আমার প্রিয় ছড়াকার-ব্লগার স্নিগ্ধ মুগ্ধতার (MBBS) ডিগ্রী অর্জন উপলক্ষে অভিনন্দন জানাই। সেই সাথে নানা কিসিমের ডাক্তার সম্পর্কিত কিছু জ্ঞান এই নবজাত ডাক্তারের সাথে শেয়ার করতে চাই, যাতে ডাক্তারি জীবনের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি বেছে নিতে পারেন কোন ধরনের ডাক্তার তিনি হতে চান!
স্নিগ্ধ-মুগ্ধতার কবিতা দিয়ে শুরু করি:
"আই ব্যাটারা, এই দিকে আয়, আয় ঘাড়ে কোপ বসাই,
পাঁচটা বছর বাঁশটা খেয়ে আজকে হলাম কসাই।"
কবিতায় একটা ভুল আছে, অদৃশ্য কোপটা পড়ে রোগীর পকেটে, ঘাড়ে না! "সহজে রোগীদের পকেট কাটার ১০১ টি উপায়" ইন্টার্নি ডাক্তারদের শিক্ষানবিসীর শুরু থেকেই সম্ভবত শেখানো হয়। এর উদাহরণ প্রাইভেট হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে কর্মরত ডাক্তাররা। একবার গেছি পা ভাঙ্গা রোগী নিয়ে, ইমারজেন্সিতে ঢোকার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেখানকার ডাক্তার পঞ্চাশ হাজার টাকার টেস্ট করতে দিয়ে দিলেন! কিভাবে? রোগী আসার খবর পেয়ে অর্থোপেডিক্সের ডাক্তার জরুরী বিভাগে এসে পৌঁছানোর আগেই সেখানকার ডাক্তার পনের রকম ব্লাড টেস্ট, পাঁচ রকম এক্সরে, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি, বোন স্ক্যান, এম আর আই, সিটি স্ক্যান, আলট্রাসনোগ্রাফিসহ প্রায় ৫০ রকম টেস্টের তালিকা তৈরি করে ফেলেন; আসলে ছাপানো তালিকাটা তৈরিই থাকে; ডাক্তারের কাজ শুধু তালিকার খোপে খোপে টিক চিহ্ন দেওয়া। ইতিমধ্যে সিনিয়র ডাক্তার এসে টেস্টগুলোর প্রায়োরিটি ঠিক করে দেন। পা ভাঙ্গা রোগী তেমন সিরিয়াস কিছু না, এক্সরে দেখেই ডাক্তার প্লাস্টার করে বাড়ি যেতে দিতে পারেন, কিন্তু তা না করে তিনি প্লাস্টারের পর হাসপাতালে ভর্তি করে নেন, তারপর চলতে থাকে টেস্টের পর টেস্ট! অপ্রয়োজনীয় টেস্ট- কিন্তু সে কথা তো ডাক্তারকে রোগী বলতে পারে না! কিন্তু যদি পা না, মাথা ভাঙ্গা রোগী জরুরী বিভাগে যান তাহলে? সেক্ষেত্রে আগে এমআরআই, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি টেস্ট না করে চিকিত্সা শুরু করা যায় না, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা শুরু হতে কিছুটা সময় লাগে। ততক্ষণে জরুরী বিভাগ থেকে রোগীর জায়গা হয় আই সি ইউতে, সেখান থেকে ভাগ্য ভালো থাকলে কেবিন; খারাপ থাকলে লাইফ সাপোর্ট; ইতিমধ্যে রোগীর পকেট অনেকটাই খালি হয়, অল্প যেটুকু ভরা থাকে, লাইফ সাপোর্ট সেটুকুও খালি করে ফেলে............
