somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনের গল্প: দাম্পত্য

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক:
সন্ধ্যাবেলা মানিক স্নিগ্ধাকে অনেক লোকের সামনে গালাগালি করল, খুব তুচ্ছ কারণে।হোটেল থেকে বেরিয়ে ওরা চারজন মাত্র লাবনী বিচে এসেছে,  ঝিনুকের দোকানিরা ডাকাডাকি করছে; এক দোকানি মানিককে 'স্যার, একবার আমার দোকানে আসেন, স‍্যার' বলতেই মানিক সেই দোকানে গেল। তারপর দোকানি যাই দেখায়- ঝিনুকের মালা-পর্দা-বাটি-পুতুল, একের পর এক সব কিনতেই থাকলো। "কি করছো? এসব কেন কিনছো? "আমার ইচ্ছে, আমি কিনছি, চুপ থাকো।" শক্ত মুখ করে উত্তর দিল  মানিক। "কিন্তু এসব দিয়ে কি হবে? কে ব্যবহার করবে এগুলো?" "যাকে খুশি বিলিয়ে দিও, এখন চুপ থাকো" "এসব হাবিজাবি জিনিস আবার কাকে দেব?'" "হাবিজাবি জিনিস! নিজেকে কি মনে কর? কোন নবাবজাদী তুমি!! আমার টাকায় আমি যা খুশি তাই কিনব। একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো, না হয় কোথাও চলে যাও; আমার সামনে থাকবে না।"

এমনিতেই সন্ধ্যাবেলায় সৈকতে ভিড়, তারপর মানিকের উঁচু গলা শুনে আশপাশে কিছু লোক জমে গেছে, দোকানী তো আছেই।  প্রাণপণে চোখের পানি আটকাতে চাইল স্নিগ্ধা, কিন্তু টের পেল  উষ্ণ ধারা গাল বেয়ে নামছে । ঘুরে হোটেলের দিকে হাঁটা দিল। পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিল অনেকগুলো চোখ তাকে অনুসরণ করছে, বুঝতে পারছিল ৫ আর ৭ বছরের ছেলে দুটো ভয়ার্ত, কাঁদো কাঁদো, মুখে তার দিকে চেয়ে আছে কিন্তু বাবার ভয়ে ছূটে এসে হাত ধরতে পারছে না। সৈকতের একেবারে কাছেই হোটেল; তাই পৌঁছাতে বেশি সময় লাগল না। চাবি নিয়ে রুমে ঢুকে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো স্নিগ্ধা। আট বছরের বিবাহিত জীবনে এমন অপমানিত আগেও বহুবার হতে হয়েছে, বারবার মানিক তাকে বলেছে "চলে যাও", কিন্তু কোথায় যাবে! ছেলে দুটোকে হারিয়ে ফেলার ভয় সারাক্ষণ তাকে তাড়া করে বেড়ায়। স্নিগ্ধা শুনেছে, মা-বাবার ডিভোর্স হলে সাত বছর পর্যন্ত ছেলেরা মায়ের কাছে থাকতে পারে, তারপরই বাবা ছেলেদের নিয়ে নেয়। ও তো ভালো করেই জানে, মানিক কিছুতেই ছেলেদের ছাড়বে না! ছেলেদের না দেখে ও কি করে থাকবে...... মাঝে মাঝে মানিকের বকাবকি শুনে দম বন্ধ হয়ে আসে, ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করে,  কিন্তু  জানে,রাগ করে ঘর থেকে একবার বেরিয়ে গেলেই মানিকের ঘরের দরজা তার জন্য চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ পর দরজায় নক। চোখ মুছে দরজা খুলে দিল স্নিগ্ধা, ভয়ার্ত ছেলেদুটোকে হাসিমুখে জড়িয়ে ধরল। "নাটক, না! খালি নাটক করো! একা একা হোটেলে এসে কার জন্য বসে আছো! এসব করতে হলে অন্য জায়গায় গিয়ে কর, আমার ঘরে না।" একটানা কথা বলতে লাগলো মানিক। স্নিগ্ধা কোন কথা না বলে ছেলেদের জুতো খুলে দিল, ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে ভালো করে হাত- পা- মুখ ধুয়ে দিয়ে কাপড় বদলে দিল। "এইতো, আমার বাবুসোনারা রেডি!" হাসিমুখে দুজনের গালে চুমু খেলো স্নিগ্ধা- কান্না লুকিয়ে এভাবে হাসার অভিনয় অনেকদিন হলো রপ্ত করেছে সে; না হলে বাচ্চাগুলোর মনের ভার কাটে না..........

