন ভিলেনপেটানোর দৃশ্য দেখবার সমতুল্য আনন্দ পেতাম।

অন্য যে কবিতাটি এই মুহূর্তে মাথায় ঘুরছে সেটির নাম 'হতে পাত্তেম'। কবির নাম জানিনা। ক্লাশ নাইনের বইয়ে ছিলো- যদিও সিলেবাসে ছিলোনা। ডিজুসীয় টার্মে বলা যায় কবিতাটি ছিলো 'জট্টিল' ধরণের। কবিতাটি উত্তম পুরুষে যেখানে কবি আস্ফালন করছেন যে ইচ্ছে করলে তিনি এই হতে পাত্তেন, সেই হতে পাত্তেন- কিন্তু শেষতক কিছুই হননি- 'চটেমটেই তো!' এরকম আরেকটা কবিতা ছিলো- 'লোকটা শুধু করতো বড়াই/ ভাঙতে পারি লোহার কড়াই'... যাহোক, 'হতে পাত্তেম' কবিতাটির কয়েকটা লাইন সম্ভবত এরকম ছিলো-

'হতে পাত্তেম আমি এক মস্ত বড় বীর
কিন্তু ওই যুদ্ধের গোলাগুলিতে যে পা রয়না স্থির
তাই আমি বীর না হয়ে কবি হয়েই রইলাম
চটেমটেই তো!'

এই কবিতাটা আমার জীবনের দর্শন। আমিও হ্যানোত্যানো নানান কিছু করতে 'পাত্তেম'; কিন্তু শেষাবধি করেছি কচুর ঘন্টা; অবিশ্যি যোগ্যতার ঘাটতি ছিলো এমনটা নয়; শুধু ওই 'চটেমটেই তো!'। ব্লগ লিখে ব্লগোস্ফিয়ারে সনিক বুম ঘটিয়ে দিতে 'পাত্তেম', চাইলে ব্লগিং করে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার-পাউন্ড-ইউরো-স্টার্লিংও কামাতে 'পাত্তেম'- কিন্তু 'চটেমটেই' সেপথে আর গেলাম না। নিন্দুকেরা হয়তো বলবেন ব্লগের পথ না মাড়ানোর কারণ আর কিছুই না- 'শুধুই গালাগালি/ আর পান থেকে চুন খসলেই মার আথালি পাথালি'-উদ্ভূত ভয়। সেক্ষেত্রে কী আর বলা! 'চটেমটেই' চুপ থাকি না হয়!
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×