ঝকঝকে প্রাইভেট হাসপাতালের জরুরী বিভাগে যাবার পর এইরকম চিকিৎসা আমি পরিচিত কয়েকজনের বেলা দেখেছি। তাই যখন আমি একদিন অসুস্থ হলাম, তখন এক মুহুর্তেই ঠিক করলাম, প্রাইভেট হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কিছুতেই যাবনা। জান হয়ত বাঁচাতে পারবো না, কিন্তু ডাক্তারদের হাত থেকে আমার টাকা তো বাঁচাতে হবে! ঘটনাটা হয়েছিল এরকম- বিকাল বেলায় আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়ছি, হঠাৎ করে মনে হল সব অক্ষরের মাত্রাগুলো কেমন লম্বা হয়ে যাচ্ছে। তারপর দেখি সেই লম্বা মাত্রাগুলো বেঁকে যাচ্ছে তারপরই মনে হলো সব লাইন গুলো জিগজাগ হয়ে গেছে। এই এরকম:
তাড়াতাড়ি বই বন্ধ করে চোখ বন্ধ করলাম, দেখি বন্ধ চোখেও শুধু সাদাকালো জিগজাগ দেখছি, চোখ খুলেও এটা ছাড়া চারপাশের আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হলো আমার স্ট্রোক করছে, তাড়াতাড়ি সবাইকে ডেকে বললাম, "আমার স্ট্রোক করছে, হাসপাতালে নিয়ে চল!" আমার বাসার খুব কাছেই একটা ঝকঝকে প্রাইভেট হাসপাতাল আছে, কিন্তু আমি কিছুতেই সেখানে যেতে চাইলাম না; (জরুরী বিভাগ থেকে আই সি ইউ না ঘুরে গিয়ে রোগী কেবিনে গেছে, এমন ঘটনা সেখানে অতি বিরল)! আমি যেতে চাইলাম সরকারী হাসপাতালে, আগারগাঁওয়ের ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সাইন্সের জরুরি বিভাগে। ঘরের লোকের প্রবল আপত্তি সত্বেও আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল রইলাম, যদিও হাঁটতে গিয়ে পা টলছিল! সময়টা ছিল এপ্রিলের এক সুন্দর মেঘলা বিকেল। রাস্তায় যেতে যেতে মনে হল, এত সুন্দর পৃথিবী, আর হয়ত দেখা হবে না!! সুন্দর পৃথিবী দেখছি! তারমানে চোখের সামনে থেকে জিগজাগ উধাও হয়ে গেছে! ততক্ষণে হাসপাতালে কাছেই চলে এসেছি, তাই আপাত সুস্থ বোধ করলেও গেলাম জরুরি বিভাগে, মাত্র দশ টাকার টিকিট কেটে! এখানকার ডাক্তাররা খুবই যত্ন নিয়ে পরীক্ষা করলেন আঙ্গুল অবশ কিনা, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কি না; এইসব। তারপর বললেন তেমন কিছু হয় নি, চাইলে আমি সিটি স্ক্যান করতে পারি, কিন্তু সেটার প্রয়োজন নেই। কিছু ওষুধ খাবার জন্য লিখে দিলেন।
এবার বাড়ি ফিরতে লাগলাম খুশিমনে- প্রাইভেট হাসপাতালের জরুরী বিভাগে না যাওয়ায় বেঁচে গেল অন্তত ১,৯৯,৯৯০ টাকা, আর সাথে জান টাও- কারণ আইসিইউ থেকে একবার লাইফ সাপোর্টে গেলে লাইফ কি আর ফিরে পেতাম!
ঘরে ফিরে, প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধের নাম দিয়ে গুগল সার্চ দিলাম। দেখলাম অকুলার মাইগ্রেন নামের এক রোগের ওষুধ এগুলো, যে রোগে রোগীরা কিছুক্ষণের জন্য চোখে জিগজাগ দেখেন, আমিও ঠিক এমনই দেখেছি। অর্থাৎ মাত্র ১০ টাকা নিয়ে ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সায়েন্সের ডাক্তাররা ঠিকঠাকমতো আমার রোগ নির্ণয় করে ঠিক ওষুধ দিয়েছিলেন, সেটা খেয়ে কিছুদিনের মধ্যেই আমি পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছিলাম!!!!
তাই বলে সব সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার এই ডাক্তারের মতো ভালো নয়! একটা ঘটনা বলি! আমার বাসায় কাজ করে যে মহিলা, সে গিয়েছিল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে। সেখানকার আউটডোরের ডাক্তার নাকি তাকে হাসপাতালের পাশের একটা নির্দিষ্ট দোকান থেকে ওষুধ কিনতে বলেছেন। আমি তার প্রেসক্রিপশন দেখতে চাইলাম, দেখলাম হিব্রু ভাষার মতো অক্ষরে কিছু লেখা, কোন মতেই কিছু পড়তে পারলাম না!
প্রেসক্রিপশন পড়তে না পেরে বললাম যে ওষুধ কিনেছে, সেটা নিয়ে আসতে। দেখি যে সেই ওষুধ একেবারে অনামী কোম্পানির, গুগলে সার্চ দিলাম কিন্তু খুঁজে পেলাম না! যা বুঝলাম তা এই- এগুলো ভুয়া কোম্পানির ভূয়া ওষুধ; অশিক্ষিত রোগীদের প্রেসক্রিপশনে ডাক্তার সাংকেতিক ভাষায় এগুলোর নাম লিখেন, এই সাংকেতিক চিহ্ন বোঝে কেবল তার ফার্মেসীর লোক। এই ওষুধ খাবার ফলে রোগীর স্বাস্থ্য ভালো হয় না, কিন্তু ডাক্তারের পকেটের স্বাস্থ্য ভালো হয়।
ডাক্তারদের নিয়ে আরো অনেক গল্প আছে। আজ আর না!
স্নিগ্ধ মুগ্ধতার জন্য প্রার্থনা, সে যেন ২৬ তারিখে বিসিএসের ভাইভায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়, এবং সেই রকম ডাক্তার হয় যেমন ডাক্তার আমি পেয়েছিলাম নিউরো সাইন্স হাসপাতালে!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:০৭