হান্ডি থেকে রাতের খাবার খেয়ে হেঁটে হোটেলে ফিরছিল, দুই হাতে দুই ছেলের হাত ধরা। অনবরত নানা প্রশ্ন করছিল দুজন, "আচ্ছা মা, এই সমুদ্রের পরে কি আছে"  "ইন্দোনেশিয়ার আচেহ্ প্রদেশ, সমুদ্র দিয়ে সোজা গিয়ে একটুখানি বাঁয়ে গেলেই ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছে যাওয়া যায়।" সেই কোন কালে ভূগোল ক্লাসে স্যার বলেছিলেন; আজ মনে পড়ে গেল! "ইন্দোনেশিয়ায় কে থাকে মা?" "কে আবার থাকবে রে বোকারাম! ইন্দোনেশিয়ায়  ইন্দোনেশিয়ান থাকে", খিলখিল করে হেসে উঠলো স্নিগ্ধা। মা কে হাসতে দেখে দুই ছেলেও হাসতে লাগলো।

অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল; স্নিগ্ধা দেখল দুই পাশে দুই আত্মজের  মায়াময়, ঘুমন্ত মুখ। একটু দূরেই মানিক ঘুমাচ্ছে-  দেখে মনেই হচ্ছে না এই মানুষ টাই সময় সময় অতটা হিংস্র হয়ে ওঠে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসল, সন্ধ্যা বেলার অসমাপ্ত কান্নাটা আবার কি পেয়ে বসল! কিন্তু এখন কাঁদা যাবে না, মানিকের যদি ঘুম ভেঙে যায় আর ওকে কাঁদতে দেখে তাহলে ক্ষেপে গিয়ে কি করবে কে জানে। খুব আস্তে দরজা খুলে বারান্দায় এল, দীর্ঘ সৈকত চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। ভাটার টানে পানি অনেক নেমে গেছে, যখন ঢেউ এসে তীরে আছড়ে পড়ছে দেখে মনে হচ্ছে যেন রুপার মালা ভেঙে পড়ছে। বহুদূর থেকে কেবল ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জন, আর কোথাও কোন শব্দ নেই; মনে হচ্ছে   কোথাও কেউ নেই, স্নিগ্ধা একাকী আদিম পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আছে....

বারান্দা থেকে স্নিগ্ধা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো একতলায়, পায়ে পায়ে বেরিয়ে এল হোটেল থেকে। বিশাল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মনে হয়, বুকের দম ধরা ভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে,  হাঁটতে লাগলো নির্জন সৈকত ধরে। মনে পড়লো সন্ধ্যাবেলা ছেলেদের বলছিল, সমুদ্র দিয়ে গেলেই ইন্দোনেশিয়া। না জানি ইন্দোনেশিয়া দেশ টা কেমন! জীবনে কিছুই তো দেখা হলো না...... জীবন এখন শুধু ঘরের ভিতরে কেন্নোর মতো ভয়ে গুটিয়ে দিন কাটানো......

 স্নিগ্ধার খুব ইচ্ছা করতে লাগলো ইন্দোনেশিয়া দেখার। সোজা দক্ষিণ দিকে গিয়ে একটু বাঁয়ে গেলেই তো ইন্দোনেশিয়া! লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ইন্দোনেশিয়ার দিকে হাঁটতে শুরু করে দিল স্নিগ্ধা...........

দুই:
"এত বড় বাড়ি পরিষ্কার করতে তোমার খুব কষ্ট হয়, তাই না? একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকলে কষ্ট কম হইত তোমার।" ঘরগুলো ভ্যাকুয়াম করে হয়রান লাইজু একটু জিরানোর জন্য  পাশে বসতেই  মোশতাক বলে উঠলো, গলায় সহানুভূতি। "না, কি আর কষ্ট! এতকাল করতে করতে অভ্যাস হয়ে গেছে।"  "কি কষ্ট মানে! আমি কি কিছু বুঝি না....... এজন্যই ভাবতেছি, একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে উঠি, তাইলে তোমার কষ্ট একটু কমে।"

লাইজু  ভেবেছিলো, এটা মোশতাকের কথার কথা। কিন্তু দেখা গেল, পরদিন থেকেই বাসায়  ক্রেতার ভিড়। কেউ দেখছে ফার্নিচার, কেউ বাড়ি কেউ গাড়ি। তাজ্জব হয়ে শুধালো মোশতাককে, "কি করছ এসব! বলেছিলে তো শুধু ছোট বাড়িতে যাবে; তারজন‍্য সব কিছু কেনো বিক্রি করে দিচ্ছ? গাড়ি ছাড়া চলব কিভাবে?"

"আসলে কি হইছে লাইজু,আজকাল আমার গাড়ি চালাইতে খুব অসুবিধা হয়, চোখে ঠিকমতো দেখিনা, শরীরটা ঠিক নেই। তুমি আবার চিন্তায় পড়ে যাবা দেখে তোমাকে আগে বলি নাই; ভাইবা দেখলাম, সবকিছু বিক্রি করে টাকাটা ব্যাংকে রেখে দিলে, আমার কিছু হয়ে গেলেও তুমি নিশ্চিন্তে এর মুনাফা দিয়ে চলতে পারবা.........আর এত জিনিসপত্র ছোট অ্যাপার্টমেন্টে রাখবো কোথায়!"

এক সপ্তাহের মধ্যে সব বেচা শেষ। মোশতাক মহা খুশি, টাকাগুলো ব্যাংকে জমা দিয়ে একদিন লাইজুকে নতুন ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্ট দেখাতে নিয়ে গেল। দেখে লাইজুর খুব মনখারাপ; এত ছোট অ্যাপার্টমেন্ট! এই অল্প কয়েকটা ফার্নিচার! আঠাশ বছর আগে বিয়ের পর প্রথম নিউ ইয়র্কেআমার এসে যে অ্যাপার্টমেন্টটি উঠেছিল, সেটা পর্যন্ত এর চেয়ে বড় ছিল। তখন মোশতাক অন্যের দোকানে চাকরি করত, আর এখন মোশতাকের নিজের দু-দুটো গ্রোসারি শপ। তাও কেন.........

নিউ ইয়র্কে আসার বছর দশেকের মধ্যেই বেশ বড় একটা বাড়ি  হয়েছিল লাইজুর; আঠাশ বছরে কত জিনিস কিনে সেই বাড়ি সাজিয়ে ছিল; কত মায়া জড়িয়ে ছিল..........
সে বাড়ির সমস্ত কিছু মোশতাক বিক্রি করে দিল, এমনকি লাইজুর সাধের ঘর সাজানোর শো-পিস গুলোও। খালি বলে, "জীবনকে সহজ কর; বেশি জিনিস মানে এগুলোর যত্ন নিতে বাড়তি খাটনি! এখন আমাদের আরাম করার, জীবনকে উপভোগ করার সময়।"

নতুন অ্যাপার্টমেন্টে এসে লাইজুর সত্যি কাজ অনেক কমে গেল। কিন্তু এই অফুরন্ত সময় দিয়ে করবেটা কি! ছেলে মেয়ে দুজন চাকরি আর পড়াশোনার জন্য কতদূর চলে গেছে; একজন বস্টনে, আরেকজন মিশিগানে। মোশতাক তো চিরকালই  সকালে বের হয় আর অনেক রাতে ফেরে। এখানে এসে লাইজুর মন খারাপ দেখে নানাভাবে চেষ্টা করে ওর মন ভালো করতে। একদিন একটা হীরের আংটি নিয়ে এলো। দেখে সত্যি লাইজুর মন ভাল হয়ে গেল; কতদিনের শখ ছিল একটা হীরের আংটি পরার....... মোশতাক সব সময় বলতো এটা বাজে খরচ........  "এত খরচ করে আবার হীরের আংটি কিনতে গেলে কেন?" "না তেমন খরচ হয়নি, এক দোকানে সেলে একটার দামে দুটো আংটি পাওয়া যাচ্ছিল, সস্তা দেখে কিনে ফেললাম।"

"সবকিছু গুছাতে হবে লাইজু, দেশে যে জমিজমা আছে তাও বিক্রি করে ফেলব; দেশে যাওয়া দরকার" কদিন পর এক সকালে নাস্তা খেতে খেতে মোশতাক বলল। "তোমার মাথায় বিক্রির ভূত চেপেছে! সত্যি দেশে যাবে?"  "হ্যাঁ, কালকে রাতে ফ্লাইট!" "কাল!!! তুমি কালকে দেশে যাচ্ছ, কবে ঠিক করলে!!!!" বিমূঢ় লাইজুর মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হলো না। মোশতাকও আর কথা বলতে পারলো না, মুখ ভরা পরোটা- আলু ভাজি।

মোশতাক যাবার আগে ঘরের দরকারি সব কিছু কিনে রেখে গেছে, তাও কিছু টুকটাক জিনিস দরকার ছিল। সপ্তাহখানেক পরে এক সকালে লাইজু  সেসব আনতে তাদের গ্রোসারী শপে গেল। আবারো তাজ্জব হবার পালা; গ্রোসারী শপের নাম বদলে গেছে, সেখানে অচেনা লোক জন, বাঙালি অবশ্য। দোকানের মধ্যে হতভম্ব হয়ে লাইজুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ম্যানেজার ধরনের একজন এগিয়ে এলেন, "আপনি কিছু খুঁজছেন?" "এটা মোশতাক আহমদের দোকান না?"  অনেক কষ্টে লাইজু কটা শব্দ জোড়া লাগাতে পারলো। "হ্যাঁ, আগে ওনার ছিল, উনি আমার কাছে এটা বিক্রি করে দিয়েছেন। শুনেছি উনার দেশে খুব টাকার প্রয়োজন, তাই বাড়ি-গাড়ি -দোকান সব বিক্রি করে দেশে টাকা নিয়ে গিয়েছেন।"

নিউ ইয়র্কে দুপুর মানে দেশে গভীর রাত, তবু লাইজু ফোন করলো মোশতাককে, "শারমিনের আব্বু, তুমি নাকি বাড়ি- গাড়ি- দোকান সব বিক্রি করে সব টাকা নিয়ে চলে গেছো!!!!" "এই কথা জিগাতে তুমি আমার ঘুম ভাঙ্গালে!!!  আরে এই টাকা কি তুমি কামাইছ!! চৌত্রিশ বছর আমেরিকায় কষ্ট করে এই টাকা আমি কামাইছি......... কত কষ্টই যে করলাম আমেরিকায়..... এখন একটু আরাম করি দেশে......... আর শুন, তুমি আর আমাকে ফোন করে বিরক্ত করবা না  লাইজু। কালকে থেকে নতুন সংসার পাততেছি......... বড় ভালো একটা মেয়ে পাইছি।"

তিন:
নার্স যখন হুইল চেয়ার ঠেলে মেয়েটাকে রুমে নিয়ে এলো, তখন শায়লা দেখে ধন্ধে পড়ে গিয়েছিল; সদ্য- প্রসূতি কোন মা এমন তরতাজা থাকে কী করে! আর কী দারুন দেখতে মেয়েটা! দীর্ঘ পল্লব ঢাকা টানা টানা চোখ, গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট, ঠাস বুনোনী কুচকুচে কালো দুই বেনী হাঁটু ছুঁয়েছে, হুইল চেয়ারের হাতলে রাখা হাতের আঙ্গুল যেন গোলাপি পদ্ম- কোরক । মেয়েটার বয়স ছাব্বিশ সাতাশ হবে। দামি সবুজ সিল্কের গাউন পরেছে। চকিতে শায়লা নিজের পরনের ম্যাক্সির দিকে তাকালো; হাসপাতালে পড়ার জন্য কেনা সস্তা ম্যাক্সি। মেয়েটার সাথে ৫/৬ জন মহিলা। ওরা ওদের খোপে ঢোকামাত্র নার্স পর্দা টেনে দিল।

আল আইনের জিমি হাসপাতালের এই বড় রুমটা পর্দা টেনে দিয়ে চারটা খোপে ভাগ করা যায়। গতরাতে ডেলিভারির পর শায়লাকে নার্স যখন রুমে পৌছে দিয়েছিল তখন অন্য বাসিন্দাদের পর্দা টানা থাকায় শায়লা দেখতে পায়নি । সকালে ক্লিনাররা কাজ শুরু করার সময় সবার পর্দা সরিয়ে দিয়েছিল, তখনই শায়লা দেখেছিল রুমের আর দুজনের একজন ভারতীয় একজন আরবি। ততক্ষণে ওর মেয়েকে ওর পাশের ক্রিবে দিয়ে গেছে- ঘুমন্ত মেয়েকে দেখতে দেখতে নানা অনুভূতি মনে খেলা করছিল ! এমন সময়ই এই মেয়েটাকে নিয়ে নার্সদের আগমন।  কথা শুনে বোঝা যায় এরা আরবি- হয়তো স্থানীয়!

 ঘণ্টাখানেক পর ঐ খোপের পর্দা সরে গেল- এবার প্রসূতি মাকে দেখে শায়লা চমৎকৃত!!! মনে হচ্ছে কোন পার্টিতে যাবে এমনভাবে সেজেছে ! গলায় দুই তিনটা নেকলেস, হাত ভরা সোনার চুড়ি, লিপ্সটিক-কাজল! একজন মহিলা মেয়েটার একঢাল চুল খুলে বিলি কেটে তেল মাখাচ্ছেন, একজন পায়ে মেন্দি পড়াচ্ছেন; আর মেয়েটা দিব্যি বসে আছে! শায়লা দেখলো ঘরের আর দুজন বাসিন্দাও তারমতই চোখ বড় করে এই দৃশ্য  দেখছে!

ঘন্টা খানেক পর নার্স মেয়েটার বাচ্চা নিয়ে এলো; হাসপাতালে নার্সরা সদ্যজাত বাচ্চা কে একটা পাতলা কম্বল দিয়ে এমনভাবে মুড়ে রাখে, যেন বাচ্চা মায়ের পেটের ভিতরকার উষ্ণতা অনুভব করে, এই বাচ্চাটাও সেভাবে কম্বল মোড়া । বাচ্চা ক্রিবে শুইয়ে নার্সও একনজর মায়ের সাজসজ্জা দেখলো, তারপর হেসে কিছু একটা বলে চলে গেল। মায়ের পরিচর্যা শেষে এবার বয়স্ক মহিলা শুরু করলেন বাচ্চার পরিচর্যা। প্রথমেই ক্রিব থেকে মায়ের বিছানায় আনা হলো। হাসপাতালের কাপড় বদলে মায়ের মতই সিল্কের গাউন পড়ানো হলো, তাতে আবার জরি-সুতার নকশা করা! এরপর পরানো হল চোখে কাজল, দুই হাতে দুটো সোনার চুড়ি। এবার মায়ের কোলে মেয়েকে তুলে দেয়া হলো, মুগ্ধ চোখে মা মেয়েকে দেখতে লাগলেন; বাচ্চাটাও মায়ের মতই সুন্দর! শায়লাও মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে ভাবল, "ম্যাডোনা।"

দুপুর বেলা নার্স পর্দা টেনে দিতেই টানা ঘুম; ঘুম ভাঙলো স্বামী নাসিমের ডাকে। ভিজিটিং আওয়ার শুরু হয়ে গেছে; একটু পরেই পরিচিত কয়েকজন বন্ধু বাচ্চা দেখতে এলেন; এই বিদেশে এরাই আত্মীয়। বেশ গল্পগুজবে দু'ঘণ্টা কাটলো। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হতেই রূম খালি, কেবলমাত্র সুন্দরী রোগিনীর খোপ ভর্তি  পুরুষ ও মহিলা  ভিজিটর; সবাই কল কল করে কথা বলছে, বাচ্চাকে একজন থেকে আরেকজন কোলে নিচ্ছেন। সবার মাঝে রানীর মত বসে আছে বাচ্চার মা। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেও শায়লা বুঝতে পারল না, এই মহারানীর রাজা কোনজন!

রাত দশটার দিকে যখন সব বাতি নিভিয়ে খোপে খোপে পর্দা টেনে দেয়া হয়েছে ঘুমাবার জন্য, শায়লা ঘুমাবার চেষ্টা করছে, তখন শ্রীলঙ্কান ক্লিনার মায়া এল। ক্লিনার হলেও ইংরেজি বলে শায়লার চাইতে ভালোভাবে! মায়া তার পোশাকের পকেট থেকে কুরুশ কাঁটায় বোনা উলের পুতুল বের করে হেসে বলল, "তুমি পুতুল পছন্দ করো? মাত্র ১০ টাকা!" শায়লা ও হাসল, "খুব পছন্দ করি, কমলা পুতুলটা দাও।" পুতুল  নিয়ে ফিসফিস করে বলল, "মায়া, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, ঐ খোপে যে সুন্দর মেয়েটা সকালে আসলো, ওর আত্মীয়স্বজন সবাই খুব আনন্দ করলো, মনে হচ্ছে বাচ্চাটাকে পেয়ে সবাই খুব খুশী! কিন্তু এই খুশির দিনে বাচ্চাটার বাবা কি আসেনি? কাউকে দেখে আমার মনে হয় নি এই মেয়েটার স্বামী বলে!!!"

"ও, এই বাচ্চাটার কথা বলছ? ওর আত্মীয়-স্বজন খুব খুশি, কারন মা-বাবার বিয়ের আট বছর পর ও জন্মেছে! ওর বাবা অবশ্য আজ আসেনি, কারণ পাঁচ মাস আগে সে আরেকটি বিয়ে করেছে।"



 




















সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:৫১
৩১টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছায়ানটের ‘বটমূল’ নামকরণ নিয়ে মৌলবাদীদের ব্যঙ্গোক্তি

লিখেছেন মিশু মিলন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



পহেলা বৈশাখ পালনের বিরোধীতাকারী কূপমণ্ডুক মৌলবাদীগোষ্ঠী তাদের ফেইসবুক পেইজগুলোতে এই ফটোকার্ডটি পোস্ট করে ব্যঙ্গোক্তি, হাসাহাসি করছে। কেন করছে? এতদিনে তারা উদঘাটন করতে পেরেছে রমনার যে বৃক্ষতলায় ছায়ানটের বর্ষবরণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কটের সাথে ধর্মের সম্পর্কে নাই, আছে সম্পর্ক ব্যবসার।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৫০


ভারতীয় প্রোডাক্ট বয়কটটা আসলে মুখ্য না, তারা চায় সব প্রোডাক্ট বয়কট করে শুধু তাদের নতুন প্রোডাক্ট দিয়ে বাজার দখলে নিতে। তাই তারা দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ড্রিংককেও বয়কট করছে। কোকাকোলা, সেভেন আপ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জন্য নিয়ম নয়, নিয়মের জন্য মানুষ?

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৭



কুমিল্লা থেকে বাসযোগে (রূপান্তর পরিবহণ) ঢাকায় আসছিলাম। সাইনবোর্ড এলাকায় আসার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটকালেন। ঘটনা কী জানতে চাইলে বললেন, আপনাদের অন্য গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে। আপনারা নামুন।

এটা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×